• ফুটবল

ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে

পোস্টটি ১৭৩৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সত্তর আর আশির দশক আমাকে দুহাত ভরে দেয় । এগারোটা লীগের দেখা পাই। চারটা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ আমার সৌকর্য বাড়ায়। সে আমলে আমার ডাগআউটে তিনজন কোচ আসলেন। প্রথমে বব পেইজলি, তারপর জো ফ্যাগান, এরপর কেনি ডালগ্লিশ। তিনজনই এল, দেখল, জয় করল। কিন্তু এরপর। এরপর আর বলতে গেলে কিছুই না। এরপর আমার প্রতাপ মিইয়ে যায়। কোথায় না কোথায় যেন ফাঁকটা থেকে যায়।

কেনি ডালগ্লিশের হাত ধরে ১৯৮৯-১৯৯০ মৌসুমে আমার বুকে আঠারবারের মত বিজয়নৃত্য হয়। পরের মৌসুমে উনিশতমবারের জন্য মঞ্চ সাজিয়ে রেখেছিলাম। মৌসুমের মাঝে ডালগ্লিশ ব্যক্তিগত কারণে ছয় বছরের সম্পর্কের ইতি টানল। এরপর নিয়মিত হলেন আরেক স্কটিশ গ্রায়েম সাউনেস। সে মৌসুম আর্সেনালের পিছনে দ্বিতীয় হওয়া যায়। কিন্ত এরপর যেন এক ঝটকায় সব এলোমেলো। এই লিভারপুলকে তো গত বিশ বছর আমি দেখি নি। সাউনেস দলটাকে ঢেলে সাজালো। জেমি রেডন্যাপ, স্টিভ ম্যাকমানাম্যান মিডফিল্ডে আনল। কিন্তু তবু পরপর দু'বার ষষ্ঠ আর পরেরবার অষ্টম হবার ধাক্কা সারানো গেল না। রয় ইভান এল দীর্ঘ সময়ের জন্য । এ সময় আবার ইংলিশ ফুটবল আরেক যুগে পা দিল। প্রিমিয়ার লীগ যুগ। লিভারপুলও আসল নতুন এক সময়ে। প্রতিটা দিন যেত আর আমি চাইতাম এ সময় যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়। তরুণ রবি ফাউলার আর অভিজ্ঞ ইয়ান রাশের জুটি এবং মাঝমাঠে ম্যাকমানাম্যান-রেডন্যাপ জুটি যে মঞ্চ সাজিয়ে রেখেছিলাম তা রাঙানোর স্বপ্ন দেখালো । ৯৬-৯৭ মৌসুমে অর্ধেক মৌসুম শীর্ষেই ছিলাম । কিন্তু শেষটায় আর হল না।

ইয়ান রাশ মাঝখানে চলে গেল। তার জায়গা নিল আরেক তরুণ মাইকেল ওয়েন। আবারো নতুন করে স্বপ্ন বোনা শুরু। প্রতি মৌসুমেই অনেকটা জুড়ে শিরোপার দৌড়ে থাকা হত। কিন্তু শেষে গিয়ে ইউনাইটেড আর আর্সেনাল একটু বেশিই অসাধারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেষটায় আর পারা হত না। আর্সেন ওয়েঙ্গার আর অ্যালেক্স ফার্গুসন ইংলিশ ফুটবলের নতুন যুগ বা প্রিমিয়ার লিগে যে দিনবদল আনে তার সাথে কোনোমতেই তাল মেলানো যাচ্ছিল না।

গিলবার্ট হুলিয়ার ছয় বছর ক্লাবের দায়িত্বে থাকল। ওয়েন, ফাউলার, জেরার্ড, হিপিয়া, ক্যারেঘারদের নিয়ে লিভারপুলের অন্যতম সেরা দল গঠন করল। একটা ইউরোপিয়ান কাপও আসল আমার কাছে। ২০০১-২০০২ মৌসুমে আবারো প্রিমিয়ার লীগ শিরোপার অনেক কাছাকাছি চলে যাই। কিন্তু চার পয়েন্টের জন্য আবারো আমার সেই মঞ্চ খালি পড়ে থাকে।

