• ক্রিকেট

চাচা ভাতিজার একদিন!

পোস্টটি ২৭৩৭৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সময় স্রোতের টানে, প্র‍য়োজন কিংবা প্রিয়জনের টানে, কিংবা দীক্ষিত হওয়ার দীক্ষাগুরুর খোঁজে যেনো আমি বদ্ধ হয়েছি ইট পাথরের গড়া এই কৃত্রিম শহরের অদ্ভুত মায়াজালে। মায়ার সে জাল বড়ই অদ্ভুত। সে মায়ার টানে কিংবা সময়ের সে স্রোতের টানে যেনো অনুভূতি গুলো নিজের সাথেই খেলার ছলনায় জানান দিচ্ছে ‘বদলে যাচ্ছি আমরা; আমাদের পরিবেশ!’

কোনো এক শীতের পাতাঝড়া রুক্ষ বিকালে গুটিশুটি গায়ে চাদর জড়িয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চাচা-ভাতিজা দেখছিলাম এই শহরের যান্ত্রিক মানুষের কিছু অদ্ভুতুড়ে কার্যক্রম। কিছু ফেরিওয়ালার হাঁক ডাকে, জনমানবের সরগোলে, কিংবা শহরের মূর্তিমান ব্যস্ত রাস্তার কোলাহলের আদলে চোখে পড়ছিলো কিছু দুরত্বের ব্যবধানে ক্রিকেট নিয়ে মাতা-মাতিতে ব্যাস্ত সময়ের প্রহর পার করছে এক ঝাঁক তরুনের দল!

এরই মধ্যে ছোট্ট সোনার আবদার চাচ্চু আমিও খেলতে চাই ওদের মতো। আমাকে নিয়ে চলো ওখানে। উত্তরে আমি বললাম না বাবা তুমি বড় হয়ে ডাক্তার হবে, চলো তোমাকে একটা সুন্দর বিজ্ঞানের বই দেই, তুমি সেটা পড়ে বলো কেমন লেগেছে তোমার?

কিন্তু মিষ্টি বায়না তাকে গল্প শোনাতে হবে, সে গল্প যেখানে কেটেছে আমার শৈশব। শোনাতে হবে শৈশবে ঘটে যাওয়া কিছু মজার স্মৃতি। ভাতিজার জেদের কাছে পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা পেতে অনুভবে স্পর্শকাতর হয়ে শুরু করলাম গল্প!

মনোমুগ্ধকর স্নিগ্ধতা পূর্ণ সে বিকালে চক্ষু পাতাদ্বয় যেনো একত্রিত হয়ে আসছিলো কিছু স্মৃতির মূর্ছনায়। একত্রিত হয়ে এসেছিলো শৈশবের কিছুর সোনালী সেই স্মৃতিময় মুহুর্তের নিরব নির্জন এক গহীন ডাকে। যেনো আজ মন চাইছিলো স্মৃতির সিড়িতে খানিকটা সময় হাতড়ে বেড়াতে!

আর তাই চোখের পাতা যেনো কোনো এক অজানায় হারাতে নিস্তব্ধতায় আস্তে করে বন্ধ। মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা তখনো তো ছিলাম ক্রিকেট মাঠের অনস্বীকার্য এক রাজা। সবুজ, শ্যামল কিংবা সোনা ফলা গ্রামে জন্মের পর বড় হওয়ার সাথে সাথে যেনো বেড়ে উঠছিলো ক্রিকেট মাঠের প্রতিটা বিন্দু থেকে কণার সাথে এক নিরব গভীর সখ্যতা! স্মৃতি আজ জানান দিচ্ছে অপরূপ মায়াবতী এবং সবুজের সমারোহে গুণান্বিত ছিলো যে আমার সেই ছোট্ট গ্রাম। যদি বলি সবুজের রাজা, সোনালি ফসলে কৃষকের মুখের সে হাসি ফোটানোর এক অদৃশ্য রাজা, পাহাড় এবং সাদা মটির আস্তাবলে কিংবা অপরূপ নীলাভ আকাশের বুকে মেঘেদের লুকোচুরিতে প্রকাশিত হয় তার সৌন্দর্যের রূপ, তবে বেশি বৈ কম বলা হয়ে যায়!

