• ফুটবল

এক বাংলাদেশির মেসি দর্শন

পোস্টটি ৮৪৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

SAM_0091

২০১১ সালে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল ঢাকায় এলে তাদের সাথে থাকার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল। আজ লিওনেল মেসির জন্মদিনে খুব কাছ থেকে তাকে দেখার সেই মুহূর্তগুলো আবারও পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

[বি: দ্র: এই লেখাটি ২০১১ সালে প্রথম আলো তে প্রকাশিত হয়। ]



দৃশ্য: ১
মাঠে বল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন মেসি! বাড়িয়ে দিলেন তাঁর সেই ট্রেডমার্ক থ্রু! আর তা ধরেই লক্ষ্যভেদ করলেন সুযোগসন্ধানী হিগুয়েইন! গোল!!! চিৎ কার করে উঠলেন কোচ সাবেলা। পাশে দাঁড়িয়ে আমিও!
দৃশ্য: ২
বল পায়ে হঠাৎ ই দৌড় শুরু করলেন মেসি। ছিটকে ফেললেন দুজন মার্কারকে। এরপর পায়ের জাদুতে আরও দুজনকে বোকা বানিয়ে চলে গেলেন একেবারে ফাঁকায়। তাঁর আলতো প্লেসিং শট গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দিলেও ফিরতি বলে গোল করলেন অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া! গোল!!!! চিৎ কার করে উঠলেন কোচ সাবেলা! পাশে দাঁড়িয়ে আমিও!
এ ধরনের দৃশ্য মাঝেমধ্যেই স্বপ্নে দেখি। এর পরের দৃশ্য আসার আগেই ঘুমটা ভেঙে যায়! ৬ সেপ্টেম্বর যখন এই দৃশ্যগুলো সত্যিই ঘটছিল, বারবার মনে হচ্ছিল—হয়তো স্বপ্ন দেখছি, এখনই ঘুমটা ভেঙে যাবে!
কিন্তু এটা তো বাস্তব। সত্যিই ডাগ আউটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি! সারা জীবন টিভিতে যাঁদের খেলা দেখে এসেছি, তাঁরাই খেলছিলেন আমার চোখের সামনে, নিঃশ্বাসের দূরত্বে!
শুরু থেকেই বলি। ঢাকা সফরে আর্জেন্টিনা দলের সহকারী লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে বাফুফে আমাকে নিয়োগ দিয়েছিল। যে দিন এই খবরটা পেলাম, সে দিন থেকেই আমার খুশি বাঁধ মানছিল না। কখন আসবে সেই দিন, কখন দেখতে পাব মেসিকে!
মেসিদের সঙ্গে কয়েকটি দিন কীভাবে কাটিয়েছি, সেটিই এখানে তুলে ধরলাম।

প্রথম দিন: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১
বেলা চারটায় হাজির হলাম বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে। আজ আমাদের ব্রিফিং দেওয়া হবে। গিয়ে দেখি হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নিচতলায় ফ্রি টিকিটের জন্য স্কুলের বাচ্চাদের হইচই। ওপরতলায় চলছে ফ্রি টিকিটের জন্য বড়দের আবদার। বাফুকে কর্মকর্তারা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছেন। এরই মধ্যে খবর এল, আর্জেন্টিনা দলের ছয়জন অগ্রবর্তী প্রতিনিধি কিছু না জানিয়ে হাজির হয়েছেন এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে সোজা স্টেডিয়ামে। এই খবর পাওয়ার পর হাউকাউ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আমি বসে থাকি কখনো এই রুমে তো কখনো ওই রুমে। যাহোক, রাত ১১টায় অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড পেয়ে নেমে পড়লাম কাজে। আমার সহকর্মী, সাবেক জাতীয় ফুটবলার এম এ গাফফারের সঙ্গে বাফুফে ভবন থেকে সোজা চলে গেলাম হোটেল রূপসী বাংলায়। সেখানে গিয়ে পরিচিত হলাম আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বিশেষভাবে আর্জেন্টিনা দলের এজেন্ট রড্রিগোর সঙ্গে। দলটির ৬০ জনের বহরে যে বিরল চার-পাঁচজন মানুষ ইংরেজি (তা-ও ভাঙা ভাঙা) বলতে পারেন, তাঁদের একজন এই রড্রিগো। হোটেল রূপসী বাংলায় নিজের রুমে চেক-ইন করলাম।

