• ক্রিকেট

বাঁ হাতেই বাজিমাত

পোস্টটি ৫১৬৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ব্যাটিং শৈলী,আগ্রাসন,প্রতিভা এই তিনের সমন্বিত এক বিশেষ নাম তামিম ইকবাল।বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব।প্রতিভাবান ও আক্রমণাত্মক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ২০০৭ সালে ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার যাত্রা শুরু করে।এরপর এক এক করে T20,টেস্টে অভিষেক ঘটে তার।ইনিংসের শুরুতে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের দৌলতে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে।সেইসাথে সমর্থকদের কাছে সনৎ জয়সুরিয়ার সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে।

তামিম ইকবালের রক্তে ক্রিকেট মিশে রয়েছে। ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামের এক ক্রিকেটীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। তামিমের চাচা সাবেক বাংলাদেশি অধিনায়ক আকরাম খান।তাই ক্রিকেটার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়েই তার জন্ম।পরিবারে সম্পূর্ণ ক্রিকেটীয় আবহ সেখানে ক্রিকেটার না হয়ে অন্যকিছু হওয়াটাই আশ্চর্যজনক।ভাই নাফিস ইকবাল সেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে।।তাই স্বাভাবিক ভাবেই ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণার অভাব ছিল না।তদুপরি ছেলেদের ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তামিমের বাবার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তার বাবা স্থানীয়ভাবে ছোট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করত।

২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে চট্টগ্রামের হয়ে তামিমের অভিষেক। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজ দলের হয়ে ধারাবাহিকভাবে রান করে জাতীয় দল নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে।২০০৬ সালের অনুর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেয়।মাত্র সতের বছরের তামিম চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী শিরোনামে উঠে আসে।আত্নবিশ্বাসে ভরপুর ব্যাটিং দিয়ে অনুর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপ মাতিয়ে তোলে।শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার দুর্ধর্ষ ব্যাটিং আজও স্মরণীয়।তার মাত্র ৭১ বলে ১১২ রানের ইনিংসে বাংলাদেশ জয়ী হয়।তার এই অসাধারণ ব্যাটিং বিফলে যায়নি।দ্রুতই জাতীয় দলে জায়গা পেয়ে যায়।

ব্যাটিং দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছিল ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওডিআই অভিষেক হয় তামিমের।যদিও সেই ম্যাচে মাত্র ৭ রান করতে পেরেছিল।কিন্তু নির্বাচকদের আস্থা ছিল তামিমের প্রতিভার উপর।আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে সফল হওয়ার যাবতীয় রসদ তার ভেতরে ছিল বিধায় মাত্র দুটি ওয়ানডে খেলার পরে তাকে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে দেন নির্বাচকরা।এরপরের ইতিহাস তো কারও অজনা নয়।প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই নেমেই ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে হৈ চৈ ফেলে দেয় তামিম।ফেভারিট ভারতের বিপক্ষে ৫১ রান করে।তার সেই অর্ধশত ভারতকে সেই বিশ্বকাপের প্ৰথম রাউন্ড থেকে ছিটকে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল।এরপর থেকে তামিমের শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পালা।নির্বাচকরা আত্নবিশ্বাসে ভরপুর তামিমকে দ্রুত টেস্ট দলে জায়গা করে দেন।২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক।ডুনেডিন টেস্টে সে উভয় ইনিংসেই হাফ সেঞ্চুরি করেছিল।তার দুর্দান্ত অভিষেকটি ওপেনার হিসাবে খ্যাতি আরও বাড়িয়ে তোলে এবং বিশ্ব ক্রিকেটে এক উদীয়মান তারকা হিসেবে নজর কাড়তে শুরু করে।২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে তার প্রথম সেঞ্চুরিটি এসেছিল।তার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ তাদের প্রথম বিদেশের মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায়।

