• ফুটবল

ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে উদ্ভট ম্যাচ!

পোস্টটি ১৬৭০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ধরুন কোনো ফুটবল ম্যাচের ৮২ মিনিট পেরিয়ে গেছে। আপনার দল এগিয়ে আছে ২-০ গোলে। এমন সময়ে প্রতিপক্ষ একটি গোল শোধ করে বসলো। যাই হোক, এখনো ২-১ গোলে এগিয়ে আপনার দল। সমর্থক হিসেবে কী চাইবেন আপনি? হয় জমাট রক্ষণে বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিক আপনার দল, নয়তো আরেকবার গোল করে খেলাটাকে “কিল অফ” করে খেলুক। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ক্যারিবীয় কাপের একটি ম্যাচে ফুটবলের প্রচলিত নিয়ম-কানুন কিংবা যুক্তি খাটেনি। গ্রেনাডার বিপক্ষে ২-১ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় আত্মঘাতী গোল করে ম্যাচটিকে সমতায় ফেরালো বার্বাডোস। কেন? না না ম্যাচ গড়াপেটার গন্ধ খুঁজতে যাবেন না কিন্তু, বার্বাডিয়ানদের এহেন আচরণের কারণ ছিল টুর্নামেন্টের অদ্ভুত নিয়ম। পরবর্তী পর্বে জায়গা নিশ্চিত করতেই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের জালে বল জড়িয়েছিল বার্বাডোস। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে? সেই ম্যাচের অদ্ভুতুড়ে ঘটনাপ্রবাহের কেবল শুরুটা জানালাম। এবার একটু খোলাসা করা যাক।

 

ক্যারিবীয় সাগরের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্র নিয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ গঠিত হয়েছে। চোখ ধাঁধানো সব সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত দ্বীপগুলো পর্যটকদের কাছে যেমন সমাদৃত, তেমনি আমুদে দিলখোলা স্বভাবের কারণে ক্যারিবীয়দের সুনাম আছে বিশ্বজুড়ে। আর সেখানে খেলাধুলা বলতে আমরা বুঝি ক্রিকেট, সোবার্স-লয়েড-গার্নার-রিচার্ডস-লারাদের সেসব সোনালী দিন যে কোনো ক্রিকেটপ্রেমীকে আবেগতাড়িত করতে বাধ্য। তবে বিশ্বের অন্য যে কোনো অঞ্চলের মতোই ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ফুটবলের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে প্রিমিয়ার লীগ মাতানো ট্রেবলজয়ী ডোয়াইট ইয়র্ক কিন্তু ত্রিনিদাদ থেকেই এসেছেন। কিন্তু কিছুদিন আগে চালু হওয়া কনকাকাফ নেশন্‌স লীগ (CONCACAF Nations League) এর আগে এই ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার সুযোগ বলতে এক বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাই আশির দশকের শুরুতে যখন ক্যারিবিয়ান কাপ টুর্নামেন্ট চালু করার সিদ্ধান্তটি ক্যারিবীয় ফুটবল অঙ্গণে এক ঝলক মুক্তবাতাস হিসেবে এসেছিল। ১৯৯৪ সালে এই টুর্নামেন্টের পঞ্চম আসর ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। মূলপর্বের অংশগ্রহণের আগে প্রত্যেকটি দলকে বাছাইপর্ব খেলে আসতে হবে। রাউন্ড রবিন (প্রতিটি দল অন্যদলের মুখোমুখি হবে একবার করে) পদ্ধতিতে তিনটি দলের গ্রুপ থেকে একটি দল চূড়ান্তপর্বে খেলার সুযোগ পাবে। গ্রূপ-১ এর তিনদল ছিল বার্বাডোস, গ্রানাডা আর পুয়ের্তো রিকো। প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠে বার্বাডোস ০-১ গোলে হেরে গেলো পুয়ের্তো রিকোর কাছে। ভালো কথা, কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হলো জটিলতা। নব্বই দশকের মাঝভাগে ফিফা অতিরিক্ত সময়ে খেলা মীমাংসার নিয়ম নিয়ে বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিল। তাই এই বাছাইপর্বের ম্যাচগুলোর নিয়ম বদলে দেওয়া হলো। আয়োজকদের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ম্যাচই অমীমাংসিত রাখা যাবে না, মানে নির্ধারিত সময়ে স্কোরলাইনে সমতা থাকলে ম্যাচ গড়াবে অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে “গোল্ডেন গোল”- এ নির্ধারিত হবে ম্যাচ। এতেও সমাধান পাওয়া না গেলে টাইব্রেকারের মাধ্যমে জয়ী-পরাজিত নির্ধারণ করা হবে। বেশ সরল নিয়মই তো? মোটেও না।

BarbadosGrenada

গ্রূপের পরবর্তী ম্যাচে গ্রেনাডা বা পুয়ের্তো রিকোর কেউই নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারলো না। অতিরিক্ত সময়ে গোল্ডেন গোলে তিন পয়েন্ট পকেটে পুরল গ্রেনাডা। কিন্তু এ কী? গোল একটা করলেও স্কোরলাইনে যে লেখা গ্রেনাডা ২-০ পুয়ের্তো রিকো? গোল্ডেন গোলের নিয়মে এখানে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল ফিফা। মানে কোনো দল যদি অতিরিক্ত সময়ে গোল্ডেন গোল করে তবে সেটা দুই গোল হিসেবে ধরা হবে, মানে বাস্কেটবলের মতো দুই পয়েন্ট পাবে দলটি । তাই গ্রূপের শেষ ম্যাচ বার্বাডোস-গ্রেনাডার আগে পয়েন্ট টেবিলের চেহারা দাঁড়ালো এরকমঃ