দ্বিতীয় দিন: ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১
ঠিক ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল! সকাল ছয়টায় বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম বাফুফে ভবনে। গিয়ে দেখি দুই দলের সব বাস, গাড়ি, কার্গোভ্যান রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল সাড়ে সাতটায় রওনা হলো আমাদের গাড়িবহর। জীবনে এই প্রথম পুলিশ আর র‌্যাবের পাহারায় কোথাও যাচ্ছি—সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এয়ারপোর্টে গিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর খবর পেলাম, আর্জেন্টিনা দলকে বহনকারী বিমানটি ল্যান্ড করেছে। এখনই মেসিরা প্লেন থেকে নামবেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই তো তাঁরা নেমে আসছেন। প্রথমেই এলেন মাচেরানো। ঠিক পেছনেই মেসি! সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। এরপর অনেকক্ষণ আমার হাত ‘শেক’ করছিল এক অদ্ভুত আনন্দে, উত্তেজনায়, রোমাঞ্চে! মেসিরা বাসে উঠে গেলেন, আমি উঠলাম পেছনের গাড়িতে। হোটেলে পৌঁছে মেসিরা সোজা চলে গেলেন তাঁদের জন্য নির্ধারিত রুমে। কিছুক্ষণ পর সবাই নেমে এলেন দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। যত দিন মেসিরা হোটেলে ছিলেন, হোটেল রূপসী বাংলার ‘ভিন্টেজ’ রেস্টুরেন্টটি তাঁদের জন্য রিজার্ভ করা ছিল। তবে তাঁদের সব খাবার রান্না করত দলের সঙ্গে আসা আর্জেন্টাইন শেফ। লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে রেস্টুরেন্টের ভেতরে আমিও বসে ছিলাম। কেননা মেসিরা বের হওয়ার আগেই হোটেলের লবি ক্লিয়ার করার কথা পুলিশকে জানাতে হবে।
মেসিদের সে দিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করার কথা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। অথচ চারটার সময় রড্রিগো এসে হাজির, এখনই ৫০ বোতল গ্যাটোরেড (এক ধরনের এনার্জি ড্রিংক) আর ৫০ বোতল পানি ড্রেসিংরুমের ফ্রিজে রেখে আসতে হবে। পাঁচটার মধ্যে তা ড্রেসিংরুমে সাজিয়ে রাখলাম। আবার রড্রিগোর ফোন। অর্ধেক গ্যাটোরেড আর পানি যেন মাঠে রাখা হয়। তা-ও বরফসহ। আবারও হোটেল থেকে বরফ এনে তাঁদের আইসবক্সে বরফ দিয়ে গ্যাটোরেড আর পানি নিয়ে মাঠে রেখে দিলাম। ঠিক সাড়ে ছয়টার সময় আর্জেন্টিনা দল মাঠে ঢুকল। শুরু হলো প্র্যাকটিস। একটু পরপরই দর্শকদের তুমুল ‘মেসি’-‘মেসি’ ধ্বনি! আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ডাগ আউটের ঠিক পাশেই। কখন কী লাগে, তার তো কোনো ঠিক নেই। প্রচণ্ড গরমে স্যুট পরে থাকায় ঘেমে শেষ। হঠাৎ করেই আর্জেন্টিনার সহকারী কোচ কামিনো আমাকে ইঙ্গিতে বোঝালেন, স্যুট খুলে ডাগ আউটে বসতে। আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা গ্যাটোরেডের বোতল। নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বসে আছি আর্জেন্টিনা দলের ডাগ আউটে! এ-ও কী সম্ভব!


