• ফুটবল

বসনিয়ান-ক্রোয়েশিয়ান-অস্ট্রিয়ান নাকি স্রেফ একজন মানুষ?

পোস্টটি ২২৬৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই স্টিভেন জেরার্ডের দিকে ছুট লাগালো ছেলেটা। উদ্দেশ্য স্বপ্নের তারকাকে একটু ছুঁয়ে দেখা, হাত মেলাতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু জেরার্ডদেরকে তো ওমন কতশত বলবয়ের “উৎপাত”ই সহ্য করতে হয় হরদম। লিভারপুল মহাতারকা তাই জ্বলজ্বলে চোখের তারার ছেলেটাকে খেয়াল করেননি হয়তো, সতীর্থদের সাথে আলাপ করতে করতে টানেলের দিকে হাঁটা ধরলেন। আশাভঙ্গের বেদনায় সেদিন লাস্ক লিন্‌জ একাডেমির ছেলেটা কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। মধ্যবিশের আগেই সেই ছেলেটার ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সব ট্রফি জেতা হয়ে গেছে, ইউরোপের তিন শীর্ষ লিগে ইউরোপীয় কাপ জয়ী তিন ক্লাবের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন, ক্ষুদে দেশ ক্রোয়েশিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালের মস্তবড় মঞ্চটাতেও চড়া হয়ে গেছে। জেরার্ডের দেখা কী শেষমেশ পেয়েছিলেন মাতেও কোভাচিচ?

 

ইংরেজিতে “চাইল্ড প্রডিজি” বলতে যা বোঝায় কোভাচিচ ঠিক তা-ই ছিলেন। ডাইনামো যাগরেবের একাডেমিতে শিক্ষানবিশ থাকা অবস্থায় মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তাঁর পিছু লেগেছিল আয়াক্স, ইন্টার মিলান, ইয়ুভেন্তাস ও বায়ার্ন মিউনিখের মতো নামীদামী সব ক্লাব। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ডায়নামো যাগরেবকে পরবর্তী ঠিকানা বানালেন কোভাচিচ। কারণটা জানার জন্য নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যাওয়া যাক। মাতেওর বাবা স্তিপো ও মা রুযিকা বসনিয়ার বাসিন্দা হলেও জাতিগতভাবে ছিলেন বসনিয়ান ক্রোয়াট, সংখ্যাগরিষ্ঠদের তফাতটা ছিল বিশ্বাসেও - রোমান ক্যাথলিক রীতিনীতির মাঝেই প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৯১ সালে জাতিগত বৈচিত্র্যে ভরপুর যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধের দামাম বেজে উঠতেই স্তিপো-রুযিকা জন্মভূমি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বলকান উপদ্বীপ ছেড়ে অস্ট্রিয়াতে আশ্রয় নিলেন কোভাচিচ দম্পতি। মাতেওর জন্ম-বেড়ে ওঠা সেখানেই, রাজধানী ভিয়েনা থেকে ১১৪ মাইল দূরের শহর লিন্‌যে। বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদা ইয়োহানেস কেপলারের স্মৃতিধন্য শহর এই লিনয্‌, কিন্তু বিজ্ঞান নয় কোভাচিচের ধ্যানজ্ঞানজুড়ে ছিল ফুটবল। মাঠে বল নিয়ে সেই ছোট্টটি থেকেই এমন দুদর্ম্য ছিলেন যে কোনো কোচ বা স্কাউট নয়, ছোটবেলার এক বন্ধু প্রথম কোভাচিচের ভেতর লুকোনো ছাইচাপা আগুনের সন্ধান পায়। সেই বন্ধুর মায়ের কাছ থেকে ছেলের প্রতিভার গল্প শুনে আর দ্বিধা করেননি রুযিকা, ছেলেকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন লাস্ক লিন্‌যের একাডেমিতে। আকারে ছোটখাটো হলে কী হবে বয়সের তুলনায় কোভাচিচের ফুটবল মস্তিষ্ক ছিল দারুণ পরিণত। ২০০০-২০০৭ এই সাত বছর জন্মশহরের ক্লাব একাডেমিতে কাটানোর পর বাঘা বাঘা  ক্লাবের দড়ি টানাটানির কাহিনী। যুদ্ধ ততদিনে থেমে গেছে, যুগোস্লাভিয়ার জমিন হয়ে গেছে ছয় টুকরো। পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটির অমোঘ টানে এবার ক্রোয়েশিয়ায় পাড়ি জমালো কোভাচিচ পরিবার, মাতেও যোগ দিলো ক্রোট ফুটবলের সবচেয়ে বড় নাম ডাইনামো যাগরেবের একাডেমিতে।

