• ফুটবল

রসির সেই ৬৯ মিনিট

পোস্টটি ১৮৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

খলনায়ক থেকে নায়ক বনতে কতটুকু সময় লাগে একজন মানুষের? উপমহাদেশ বা পাশ্চাত্যের হাজার হাজার সিনেমা আছে যেখানে নায়ক একাই সমাজকে উদ্ধার করেন, অন্যদিকে ভিলেন কাজ হয় পাপের পাহাড় গড়ে তোলা, নায়কের ভালোমানুষি যেন সহ্য হয় না তাদের - বারবার অপদস্ত আর শায়েস্তা করার নানান রকম ফন্দি আঁটেন তারা। কখনো কখনো হয়তো খলনায়ক একদম শেষে পুণ্যের কাজ করে পাপমোচন করার চেষ্টা করেন। ইতালিবাসীর কাছে নায়ক হতে পাওলো রসির অবশ্য মোটে লেগেছিল ৬৯ মিনিট। অথচ বিশ্বকাপের বিমানে চড়ার কথাই না ইয়ুভেন্তাস স্ট্রাইকারের। আশির দশকের শুরুতে ম্যাচ গড়াপেটা কেলেঙ্কারি “তোতোনেরো” এর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ রসির উপর আস্থা রেখেছিলেন এঞ্জো বেরজো, মোক্ষম সময়েই তাঁর প্রতিদান দিয়েছিলেন রসি। হ্যাট্ট্রিক করে ফেবারিট ব্রাজিলকে ছিটকে ফেলছেন এক অপরাধী – লোমহর্ষক রোমাঞ্চ গল্পেও এমন “টুইস্ট” মেলা ভার।

Paolo_Rossi_Vicenza

১৯৫৬ সালে মধ্য ইতালির ঐতিহ্যবাহী প্রাতো শহরে জন্ম পাওলো রসির। একহারা গড়নের রসির শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার লোকের অভাব ছিলো না। প্রথম ক্লাব ইয়ুভেন্তাসের স্কোয়াডে ১৯৭২-৭৫ সাল কেটেছে রসির, স্কোয়াড না বলে বরং ট্রিটমেন্ট টেবিল আর বেঞ্চে সময় কেটেছে বললেই সেটা বেশি সুক্তিযুক্ত হবে। এরপর ধারে সেরি আ এর আরেক টিম কোমোর হয়ে খেলতে গেলেন আঠারো বছরের তরুণ। জগদ্বিখ্যাত লেকের শহরে এসেও অবশ্য ভাগ্য ফেরাতে পারলেন না, লিগে মাত্র ছয়বার মাঠে নামতে পারলেন, কোমোও অবনমিত হয়ে গেলো সেরি বি’তে। সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া ক্লাবের মতো রসিরও ঠিকানা হলো সিরি বি, তবে কোমো নয় ভিসেঞ্জা অর্ধেক মালিকানা নিলো রসির। অভিজ্ঞ কোচ জিওভান ফাব্রির পাকা জহুরির চোখ খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করেনি, রাইট উইং থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে রসিকে সরিয়ে আনতেই গোলের তুবড়ি ছোটালেন “পাবলিতো”। আগের মৌসুমে অবনমন থেকে কোনোমতে বাঁচা ভিসেঞ্জা এবার সেরি বি চ্যাম্পিয়ন, মজার ব্যাপার শেষদিনে লিগ নিশ্চিত হলো সেই কোমোর মাঠেই। ২১ গোল করে লিগের শীর্ষ গোলদাতা রসি, কিন্তু সেরি আ’তে গিয়ে কি নতুন চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারবেন। আলবত, ২৪ গোল করে “কাপোকান্নোনিয়েরে” এর পুরষ্কার জিতে নিলেন পাওলো রসি, ইতালীয় ফুটবলে তাঁর আগে বা পরে আর কেউ টানা দুই মৌসুমে শীর্ষ দুই বিভাগে সেরা গোলদাতার পুরষ্কার জিততে পারেনি। ইয়ুভেন্তাসের পেছনে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে ১৯৭৭-৭৮ লিগ মৌসুম শেষ করলো ভিসেঞ্জা। ফলাফল এঞ্জো বেরজোর ডাকে মেক্সিকোতে ইতালির আক্রমণের গুরুদায়িত্ব পড়ল রসির কাঁধে। ফ্রান্স, হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে একটি করে গোল করে সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করলেন রসি। কিন্তু অলিখিত সেমিফাইনালে ডাচরা থামিয়ে দিলো বেরজোর দলের স্বপ্নযাত্রা। ক্লাবে ফিরে পরের মৌসুমে ১৫ বার জাল খুঁজে পেলেন রসি, কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে অবনমিত হলো ভিসেঞ্জা। লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে রসির দোরগোড়ায় হাজির হলো নাপোলি, কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে পেরুজাতে ধারে খেলতে গেলেন ইতালিয়ান “হটকেক”।