ছোটবেলার সে কি দুরন্তপনা, যেনো আমি ছিলাম সে পথ - ঘাট কিংবা চির সবুজের আচ্ছাধনের মাঠ-ঘাটের কিংবা নিরব নির্বাক পাহাড়ের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো এক ক্রিকেটের ক্ষুদে ভক্ত; ছোট এই ভক্তের ছোট কর্মপ্রণালী কে সঙ্গ দিতো দুই দেহে একিই আত্বার বন্ধুরা।

স্মৃতি জানান দিয়ে যাচ্ছে সেসময়ের মাঠে কিংবা ছোট দুই পাহাড়ের মাঝে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে ক্রিকেটের মহড়ায় কীভাবে পার করে এসেছি সেসময়। কীভাবে পার করে এসেছি ক্রিকেট মাতোয়ারায় সকালে খেয়ে পুরো দিন অনায়াসে পার করে দিতাম। সে সময় যেনো আড়াল হয়েছে বিদুৎ ঝলাকানোর আলোর ন্যায়। সে বিকট শব্দের চাইতেও যেনো হতশ্রী আজকের দিনের এই কোলাহলময় পরিবেশের সে দূষণ!

সময়ের পরিবর্তনে তখোড় সেই স্মৃতি জানান দিচ্ছে বাড়ির উঠোনে কিংবা এক দাদুর বাড়ির ছোট সে উঠোনের খেলতে গিয়ে বলের আঘাতে বড়ই কিংবা আম ফেলে লুকিয়ে ফেলার দিন সমূহে কে। মনে করিয়ে দিচ্ছে বাদলা দিনে দাদুর পিচ্ছিল উঠোনে ড্রাইভ দিয়ে বকুনি শোনার সে মুহুর্ত গুলো।

স্মৃতি পাতায় খুঁজলে দেখা মিলবে এমন অনেক স্মৃতি! যে স্মৃতি গাঁথা আছে সীমান্তের গাঁ ঘেঁষে ক্রিকেট খেলার কিছু অবিস্মরণীয় মুহুর্ত। মিলবে পাশ্ববর্তী ভার‍তের তুরা উপজেলার সাথে গা ঘেঁষে কাঁটা তারের বেড়ার সংলগ্নে সবুজে ঘেরা ছোট ঠিলার মধ্যে ব্যাটে বলে দাপিয়ে বেড়ানো কিংবা দলের সাফল্যে আত্ব চিৎকারের সেই মুহুর্ত।

আজও মনে পড়ে আমাদের পাড়ায় ছোট্ট সেই অগ্রণী ক্লাবে সদ্য সাদা কালো থেকে রঙিনের দুনিয়ায় উত্তীর্ণ হওয়ার দুনিয়ায় বড় ভাইয়াদের সাথে খেলা দেখার মুহুর্ত গুলো। লাল সবুজের এক একটা জয়ের দিনে আমাদের ছোট্ট সেই ক্লাব যেনো থাকতো সদ্য ঝড় উঠা উত্তাল সমুদ্রের মতো রূঢ় ভাবের প্রতিকীরূপে।

আজও খুব করে মনে পরে রাত্রি বেলা খেলা দেখে বাসায় ফেরাতে আম্মুর সেই বকুনি আর আব্বুর কাছে সব লোকানোর সেই স্বর্ণালি মুহুর্ত। এখনো মনে পড়ে আব্বুর মহড়া ফাঁকি দিয়ে কিভাবে ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছিলাম দিনে কে দিন!