Kovacicইন্টার দিয়েই ইউরোপের আভিজাত্যের সাথে পরিচয়

 যাগরেবের একাডেমিতে এসেও নিজের জাত চেনাতে একটুও সময় লাগলো না কোভাচিচের। এই একাডেমিতে থাকতেই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দুটি ঘটনা ঘটলো। ১৪ বছর বয়সে পা ভেঙ্গে গিয়েছিল কোভাচিচের। পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগেই দূরদিগন্তে মিলিয়ে যাবার দশা। কিন্তু চোয়ালবদ্ধ দৃঢ়তা নিয়েই ফিরে এসেছিলেন কোভাচিচ, এখনকার লড়াকু মানসিকতা হয়তো সেই সময়টারই ফসল। একাডেমিতে থাকার সময় দেখা পেলেন আরেক ক্ষণজন্মা ক্রোট প্রতিভা লুকা মদ্রিচের। বয়সে নয় বছরের পার্থক্য থাকলেও কোভাচিচকে নিজের ছায়াতলে নিয়েছিলেন মদ্রিচ, কীভাবে আরো ভালো করা যায় নিয়মিত তার টোটকা দিতেন অনুজকে। দুই বছর বয়সভিত্তিক দলে দুর্দান্ত খেলার পর ২০১১ সালে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হরভাতক্সি দ্রাগোভলিয়াক ক্লাবের বিপক্ষে ১৬ বছর ১৯৮ দিন বয়সে অভিষেক, গোল করে ক্রোয়াশিয়ান লিগের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা বনে যাওয়া। যাগরেবের হয়ে টানা দু’বছর লিগ জিতলেন। ২০১১-১২ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মূলপর্বে জায়গা করে নিতে রাখলেন বড় অবদান। গ্রুপপর্বে সান্তিয়াগো বেরনাবাউতে ০-১ গোলে হারলেও বিজ্ঞজনেরা কোভাচিচের খেলার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বড় ক্লাব তো সেই কবে থেকেই তাঁর পেছনে লেগে রয়েছে, ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাই ইন্টার মিলানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন “কোভা”।

 

যাগরেবে থাকতে “থ্রী ম্যান মিডফিল্ড”-এর বাঁদিকে খেলতেন কোভাচিচ। ইন্টার মিলানে এসে প্রথম মৌসুমে হয়ে গেলেন ডিপ লায়িং প্লেমেকার। তবে কোভাচিচের পজিশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেটা কেবল শুরু, ২০১৩-১৪ মৌসুমে নতুন কোচ ওয়াল্টার মাজ্জারি এসে আবার এগিয়ে আনলেন কোভাচিচকে। “দশ নম্বর” জার্সির কোভা জায়গা বদলে বনে গেলেন “নাম্বার টেন”। তবে যে ইন্টার একসময় ইতালিতে ছড়ি ঘোরানো ইন্টার তখন ক্ষয়িষ্ণু। লিগে পঞ্চম হলো ইন্টার, একটি বারের জন্যও গোলের লক্ষ্যভেদে সফল হতে পারলেন না ক্রোয়াট ‘ওয়ান্ডারকিড”। পরের মৌসুমে ভাগ্য বদলানো না ইন্টারের, তবে কোভাচিচ যেন পায়ের তলায় শক্ত মাটির খোঁজ পেলেন। মৌসুমে ৪৪ ম্যাচ খেলে আট গোল করলেন তিনি, যার তিনটিই ছিলো ইউরো লিগের বাছাইপর্বে আইসল্যান্ডের স্টিয়ারনানের সাথে এক ম্যাচে। মালিক মাসিমো মোরাত্তির সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে বরখাস্ত হলেন মাজ্জারি, মানচিনি এসে দলকে লিগে অষ্টমের উপরে তুলতে পারলেন না। তাই রিয়াল মাদ্রিদে যখন দরজায় কড়া নাড়লো কোভাচিচ স্পেনে উড়াল দিলেন, “ফাইনানশিয়াল ফেয়ার প্লে”র হিসেব মেলাতে তাকে বিক্রি করে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না ইন্টারের।

