• ফুটবল

পরীক্ষা আগে? নাকি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ?

পোস্টটি ২২৭১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০১৭ সালের মার্চের ঘটনা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোর দ্বিতীয় লেগে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলতে মাদ্রিদগামী বিমানে চেপে বসলো বেয়ার লেভারকুসেন। কিন্তু সেই বিমানে ছিলেন না দলের নতুন ১৭ বছর বয়সী "ওয়ান্ডার কিড"। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে ৪-২ গোলে হেরে যাওয়া লেভারকুসেন সিমিওনে বাহিনীর ইস্পাতদৃঢ় রক্ষণে আঁচড় কাটতে পারলো না। পরের মাসে শালকার বিপক্ষে বুন্দেসলিগার ম্যাচের স্কোয়াডেও সেই তরুণ প্রতিভার নাম নেই। নাহ্‌, অন্তর্বতীকালীন কোচ তায়ফুন কোরকুত তাঁকে বাদ দেননি। ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল কাই হ্যাভার্টজের, ডিফেন্ডারদের বোকা বানিয়ে “রান” নেওয়ার কৌশলের বদলে তাঁর মাথায় তখন বীজগণিতের কঠিন সূত্র ঘুরছে। মিডফিল্ডের দখল নেওয়ার চেয়ে ভাইমার রিপাবলিকের ইতিহাস মনে রাখাই বোধহয় সেই তরুণ তারকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পড়িমরি করে পরীক্ষা শেষ করে লেভারকুসেন থেকে ৬০০ মাইল দূরে মিউনিখে দলের ট্রেনিংয়ে যোগ দিলেন। পরদিনই এফসি ইংগলস্টাডের সাথে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। মৌসুমের শেষ দিকে এসে চোখ রাঙাচ্ছে অবনমন। তাই দলের বাজে ফর্ম কোরকুতের কপালে ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছিল, মরিয়া হয়ে তিনি ম্যাচের আগে শেষ অনুশীলনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন – কোনোভাবে যদি খেলোয়াড়দের একটু বাড়তি অনুপ্রেরণা দেয়া যায়। তবে এ নিয়ে তাঁকে বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হলো না, হ্যাভার্টজ যেন দলের ভোলই পাল্টে দেন। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার সাথে কঠোর পরিশ্রম মিলিয়ে অল্প বয়সেই বায়ার সমর্থকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন হ্যাভার্টজ, সেদিন সেই অনুশীলন সেশনে যেন কোরকুত নতুন করে চিনলেন দলের ২৯ নম্বরকে। অভিজ্ঞ করিম বেল্লারাবিকে বসিয়ে শুরুর একাদশে নামানো হলো হ্যাভার্টজকে, ৭৩তম মিনিটে হেড থেকে সমতাসূচক গোলে লেভারকুসেনকে খাদের কিনার থেকে উদ্ধার তো করলেনই, কোরকুতের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলো তাতে। তারপর তিন বছরে দুনিয়ার অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু এখনো নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন হ্যাভার্টজ।

NINTCHDBPICT000535125859-e1572356915156ক্ষুদে হ্যাভার্টজের ফুটবলে হাতেখড়ি মারিয়াডর্ফে

দুই সহস্রাব্দের সন্ধিক্ষণে ১৯৯৯ সালের ১১ই জুনে উত্তর-পশ্চিম জার্মানির আখেন প্রদেশের মারিয়াডর্ফ প্রদেশে জন্ম কাই হ্যাভার্টজের। পুলিশ বাবা আর আইনজীবী মায়ের সন্তান কাইয়ের গল্পটা তাই ফুটবল নামক পরশপাথরের ছোঁয়ায় “ভিখারি থেকে রাজপুত্র” বনে যাওয়া নয়। ফুটবলপাগল পরিবারে ছোট্ট কাইয়ের খেলার সঙ্গী ছিল দাদু। রিচার্ড হ্যাভার্টজ কখনো পেশাদার ফুটবল খেলেনি, তাঁর ছেলের ফুটবল খেলার দৌড়টাও শৌখিনতা পর্যন্তই আবদ্ধ ছিল। তবে নাতির মধ্যে ফুটবলার হবার বাসনার বীজটা বপন করে দিতে ভোলেননি রিচার্ড। স্থানীয় অপেশাদার দল আলেমানিয়া মারিয়াডর্ফ ক্লাবের সভাপতি ছিলেন রিচার্ড, সেই ক্লাবে চার বছর বয়সে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো কাইকে। মারিয়াডর্ফের সময়টাতে নিজের বয়সের দুই বছরের উপরের গ্রুপের ছেলেদের সাথে খেলতে হয়েছে কাইকে। ২০০৯ সালে স্বপ্নপূরণের ডাক এলো, বুঝতে শেখার পর থেকে যে ক্লাবকে মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছে হ্যাভার্টজ সেই আলেমানিয়া আখেনে যোগ দেয়ার সুযোগ এলো। চোখ বুজে “হ্যাঁ’ বলে দিলো হ্যাভার্টজ পরিবার।