Team Pld W D L GF GA GD Pts
Grenada 1 1 0 0 2 0 +2 3
Puerto Rico 2 1 0 1 1 2 -1 3
Barbados 1 0 0 1 0 1 -1 0

 

মানে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা নিশ্চিত করতে ঘরের মাঠে গ্রেনাডার বিপক্ষে অন্তত দুই গোলের ব্যবধানে জিততে হবে বার্বাডোসকে। তো ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে বার্বাডোস জাতীয় ম্যাচে ফুটবল ইতিহাসে বিরাট হাস্যরসের জন্ম দেওয়া সেই ম্যাচটি মাঠে গড়ালো। ম্যাচের শুরুতেই দুই গোল করে চূড়ান্তপর্বে এক পা দিয়ে রাখল বার্বাডোস। ভালোই চলছিল সবকিছু, কিন্তু ৮৩ মিনিটে গ্রেনাডা এক গোল শোধ করায় বিপদে পড়ে গেলো বার্বাডিয়ানরা। নিজেদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে আরেকটি গোলের জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ করে গেলো বার্বাডোস। কিন্তু বিধি বাম! গ্রেনাডার জমাট রক্ষণের সামনে সুবিধা করা গেলো না। এমন সময়ে দুষ্টবুদ্ধি চাপল বার্বাডিয়ানদের মাথায়। পরিকল্পনাটা ব্যক্তিগত না দলগত ছিলো সেটা জানার উপায় নেই – কিন্তু এরপর যা ঘটল সেটা ফুটবল মাঠে কস্মিনকালেও দেখেনি কেউ। বার্বাডোস উপলব্ধি করলো এখন যদি একটি আত্মঘাতী গোল দিয়ে ম্যাচটিকে অতিরিক্ত সময়ে নেওয়া যায় তবে তখন গোল্ডেন গোল করে ৪-২ ব্যবধানে ম্যাচ জেতা যাবে। কাজে লেগে পড়ল তারা। ৮৭ মিনিটে বার্বাডিয়ান পেনাল্টি বক্সে ডিফেন্ডার টেরি সিলি আর গোলরক্ষক হোরেস স্টাউট নিজেদের মধ্যে পাস চালাচালি করে কিছুটা সময় নষ্ট করলেন। এরপর সিলি জোরসে কিক করে নিজেদের জালে বল পাঠালেন। মিশন অ্যাকমপ্লিশ্‌ড! তবে সেদিন গাঁটের পয়সা খরচ করে খেলা দেখতে আশা দর্শকেরা কিন্তু তখনো নাটকের মূল অঙ্ক দেখেনি। বার্বাডিয়ানদের দুরভিসন্ধি বুঝতে মিনিটখানেক সময় লাগলো গ্রেনাডিয়ানদের। এবার তাদের পালা। যে কোনো প্রান্তের জালে বল জড়ালেই চূড়ান্তে পর্বে চলে যাবে গ্রেনাডা- এমন পরিস্থিতিতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। আত্মঘাতী গোলের পর কিক-অফের মাধ্যমে খেলা পুনরায় শুরু হতেই গ্রেনাডার ছয়জন খেলোয়াড় দৌড়ে গ্রেনাডিয়ান বক্সে ঢুকে পড়লো। উদ্দেশ্য আত্মঘাতী গোল রোখা। সিলিসহ আরো চারজন থাকলেন নিজেদের অর্ধে, গোলরক্ষককে সাথে নিয়ে গ্রেনাডার আক্রমণ ঠেকাবেন। উদ্ভ্রান্ত গ্রেনাডার খেলোয়াড়েরা একবার নিজেদের জালে তো পরেরবার প্রতিপক্ষের জালে বল ঢোকানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। এইরকম এলোপাতাড়ি ফুটবলে নিশ্চয়ই গ্যালারিতে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিলো। ওদিকে “আক্রমণ” ও “প্রতি আক্রমণ”-এ জমে উঠেছে ম্যাচ, "গোল" কিংবা "আত্মঘাতী গোল" এর খোঁজে গ্রেনাডিয়ানরা। কিন্তু মাঠের কোনো প্রান্তেই “গোল” করতে পারলো গ্রেনাডা। রেফারির বাঁশিতে খেলা গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে। শেষমেশ বার্বাডোসের ট্রেভর থর্ন গোল করে ফুটবল ম্যাচের নামে চলা প্রহসনের সমাপ্তি টানলেন। ৪-২ গোলে জয়ী বার্বাডোস!

 

ম্যাচশেষে গ্রেনাডার কোচ জেমস ক্লার্কসন যে ক্ষেপে যাবেন সেটা অনুমিতই ছিল। নিজেদেরকে “প্রতারণার শিকার” দাবি করে যার মস্তিষ্ক থেকে এমন অদ্ভুত নিয়ম বেরিয়েছে তাকে পাগলাগারদে পুরে রাখার আহবান জানালেন। বার্বাডোসের অবশ্য কোনো শাস্তি হলো না, তারা আর যাই হোক খেলার কোনো নিয়ম ভঙ্গ করেনি। চূড়ান্তপর্বে “গোল্ডেন গোল” এর নিয়ম বাতিল করেছিল ফিফা, এমন ঘটনা একবার ঘটাই যথেষ্ট। তবে বাতিল করার আগে “দুই পয়েন্ট” এর গোল্ডেন গোল যে পাগলাটে ম্যাচ উপহার দিয়েছে সেটা হয়তো আর কখনো দেখা যাবে না। আসলে একটি দল মরিয়া হয়ে নিজের জালে বল ঢোকাতে চাচ্ছে – এমন দৃশ্য বোধহয় শুধু ভিডিও গেমেই মানায়, বাস্তবে নয়।