আমাদের সময় বাংলাদেশের একটা জয় ছিলো এক একটা হিমালয় জয়ের কাব্য রচনার সমান! এখন তো বাংলাদেশ হরহামেশাই জিতে কিন্তু তখন বাংলাদেশ সবে শুরু করেছে নিজেদের জাত চেনাতে। শুরু করছে নিজেরদের অস্তিত্বের প্রমাণে জয়ের কাব্য রচনার সূচনা টুকু লিখার প্রয়াসে। এতো পরিমাণ আনন্দিত হইতাম যেনো একেকটা জয় ছিলো আমাদের কাছে বাঁধ ভাঙ্গা খুশির আনন্দ!

আচ্ছা চাচ্চু তুমি কি জানো?
বাংলাদেশের বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে শতক এবং অর্ধশতকের মহড়া ও শুরু হয়েছিলো চাচা-ভাতিজার হাত ধরেই। এখন তো কতো কতো শতক এবং অর্ধশতকের উদযাপনে রঙের দুনিয়ায় মেতে উঠে বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের সময়টায় হঠাৎ ২-১ শতক কিংবা অর্ধশত হতো। কিন্তু শতক কিংবা অর্ধ শতকের আনন্দ ছিলো অন্যরকম। যেনো এক অধরা হাতে পাওয়ার আনন্দে আনন্দিত৷ তবে সেই আনন্দের ধারা ঝর্ণা শুরু টা কিন্তু চাচা ভাতিজা আজাহার হোসেন সান্টু এবং মেহরাব হোসাইন অপির হাত ধরেই!

-আচ্ছা ভাতিজা আমি তোমাকে সেই স্মরণীয় স্মৃতির গল্প শুনাই?
-হ্যা চাচ্চু, শুনাও তো।
-আচ্ছা শোনো, সময়টা ১৯৯০ সাল! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নেমে দলের অন্য ব্যাটসম্যানরা যখন যাওয়া-আসার মিছিলে তখন এক প্রান্ত আগলে রেখে ১২৬ বলে ৫৪ রানের ইনিংস! যা শুধ একটি ইনিংসই ছিলো না, ছিলো একটি ইতিহাস; একটি মহাকাব্য!
-বাহ! দারুণ তো। আচ্ছা চাচ্চু তোমার গল্পটা কি এখানেই শেষ?
-না, আরো একটি মহাকাব্যের গল্প বাকি আছে।
-আচ্ছা শোনাও তাহলে।
-১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল! মাঝখানে কেটে গেলো প্রায় প্রায় ১৫ বছর। কিন্তু বাংলাদেশের একটি জায়গা শূন্য রয়ে গেছে। সেটা ছিলো সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ! তবে ১৯৯৯ সালের ২৫-শে মার্চ ছিলো ইতিহাস বদলানোর দিন। সেদিন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নেমে ১১৬ বলে ৯ চার আর ২ ছক্কায় ১০১ রান করেছিলো মেহরাব হোসেন অপি! সেটি একটি ইতিহাস।
--
এভাবেই অনেকটা সময় কেটে গেলো। হঠাৎ করেই ভাবনার আকাশে ছেদন কাটলো ভাতিজা! ভাতিজার কন্ঠে ভেসে আসছে ‘চাচ্চু এখনো তুমি এখানে দাড়িঁয়ে দাড়িঁয়ে বিড় বিড় করছো! নামাজ পড়বে না? মাগরিবের আজান পড়ে গেছে তো!

ভাতিজার উত্তরে সাড়া দিয়ে চাচ্চু বলে উঠলো তুমি যাও অজু করো আমিও আসছি একসাথে নামাজ পড়বো। এরপর ভাবতে লাগলাম চাইলেও হয়তোবা এই সময় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে তখনো যেমন ক্রিকেটে ভালো লাগা কাজ করতো; এখনো করে, যেনো ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে এমন প্রয়াসে থাকবে না একটুও কার্পন্য। দিন চলে যাবে, বহমান সময়ের মেশিনে সময় বয়েই যাবে তবে ভালোবাসা টুকু বদলাবে না!