 

আখেনের একাডেমিতে অবশ্য এক বছরের বেশি থাকা হয়নি। নাহ্‌ আখেন তাঁকে ছুড়ে ফেলেনি, বরং আরো বড় ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তাব এসেছে। লেভারকুসেনের “কার্টেকুটেন” একাডেমির বেশ সুনাম আছে জার্মানিতে, ২০১০ থেকে সেটাকেই ঠিকানা বানালেন হ্যাভার্টজ। এখানেই বাঁধলো বিপত্তি, মারিয়াডর্ফ থেকে লেভারকুসেনের দূরত্ব ৪৫ মাইলের কাছাকাছি। স্কুল, বাবার গাড়িতে চড়ে একাডেমিতে যাওয়া, অনুশীলন, ম্যাচ খেলা – সকাল ৭টা থেকে ৭টা পর্যন্ত হ্যাভার্টজের ব্যস্ততায় ঠাসা সূচি। তাই স্কুলের প্রজেক্ট কিংবা বাড়ির কাজগুলো বাবার গাড়িতে করে ফেরার সময়টুকুতেই সেরে নিতে হতো। লেভারকুসেনের একাডেমিতে প্রথম ৪ বছরে ৩০৭ গোল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে সময় লাগেনি মোটেও। বয়স ১৪ পেরোতেই আবার ঝামেলা হাজির। ততদিন পর্যন্ত সমবয়সীদের চেয়ে উচ্চতায় একমাথা খাটো ছিলেন হ্যাভার্টজ। কিন্তু বয়ঃসন্ধির অবধারিত ফল হিসেবে হুট করেই লম্বা হতে শুরু করলেন। আগের মতো বলের নিয়ন্ত্রণ রাখা দূরের কথা, শরীরের ভারসাম্য রাখতেই তখন রীতিমতো দফারফা অবস্থা তাঁর। এতে অবশ্য আখেরে লাভই হয়েছিল তাঁর। কম উচ্চতার সময়ের “লো সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি” এর সুযোগে শিখে নেওয়া ড্রিবলিং আর বলের নিয়ন্ত্রণ এখনো তাঁর শক্তিমত্তার জায়গা।

skysports-kai-haverz-bayer-leverkusen_5047762রেকর্ড ভেঙ্গেচুরে দৃশ্যপটে আবির্ভাববল পায়ে দুরন্ত, মগজের দৌড়েও কম যান না

এরপর ২০১৬ সালের ১৫ই অক্টোবর ভের্ডার ব্রেমেনের বিপক্ষে চার্লসি আরাঙ্গিজের বদলি হিসেবে নেমে বুন্দেসলিগার সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে রেকর্ডের পাতায় নাম লেখানো (২০২০ সালে ক্লাব সতীর্থ ফ্লোরিয়ান ভির্টজ সেই রেকর্ড ভাঙ্গেন), ঐ মৌসুমেই পরের এপ্রিলে ভলফ্‌সবার্গের বিপক্ষে লিগের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড গড়া। প্রথম মৌসুমে ২৪ ম্যাচে ৪ গোল, ৬ অ্যাসিস্ট – বেশ সমীহ জাগানোর মতো পরিসংখ্যান। হয়তো পড়াশোনার বাড়তি চাপটা না থাকলে হয়তো আরো ভালো করতে পারতেন। পরের মৌসুমে খেলার সুযোগ বাড়লো, লিগে খেলতে পারেননি এমন ম্যাচ মোটে চারটা। জাল খুঁজে নেয়ার চাইতে যেন সতীর্থদেরকে জালের রাস্তা খুঁজে বার করার পণ নিয়ে নেমেছিলেন সেই মৌসুমেঃ মাত্র ৩ গোলের ৯টি অ্যাসিস্ট। ২০১৮ সালের এপ্রিলের ১৪ তারিখে সবচেয়ে কমবয়সী (১৮ বছর ৩০৭ দিন) হিসেবে বুন্দেসলিগায় ৫০ ম্যাচের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেললেন। রেকর্ডটা যার দখলো ছিলো তিনিও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের আরেক পরিচিত নামঃ টিমো ভের্নার। তবে হ্যাভার্টজ ফুটবল বিশ্বের মানচিত্রে আলাদা করে নিতে শুরু করলেন ২০১৮-১৯ মৌসুমে। সাথে রেকর্ডের ফুলঝুরি তো ছুটছিলোইঃ সবচেয়ে কম বয়সে বুন্দেসলিগায় ৭৫ ম্যাচ খেলা, লেভারকুসেনের সর্বকনিষ্ঠ পেনাল্টি গোলদাতা, বুন্দেসলিগা সবচেয়ে কম বয়সে ১৩ গোল। সবধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪২ ম্যাচে ২১ গোল আর ৬ অ্যাসিস্ট – বয়সের বিবেচনায় হ্যাভার্জের পরিসংখ্যানকে “অতিমানবিক”-ই বলতে হবে। জার্মানির বিখ্যাত সাদা জার্সি গায়ে অবশ্য এখনো নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। এখন পর্যন্ত ৭ ম্যাচ খেলে মোটে একবার গোলের দেখা পেয়েছেন।  