ছয় বছরের পাট চুকিয়ে হুলিয়ার চলে গেল। অসল বেনিতেজ। দেড় দশক ধরে অপেক্ষা করে আছি প্রিমিয়ার লীগ শিরোপার। বেনিতেজ প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লীগ উপহার দিল। এবার তাহলে অপেক্ষা ফুরোচ্ছে। কিন্তু আসি আসি করেও আর এল না। আলোনসো, আরবেলোয়া, তোরেস, জেরার্ডরা মিলে আরো একবার চেষ্টা করল ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে। কিন্তু এক রাশিয়ান স্নাইপারের ( আন্দ্রেই আরশাভিন) চারটা গুলি আমাকে এবং আমার মধ্যে থাকা চল্লিশ হাজার ভক্তকে আরো একবার ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে যায়। আবারো চার পয়েন্টের জন্য ইউনাইটেডের কাছে শিরোপা খোয়াই। ছয় বছর শেষে বেনিতেজও চলে যায়। বিশ বছর হল আমি উনিশতম উদযাপনের মঞ্চ সাজিয়ে রেখেছি।

শেষে আবার যার হাত ধরে শেষবার লীগ পেলাম সেই ডালগ্লিশের কাছেও ফিরে গেলাম। কিন্তু বেনিতেজ যাওয়ার পর আমরা ইউরোপে খেলতে যাবারও সামর্থ্য হারালাম। লিভারপুল এক স্মৃতি। আমি এক মিথ হয়ে রইলাম। সেই ফাউলার, ওয়েন, হিপিয়া, আলোনসো, আরবেলোয়া, তোরেস, ক্যারেঘার সবাই চলে গেল। জেরার্ড কেন যেন থেকে গেল। সেও হয়তো আমার মতো তার বুকের কোণে একটি মঞ্চ সাজিয়ে রেখেছিল।

ডালগ্লিশের পর আসল ব্রেন্ডন রজার্স। সাথে নিয়ে আসল স্টারিজ, কৌতিনহো, সুয়ারেজ, স্টার্লিংদের। রজার্সের প্রথম মৌসুম ফিকে । পরের মৌসুম দুর্দান্ত । সুয়ারেজ, স্টার্লিং, স্টারিজ, কৌতিনহোদের আক্রমণে ভর করে অনেকদূর এগোলাম। ৩৫ ম্যাচ পর্যন্ত আমরা শীর্ষে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিটিকে হারিয়ে জেরার্ড সবাইকে এক করে বলল " দিস ডাজ নট স্লিপ নাও "। কিন্তু এরপরেই যখন চেলসির সাথে খেলায় হয় আমি এক ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়ে থাকলাম। এরপরের ম্যাচে ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে তিন গোলের লিডও ছুড়ে ফেলে আসল তারা। আর সাথে ছুড়ে ফেলে দিল আমার তিল তিল করে দেখা পঁচিশ বছরের স্বপ্ন ।

এরপর ক্লপ আসল। এখন জেরার্ডও নেই। নেই সুয়ারেজ, স্টার্লিং, স্টারিজও। কৌতিনহো ছিল কিন্তু সেও চলে গেল। এখন স্বপ্ন দেখতেও ভয় করত। কিন্তু ক্লপ দেখালেন। নতুন করে সাজল লিভারপুল সালাহ, মানে, ফিরমিনো, ভ্যান ডাইক, আরনল্ড, রবার্টসন, অ্যালিসন দিয়ে । ২০১৮-২০১৯ মৌসুম। ত্রিশ ম্যাচ পর্যন্ত আমরা শীর্ষে । মৌসুম শেষে ৯৭ পয়েন্টে লীগ শেষ করলাম। প্রিমিয়ার লীগ ইতাহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। কিন্তু তাও সেই খালি হাতেই থাকলাম আমি।