বাংলাদেশ দলে অনেক স্টাইলিশ স্ট্রোকমেকার রয়েছে। তবে একদম পুরোপুরি আক্রমনাত্মক ব্যাটসম্যান নেই বললেই চলে।তাই তামিমের মত আপাদমস্তক আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। আর তাছাড়া T20 এর যুগে কিশোর ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রথম পছন্দ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং।সে যখন পুরো আক্রমণাত্মক মেজাজে ব্যাট করে সেদিন সেরা পেসারদের ভুল করতে বাধ্য করে।উইকেটের চারিদিকে তার দৃষ্টিনন্দন শর্টগুলো আছড়ে পড়তে থেকে সীমানার ওপারে।এমন ভয় ডরহীন এক ক্রিকেটার সব দেশেরই পরমাকাঙ্ক্ষিত।তামিম ইকবাল মানে মার মার কাট কাট ধরনের এক ক্রিকেটার।যার কাছে কোন বোলারই ভীতি জাগানিয়া নয়।বোলার যেই হোক না কেন বলটাকে মাঠের বাইরে পাঠানোই পারলেই যেন শান্তি তামিমের।ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এমন দাপুটে ভঙ্গিমায় ব্যাটিং করতে থাকা তামিম ইকবাল এখন বেশি পরিপক্ব।এখন তার ব্যাটে অভিজ্ঞতার ছাপ।সেই সাথে যতই দিন যাচ্ছে, তার ব্যাটের তীক্ষ্ণতা ততই বাড়ছে,বাড়ছে রানের খিদেও। নিজের রেকর্ডের খাতাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলছে।আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরুর দিকে যেভাবে উইকেট বিলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ছিল সেখান থেকে নিজেকে অনেক বদলে ফেলেছে।আগের তুলনায় অনেক সংযত তামিম নিজের উইকেটের মূল্যটা অনুধাবন করতে পেরেছে।যারফলে অতীতে ঝড়ো অর্ধশত রান করলেই তাকে তৃপ্ত দেখাত।কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শতরানের পরেও আজে বাজে শর্ট খেলে আউট হয়ে আসার দৃশ্য দেখা যায় না।দলের প্রয়োজনে এখন ইনিংসের শুরু থেকেই খেলে চলে ঠান্ডা মাথায়।আর দলকে এনে দেন শক্ত এক ভিত্তি।এখন আর অযথাই মার মার কাট কাট ব্যাটিং করে বোলারকে উইকেট উপহার দেয় না।বরং সময় আর সুযোগ বুঝে ঠিকই জ্বলে উঠেন।ইনিংসের শুরুতে ধীরলয়ে খেললেও শেষের দিকে তার স্বভাবসুলভ অগ্রাসী ব্যাটিং রানের ঘাটতি ঠিক পুষিয়ে নেয়।প্রতিপক্ষ বোলারের ভাল বলকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া আর খারাপ বল থেকে সর্বাধিক ফায়দা লুটে নেওয়া যেন এখন তামিমের ব্যাটিংয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।এরফলে দেশের পাশাপাশি লাভবান হচ্ছেন তামিম নিজেও।রানের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার ব্যাটিং গড়।গত দুই বছরে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে রানের গড়ে তামিম সবার চাইতে এগিয়ে।রোহিত শর্মা, ডেভিড ওয়ার্নার এদের বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানদের পেছনে ফেলে সামনে চলা নিশ্চয় বিরাট অর্জন। ইতোমধ্যেই দেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হওয়া তামিম ইকবাল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এখন বেশ আলোচিত একজন ব্যাটসম্যান।

তামিমের ক্যারিয়ার গত ১৩ বছর ধরে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তার ব্যাট নিজের প্রতিভার পক্ষে কথা বলছে।সে এক পুরো উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান।বিশ্বের অনেক ওপেনার পেসের বিপক্ষে দুর্দান্ত তবে স্পিনের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ।কিন্তু তামিম পেস-স্পিন বোলিংয়ে সমান আধিপত্য বিস্তার করে রান করে যেতে পারে।যে কোনও বোলিং আক্রমণকে তছনছ করে দিতে পারে তার ব্যাট।সেরা ব্যাটসম্যানদের অন্যতম গুন সব ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সেরাটা উপহার দেয়া।সে বিষয়েও তামিম সিদ্ধহস্ত।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে কোন পরিস্থিতিতে রান করতে পারে।উপমহাদেশের বাহিরে ইংল্যান্ড,নিউজিল্যান্ড,ওয়েস্ট ইন্ডিজেও সফল।একজন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে ইংল্যান্ড,নিউজিল্যান্ডের মত পিচে সফল হওয়াটা অবশ্যই বিরাট ব্যাপার।তামিম নতুন ও পুরানো বল সমানভাবে মোকাবেলা করতে পারে।এসব গুণাবলীর জন্য সে আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান।

বাংলাদেশের হয়ে T20 ক্রিকেটে একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান তামিম।তবে প্রায়শই সমর্থকদের বলতে শোনা যায় খেলোয়াড়ি জীবনে এত অর্জনের পরেও এখনও সে তার প্রতিভা অনুযায়ী প্রশংসা পায় না।কিংবা আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো তার দুরন্ত ইনিংসগুলোকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারে আনে না।সাকিব, মুশফিকদের থেকে পরে ক্যারিয়ার শুরু করেও রানের দিকে তামিম এগিয়ে থাকলেও তাদের মত প্রচারে আসতে পারে না।এমনকি নবীন তারকা মুস্তাফিজ তার থেকে বেশি চর্চিত।আবার অনেক ক্রিকেট সমালোচকের মতে তামিম তার প্রতিভার যথাযথ স্ফুরণ ঘটাতে পারেনি।আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে তার সম্পর্কে underachiever শব্দটি প্রায়শই ব্যবহার করে থাকে।অর্থাৎ তার ব্যাটিং প্রতিভাকে যে উচ্চতা দেয়া হয়েছে তার তুলনায় তামিমের অর্জন নিতান্তই কম।আবার আরেক দল মনে করে সে আরও প্রশংসার দাবীদার।কারন নিকট অতীতে বাংলাদেশের সাফল্যে তামিমের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।এটা সত্য যে দেশের অন্যান্য সেরা ব্যাটসম্যানদের তুলনায় সে অনেক কম মূল্যায়িত।

বটবৃক্ষ যেমন সময়ের পরিক্রমায় দৃঢ় হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি তামিম ক্রিকেটে এক যুগ পার করে দলে তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।এখন সেই দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।নিজের খেলার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সেরা থেকে বিশ্ব সেরা হয়ে ওঠার পর্যাপ্ত প্রতিভা রয়েছে এটা সে দেখিয়েছে।ক্রিকেট প্রেমীরা প্রতিভাবান তামিম থেকে কিংবদন্তী তামিমকে দেখার অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় দিন গুনছে।

 

 

 

Cover image courtesy: www.zimbio.com