 

825767962.0ট্রফি জিতলেও মাদ্রিদের সময়টা কেটেছে হতাশায়

রিয়াল মাদ্রিদে এসে গলায় একের পর এক মেডেল ঝুললেও স্পেনে এসে যে ক্যারিয়ারের গতি কমে এসেছিল এটা কোভাচিচ নিজেও মানবেন। লুকা মড্রিচ, টনি ক্রুস, কাসিমিরোদের মতো মধ্যমাঠের কুশলীদের ভিড়ে এই ক্রোয়াট। তিন চ্যাম্পিয়ন্স লীগ আর এক লা লিগা জেতার পথে লিগে এক মৌসুমে ২৭ বারের বেশি নামতে পারেননি মাঠে, এর মধ্যে অনেকবার আবার বদলি হিসেবে নেমেছেন। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল দুটিতে মাঠে নামারই সুযোগ পাননি। রাশিয়ায় এক স্বপ্নের বিশ্বকাপেও তাই ক্রোয়াশিয়া একাদশে নিয়মিত নন কোভাচিচ। বিশ্বকাপে শেষে চেলসিতে এলেন ধারে খেলতে। পারফর্মেন্সের ওঠা-নামা থাকলেও কোভাচিচে অর্থলগ্নি করলো চেলসি। গত মৌসুমে তো চেলসির সমর্থকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন ‘প্রফেসর”, পশ্চিম লন্ডনের তরুণ বিপ্লবে ক্লাবের বর্ষসেরা ফুটবলারও হয়েছেন। যদিও সবকিছু ছাপিয়ে এফএ কাপের ফাইনালের বিতর্কিত লাল কার্ড পুরো মৌসুমের কোভাচিচের অর্জনকে কিছুটা আড়াল করে দিয়েছে। 

 

তবে কি চেলসিতেই পায়ের নিচে শক্ত জমিন পেলেন কোভা?তাহলে কি চেলসিতেই পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেলেন?

তবে বেড়ে ওঠার সময়ের অমিত সম্ভাবনার প্রতিফলন কি বাস্তবে পুরোপুরি দেখা গেছে ? উত্তরটা খুব সম্ভবত না-বোধকই হবে। একেবারে রক্ষণাত্মক মানসিকতার নন, আবার আক্রমণে গেলেও গোলের সামনে কেমন যেন মিইয়ে যান। আবার বাতাসে দক্ষতা, শারীরিক সক্ষমতায়ও সেরাদের তালিকায় থাকবেন না। কিন্তু কোভাচিচের খেলা যে চোখের শান্তি। পাকা উইঙ্গারদের মতো করে যেভাবে দু’চারজনকে কাটিয়ে এগিয়ে যান কিংবা লম্বা নিখুঁত পাসে প্রান্ত বদল করেন সেটা দেখলে মানুষটার প্রতিভার তারিফ না করেও থাকা যায় না। ল্যাম্পার্ডের নবযুগে কী মধ্যমাঠের কাণ্ডারি হতে পারবেন কোভাচিচ? তবে কোভাচিচ ধাঁধার উত্তর এখনই মিলছে না, সময় অপেক্ষায় রেখেছে আমাদেরকে। তবে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত যুগোস্লাভিয়া ছেড়ে আসা অস্ট্রিয়া বেড়ে ওঠা একজন বসনিয়ান-ক্রোয়াট হিসেবে কোভাচিচের বিশ্বতারকা হয়ে ওঠা যেন একটা প্রচ্ছন্ন একটা বার্তাই দিয়ে যায়ঃ ধর্ম, জাতি কিংবা চামড়ার রঙ ছাড়িয়ে ফুটবল খেলার আবেদনটা বৈশ্বিক, “ধলো আর কালো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙ্গা।“