এবার হয়তো নিয়তিটাকেই মেনে নিয়েছি। যেমনটা মেনে নিয়েছিল আমার গ্যালারি মাতিয়ে রাখা ৫৫ হাজার ভক্ত। ত্রিশটি বছর হয়ে গেল। তারা তাদের সমর্থনে কখনো ফাঁকি দেয়নি। দ্বিতীয় হোক বা অষ্টম তাদের সেই উন্মাদনা একই ছিল। চোখের সামনে দিয়ে তারা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইউনাইটেডকে এগারোবার শিরোপা ঘরে তুলতে দেখল। আর্সেনালকেও দেখল পাঁচবার ঘরে তুলতে। ব্ল্যাকবার্নও একবার শিরোপা উদযাপন করল। নতুন নতুন সমৃদ্ধ হওয়া চেলসি আর সিটিও চারবার উদযাপন করল। কিন্তু তাদের সময় আর এল না। এভান, হুলিয়ার, বেনিতেজ, রজার্স সবাই স্বপ্ন দেখিয়ে শেষে তাদের কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন। ফাউলার, ওয়েন, ম্যাকমানাম্যান, রেডন্যাপ, রাশ, জেরার্ড, হিপিয়া, ক্যারেঘার, আলোনসো, আরবেলোয়া, তোরেস, সুয়ারেজ, স্টার্লিং, কৌতিনহো একে একে সবাই চলে গেল। একটা শূণ্যতা তাদের মাঝে ঠিকই রয়ে গেল। দুই-তিন প্রজন্ম আমার সাথে থেকে পথ চেয়ে রইল প্রিমিয়ার লিগের স্বপ্নে বিভোর হয়ে । প্রৌঢ়দের বলতে শুনতাম জীবন শেষ হবার লিভারপুলের হাতে একটা লিগ দেখতে চাই। ১৯৯০ এ যারা শেষবার তা দেখেছিলেন তারা অনেকেই তাদের স্বপ্নপূরণ হবার আগেই অন্যলোকে পাড়ি জমান। যারা দেখেননি তারা অনেকেই প্রথমবারের মতো এই উদযাপনের সাক্ষী হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুণেন । যারাও দেখেও দেখতে পারেনি, ভেবেছিল পরেরবার যাব তারা ত্রিশবছর ধরে পরেরবারের আশায় প্রহর গুণছিল। কিন্তু ২০১৮-২০১৯ এর পর হয়তো আর কারোর কোনো স্বপ্ন দেখার সাহস রইল না। এত কাছে গিয়েও এত দূর পাহাড়ের ধারে তাকানোর শক্তি কারোর আর ছিল না। আরো একবার আমি সবার চোখের জলের সাক্ষী হয়ে রইলাম । এই ত্রিশ বছরের ক্ষরা এই চোখের পানিগুলো দিয়েই ভিজিয়ে রেখেছি।

কিন্তু পরেরবার আসলেও সুযোগ হল। ২৮ ম্যাচ শেষে পঁচিশ পয়েন্টের ব্যবধানে শীর্ষে। ক্লপ প্রমাণ করতে চলেছেন 'কেউ কেউ কথা রাখে'। কিন্তু আবার এ সময় করোনার আঘাত। লীগ বন্ধ হবার গুঞ্জন । আবারো সেই দূর আকাশের তারা হবার পথে আমার প্রিমিয়ার লীগ স্বপ্ন । কিন্তু পরে ঠিকই লীগ চলার সিদ্ধান্ত হল। ত্রিশ বছর ধরে যে মঞ্চ আমি সাজিয়ে রেখেছি তা এবার পূর্ণতা পাবে।
অবশেষে গত ২২শে জুলাই ইয়ুর্গেন ক্লপ আর জর্ডান হেন্ডারসনের হাত ধরে উনিশতমবারের মতো আমার বুকে বিজয়নৃত্য হল।

জি পাঠক ঠিকই ধরেছেন। আমি অ্যানফিল্ড বলছি । গত ত্রিশ বছর এরকম অসংখ্য দুঃখ-হাসি-কান্না আমি সয়ে এসেছি । কিন্তু কখনো আমি একা ছিলাম না। আমার মঞ্চটা খালি পড়েছিল। কিন্তু গ্যালারী সে অভাব বুঝতে দেয় নি। আজ অবশেষে সে মঞ্চটা যখন ভরে উঠল তখন আমার গ্যালারীতে শুধুই শূণ্যতা। এত হাসি-কান্না যাদের সাথে ভাগ করে নিলাম আজ এ খুশির দিনে তাদের কাউকেই পেলাম না। কিন্তু যাই হোক। অবশেষে খরা থেকে মুক্তি তো পেলাম