 

আগের মৌসুম থেকেই ইউরোপের কুলীন সব দল হ্যাভার্টজের প্রতি আলাদা নজর রাখছিলো, ৪৩ ম্যাচে ১৬ গোল আর ১০ অ্যাসিস্ট করে তিনি জানিয়ে দিলেন তাঁকে “ওয়ান সিজন ওয়ান্ডার” এর তকমা দেওয়াটা বড় ভুল হবে। এবার সবচেয়ে কম বয়সে জার্মানির প্রথম বিভাগে ১০০ ম্যাচ খেলার রেকর্ড নিজের করে নিলেন, এটাও আগে ভের্নারের দখলে ছিলো। তাই করোনাভাইরাস মহামারীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ও রোমান আব্রামোভিচ তাই হ্যাভার্টজকে পেতে কার্পণ্য করেননি। সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী ৪ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দেশের সর্বকালের সবচেয়ে দামী ফুটবলার হতে যাচ্ছেন কাই হ্যাভার্টজ। তো চেলসি তাঁকে পেতে ওমন মরিয়া হয়ে উঠেছে কেনো? উত্তরটা যত সহজে চোখে পড়বে, ঠিক ততোটা সহজেই চোখ এড়িয়ে যাবে। বলের ওপর তাঁর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ, উচ্চতা বিবেচনায় বেশ ভালো গতি, দু’পায়ের সমান জোর, বাতাসে দক্ষতা কিংবা জালের সামনে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ সারা এগুলো বুঝতে বিশেষজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না। কিন্তু প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের সামনে ফাঁকা জায়গা খুঁজে নেয়া, একের পর এক বুদ্ধিদীপ্ত “রান”, নিয়মিত চাপ সামলে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাওয়া, মানসিক দৃঢ়তা কিংবা সঠিক “ওয়েট”-এ চূড়ান্ত পাস ছাড়া – এসব দেখতে হলে কিছুটা সময় নিয়ে জার্মান ফুটবলের নতুন প্রজন্মের অন্যতম কাণ্ডারিকে খেলার মাঠে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

1172555742.jpg.0এখন থেকে কোবহামেও এমন দৃশ্য নিয়মিত দেখা যাবে

বেড়ে ওঠার সময়টাতে হ্যাভার্টজের আদর্শ ছিলেন ওজিল, তবে সবমিলিয়ে সম্ভবত সাবেক জার্মান অধিনায়ক মাইকেল বালাককেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। দুজনই বাতাসে দক্ষ, দীর্ঘদেহী; আবার চোখের পলকেই এক পাসে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে চিড়ে ফেলতে পারেন। বালাক ইংল্যান্ডে এসেছিলেন ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে, হ্যাভার্টজের ফুটবল জীবনের সূর্যটা মধ্যগগনে আসতে এখনো ৫-৬ বছর বাকি। তবে সর্বকাজের কাজি (জার্মানরা যাকে বলে “আলেসকনার”) হ্যাভার্টজের কাছে চেলসি সমর্থকদের প্রত্যাশাটা গগনচুম্বীই। ইংল্যান্ডের শরীরনির্ভর ফুটবলে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন হ্যাভার্টজ, জিয়েশ কিংবা অগ্রজ ভের্নারের সাথে রসায়নটা ঠিকঠাক জমবে তো? উত্তরটা পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। খুব শিগগিরই চেলসির নীল জার্সিতে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড-অ্যানফিল্ড-স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ছুটে বেড়াবেন মারিয়াডর্ফের সেই “কাই। ২০০৬ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া রিচার্ড হ্যাভার্টজ বোধহয় এমন কিছুরই স্বপ্ন দেখেছিলেন।