 

স্বররগ থেকে পতনের সেখানেই শুরু। ১৯৭৯-৮০  মৌসুমে ১৩ গোল করলেন রসি, কিন্তু মাঠের খেলাটা গৌণ হয়ে পড়ল হঠাৎই। রোমের দুই দোকানদারের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে দেখা গেলো ইতালির প্রথম বিভাগ জুয়াড়িদের কাছে জিম্মি। ৩৩ জন ফুটবলার, তিন ক্লাবের সভাপতি আর ২ জন জুয়াড়ির শাস্তি হলো। রসিকে ৩ বছরের জন্য সব ধরণের ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হলো। এই ঘটনার আগে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন রসি, পাতলা-দুবলা শরীর নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে চুরমার করে দিতেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর থেকে সেই তিনিই নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিলেন। “৮০ এর ইউরো মিস হয়ে গেলো, তবে জাতীয় দলে তার বিকল্প খুঁজে না পেয়ে নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে ফেললো বোর্ড। বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে ইয়ুভেন্তাসের হয়ে মাঠে ফিরলেন রসি, লিগে তিন ম্যাচে ১ গোল করলেন, স্কুদেত্তো গেলো বিয়াঙ্কোনেরিদের ঘরে। এঞ্জো বেরজো দূর থেকে সব দেখছিলেন, জাতীয় দলের কোচের কল কিন্তু ঠিকই পেলেন পাওলো রসি। ম্যাচ পাতানো খলনায়ক যাবে বিশ্বকাপে, ইতালি কিংবা ইতালির বাইরে সন্দেহবাদীর অভাব ছিল না। আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছিলেন রসি নিজেও, “আপনারা আমাকে ইতালিয়ান ফুটবলের ত্রাতা ভাববেন না। পেলের মতো খেলোয়াড়ের পক্ষেই কেবল সম্ভব একা পুরো দলের চেহারা বদলে দেওয়া,“ ১৪ জুন পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে রসির সরল স্বীকারোক্তি। গ্রুপপর্বে  দুই বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বেহাল দশা, তিন ম্যাচ খেলে কোনোটাতেই জিতে পারলো না “আজ্জুরি”রা। তিন ড্র-এ তিন পয়েন্ট নিয়ে পোল্যান্ডের পেছনে থেকে কোনোমতে দ্বিতীয় গ্রুপপর্বে জায়গা করে নিলো বেরজোর দল। ২ ম্যাচে মাত্র দুটো গোল করা আক্রমণভাগকে নিয়ে যে সমালোচনা হবে সেটাই স্বাভাবিক। রসিকে আনফিট দেখাচ্ছিল, মাঠে তাঁর খেলা দেখে যে কারো মনে হতে পারে হয়তো রেফারির বাঁশির ১০ মিনিট আগে ফুটবল খেলা শিখেছেন তিনি। সংবাদমাধ্যমের ওজর-আপত্তির মুখেও রসিকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে একাদশে রাখলেন বেরজো। রসি গোল পেলেন না, কিন্তু ম্যারাদোনার দলকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিলো ইতালি। পরের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, যুগে যুগে এতো তারকার মুখদর্শন হলেও অনেকের মতেই জিকো, ফ্যাল্কাও, সক্রেতিসের নিয়ে গড়া দলটা সেলেসাওদের সর্বকালের সেরা। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে গুনে গুনে দশবার বল পাঠিয়েছে তেলে সান্তানা বাহিনী। এরপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে পরিষ্কার বার্তা দিয়ে রেখেছে ব্রাজিল দলঃ ১২ বছরের অপেক্ষা ঘোচাতেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে তাঁরা। রসির ঘুম না ভাঙলে যে ভীষণ বিপদই অপেক্ষা করছে ইতালিয়ানদের জন্য!