তৃতীয় দিন: ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রেডি হয়ে হোটেলের লবিতে নামলাম। নেমে শুনি আরেক যন্ত্রণা। নিরাপত্তাজনিত কারণে আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়েরা দুপুরের আর রাতের খাবারের জন্য একসঙ্গে নিচে নামতেন। আবার খাওয়া শেষে একসঙ্গে ওপরে যেতেন। কিন্তু সকালের নাশতা দলের সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তাই যাঁর যখন খুশি নাশতা করে যাবেন। অগত্যা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ভিন্টেজে বসে থাকতে হলো। একজন করে যান আর আসেন।
ঠিক একটার সময় রড্রিগো হাজির তাঁর চাহিদাপত্র নিয়ে। আজ লাগবে ১০০ বোতল করে গ্যাটোরেড আর পানি। ড্রেসিংরুমে নাকি ম্যাসাজ টেবিল আছে একটা, আরও একটা লাগবে। লাগবে বড় একটা টেবিল, যেটাতে কাগজপত্র ও ল্যাপটপ রাখা হবে। দেড়টার সময় না খেয়েই স্টেডিয়ামে দে ছুট। সবকিছুর ব্যবস্থা করে হোটেলে ফিরে দেখি, আর্জেন্টিনা দল খেয়েদেয়ে হোটেলের ১১ তলায় টিম মিটিংয়ে ব্যস্ত। তিনটার সময় খবর এল, এখনই আর্জেন্টিনা দলের লাগেজম্যানরা লাগেজ নিয়ে স্টেডিয়ামে চলে যাবে। আমিও সঙ্গে গেলাম। কীভাবে তারা ড্রেসিংরুম রেডি করে, তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়দের জিনিসপত্র নিতে পুরো একটি কাভার্ডভ্যান লেগেছে, শুধু এটা শুনেই আপনারা খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য তিন সেট জার্সি, দুই জোড়া বুট, শেভিং কিটস, বডি স্প্রে, পারফিউম, চুইংগাম...আরও কত কিছু যে রেডি করা থাকে। ড্রেসিংরুমে ওয়্যারলেস স্পিকারে সর্বক্ষণ গানও বাজতে থাকে।
মেসিরা স্টেডিয়ামে এলেন। দল চলে আসার পর ড্রেসিংরুমে বাইরের কারও ঢোকার অনুমতি নেই। আমি চলে এলাম ডাগ আউটের পাশে। যথাসময়ে খেলা শুরু হলো। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। আর্জেন্টিনা দলের ডাগ আউটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি! সব সময় টিভিতে যা দেখেছি, ঠিক সেভাবে হাতে কাগজ-কলম নিয়ে গবেষণা করছেন কোচ ও তাঁর স্টাফরা, গোল হলে খেলোয়াড়দের সঙ্গে ডাগ আউটেও উল্লাস! মাঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম মেসি-ম্যাজিক, দেখলাম আমার প্রাণের দল আর্জেন্টিনার জয়। হোটেলে পৌঁছে খেলোয়াড়েরা সবাই সরাসরি খেতে চলে গেলেন। আর আমার দায়িত্ব পড়ল সব লাগেজ এয়ারপোর্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করার।
সব কাজ শেষ করে বসে আছি হোটেলের লবিতে, আর্জেন্টিনার চলে যাওয়ার অপেক্ষায়। রাত তখন সাড়ে ১১টার মতো। হঠাৎ রড্রিগো আর পার্নেস এসে হাজির। আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে একটু এসো, দরকার আছে।’ ভাবলাম, আবার কোনো নতুন কাজ ধরিয়ে দেবেন হয়তো। কিন্তু না। তাঁরা আমাকে নিয়ে গেলেন ১০ তলায় ১০০৮ নম্বর রুমে। ঢুকে দেখি রুমে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন আধুনিক ফুটবলের অবতার লিওনেল মেসি! আমাকে ঢুকতে দেখে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন। হাত মেলানো শেষে পাশে বসতেও বললেন। এত বড় একজন তারকা, যাঁকে এক পলক দেখার জন্য পুরো বিশ্ব ব্যাকুল হয়ে থাকে, তাঁর কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়ে আমি রীতিমতো অভিভূত! উত্তেজনায় আমার শরীর তখন রীতিমতো কাঁপছে।
পার্নেস আমাকে বললেন, ‘তুমি এই কয় দিন আমাদের জন্য যেভাবে পরিশ্রম করেছ, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তোমার এই পরিশ্রমের কথা মেসিও জানেন। তুমি তাঁর অন্ধ ভক্ত শুনে তিনিই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।’ শুনে মনে হলো, এখনই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। কোনোমতে পকেটে থাকা ক্যামেরা রড্রিগোর হাতে দিয়ে বললাম ছবি তুলে দিতে। আর মেসির দিকে অটোগ্রাফের জন্য বাড়িয়ে দিলাম সঙ্গে থাকা একটি ছবি। ছবি হাতে নিয়ে মেসি আগে সেখানে আমার নাম লিখতে বললেন। লিখে দেওয়ার পর সেই ছবিতেই দিলেন তাঁর সেই মহামূল্য অটোগ্রাফ! এরপর নিজেই দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে ছবি তুললেন। আমি খুশিতে তাঁকে স্প্যানিশে বললাম, ‘TE QUIERO!’ যার অর্থ ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ শুনে মেসি হেসে ফেললেন। আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যারাডোনার জামাতা সার্জিও আগুয়েরো চিৎ কার দিয়ে বললেন, ‘WHY MESSI? WHY NOT ME?’ আমিও তাঁকে ধরে বললাম, ‘TE QUIERO TOO!’ এটা শুনে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘THEN HAVE A PICTURE WITH ME!’ এটা বলে তিনি নিজেই আমার কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুললেন। এরপর রড্রিগোর সাহায্যে মেসি আর আগুয়েরোকে জিজ্ঞেস করলাম, কলকাতা আর ঢাকার মধ্যে কোথায় বেশি ভালো লেগেছে? অকপটে তাঁরা জানিয়ে দিলেন, কলকাতার চেয়ে ঢাকার আয়োজন ছিল অনেক অনেক বেশি সুন্দর। খুশিতে মনটা ভরে গেল। গত দুই দিনের সব কষ্টই সার্থক মনে হচ্ছিল তখন।
অবশেষে তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লিফটের কাছে এলাম। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে পার্নেস আমার হাতে তুলে দিলেন আর্জেন্টিনা দলের প্রায় সব খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ-সংবলিত একটি জার্সি। বললেন, ‘এটা পুরো দলের পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার।’ সেই সময়ের অনুভূতি লেখার অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। কেননা, সেই ভাষা আমার জানা নেই।