kx6f1hstna4kfrg4szsb

৫ জুলাই বার্সেলোনার এস্তাদো সারিয়ার বিকেলের নরম রোদে স্বরূপে ফিরলেন পাওলো রসি, তাঁর এমন রুদ্রমূর্তি নিশ্চয়ই বেরজোর কল্পনাতেও ছিল না। নাকি ছিল? ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে ব্রাজিলের অর্ধের ভেতরে ডান প্রান্ত ওরিয়ালি পায়ের বাইরের অংশ দিয়ে (আউটসাইড অফ দ্য ফুট) দিয়ে অসাধারণ এক পাস বাড়িয়ে দিলেন ওভারল্যাপ করা লেফট ব্যাক আন্তোনিও কাবরিনিকে। কাবরিনি দুটো টাচ দিয়ে বলটাকে ভাসিয়ে ফেললেন বক্সে। দারুণ আউটসুইং করা ক্রসটা দুই ডিফেন্ডার অস্কার আর লুইজিনহোর মাথার উপর দিয়ে দ্বিতীয় পোস্টের দিকে গেলো। সেখানে ব্রাজিলিয়ান লেফটব্যাকের আগে পৌঁছে গেলেন রসি। দৌড়ে এসে বলে মাথা ছোঁয়ালেন, দারুণ হেডে ওয়ালদির পেরেসের ডান পোস্ট ঘেঁষে জাল কাঁপালো বল। দুই মিনিটের পরেই সক্রেতিসের গোলে সমতায় ফিরলো ব্রাজিল। কিন্তু রক্ষণে শৃঙ্খলাহীনতা যে সেলেসাওদের মজ্জাগত, নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনলো তাঁরা। গোলরক্ষক পেরেস থ্রো করে বল দিলেন লিয়ান্দ্রোকে। সেখান থেকে বল গেলো সেরেযোর পায়ে, কোনো প্রেসিং না সত্ত্বেও আলগোছে পাস দিয়ে রসিকে যেন সুযোগ উপহার দিলেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার। সুযোগের পুরো ফায়দা নিলেন রসি, কিছুটা দৌড়ে গিয়ে জোরালো শটে লক্ষ্যভেদ। ম্যাচের বয়স তখন সবে ২৫ মিনিট, আগের চার ম্যাচের উদ্ভ্রান্ত ফরোয়ার্ডের পা থেকে জোড়া গোল! ব্রাজিলের আক্রমণ আর ইতালির রক্ষণের শক্তি পরীক্ষা হবে এবার। ক্লদিও জেন্তিলেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্রাজিলের প্রাণভোমরা জিকোকে মার্ক করার জন্য, সেটা করতে গিয়ে “সাদা পেলে” এর জার্সি-ই ছিঁড়ে ফেললেন জেন্তিলে। ৬৮ মিনিটে ইতালিরই রোমায় খেলা ফ্যালকাওয়ের দারুণ এক গোলে খেলায় সমতা। ড্র করলেই পরের পর্বে যাবে ব্রাজিল – এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে ৭৪তম মিনিটে কর্নার পেলো ইতালি। প্রথম বল ঠিকমতো ক্লিয়ার হলো না, বক্সের সীমানা থেকে মার্কো তারদেল্লি বাঁ পায়ে দুর্বল এক ভলি করলেন, ছয় গজি বক্সে অপেক্ষারত রসি দারুণ রিয়েকশন দেখিয়ে সেটিকে জালে পাঠিয়ে দিলেন। হ্যাটট্রিক! বাকি সময়টুকুতে চল্লিশ বছর বয়সী কিংবদন্তি গোলরক্ষক দিনো যফ আর ইতালিয়ান জমাট রক্ষণের সম্মিলিত প্রয়াসে মরিয়া ব্রাজিলিয়ানদেরকে গোল করতে দিলো না বেরজো বাহিনী। কিন্তু জিকো, ফ্যালকাও, সক্রেতিস, এদের কিংবা কন্তি-যফদের ছাড়িয়ে ৪৪ হাজার দর্শকের সামনে কাতালোনিয়ার সেই মাঠে নায়ক একজনই – নাম তাঁর পাওলো রসি। ফুটবল ইতিহাসে নিজের নামটাকে অমোচনীয় কালি দিয়ে লিখে ফেললেন এই তোসকানো ফরোয়ার্ড।

image-placeholder-title

সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল আর ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তিন গোলের প্রথমটি এসেছিল সেই “অপরাধী” রসির পা থেকেই। একাধারে বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বল নিয়ে সেবার ফিরেছিলেন স্পেন থেকে, মারিও কেম্পেস আর গারিঞ্চা বাদে যে কীর্তি নেই কোনো ফুটবলের। ১৯৮২ সালের ব্যালন ডি’অরও উঠেছিল রসির হাতে। কিন্তু রেকর্ডবুকের নীরস পাতায় নয়, ফুটবলপিয়াসীদের গল্পে  বারবার উঠে আসবে এই ইতালিয়ান কিংবদন্তির কথা। সেই ৬৯ মিনিটের কাহিনী - যেদিন খলনায়ক থেকে আচমকা নায়ক বনেছিলেন পাওলো রসি।