• ফুটবল

নাম তাঁর আনসু ফাতি

পোস্টটি ২৮৩১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
বোরি ফাতি নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন। কোনো জন্মের পুণ্যেই নিশ্চয়ই হুয়ান ম্যানুয়েল সানচেজ গর্দিওর দেখা পেয়েছিলেন তিনি। ভদ্রলোক মারিনালেদা শহরের মেয়র, তাও সেই ১৯৭৯ সাল থেকে। প্রিয় শহরকে পুঁজিবাদের আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়ে সাম্যবাদের এক অপরূপ দৃষ্টান্ত করেছিলেন। পুরো স্পেন যেখানে বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ভুগছে, সেখানে বামপন্থী এই নেতার তত্ত্বাবধানে শক্ত আর্থসামাজিক উপরে দাঁড়িয়ে আছে মারিনালেদা। বামপন্থী এই নেতার তত্ত্বাবধানে ফুটবলার হবার স্বপ্নে বিভোর বোরি ফাতি গৃহবিবাদে ছিন্নভিন্ন দেশ গিনি-বিসাউ থেকে পর্তুগালে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে বাস্তবতা যে কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে সেটা বুঝতে মোটেও সময় লাগলো না বোরি ফাতির। পর্তুগালের নিচুসারির বিভাগে ফুটবলার হিসেবে সুবিধে করতে পারলেন না বোরি। ফলাফলঃ ভাগ্যান্বেষণে আইবেরীয় উপদ্বীপের আরেক দেশ স্পেনে পাড়ি জমানো। আন্দালুসিয়ায় পা দিয়েই লোকমুখে মারিনালেদার কথা শুনলেন বোরি ফাতি – সেখানে গিয়ে পড়লেই হলো, কাজের কোনো অভাব হবে না। মাদ্রিদ থেকে ২৯০ মাইল দক্ষিণের শহরটাতে এসেও অবশ্য দুর্দশা ঘুচলো না। ক্ষুধার তাড়নায় দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা থেকে শুরু করে রাস্তায় ঘুমানো – টিকে থাকার লড়াইয়ে এর সবই করলেন ফাতি। হঠাতই একদিন সানচেজ সাহেবের সাথে রাস্তায় দেখা, সেই শুভক্ষণে পাল্টে গেলো ফাতির জীবন। গাড়ির চালক হিসেবে চাকরি জুটলো, মিললো মাথা গোঁজার ঠাই। আস্তে আস্তে স্ত্রী-সন্তানদের স্পেনে নিয়ে এলেন বোরি ফাতি। ঘটনাটা কদ্দিন আগের জানেন? এই ১০-১১ বছর হবে। বোরি ফাতির ছয় বছরের ছেলেটার নামই আজ তাবৎ ফুটবল ভক্ত-সমর্থক-বোদ্ধাদের মুখে মুখে ফিরছে, ক্যারিয়ারের সূচনালগ্নেই একের পর এক রেকর্ড করে নিচ্ছে সেই ছেলেটা – নাম তার আনসু ফাতি।
 
 
বোরি ফাতির ফুটবলার হবার বাসনাটা দূর আকাশে মিলিয়ে গেলেও ফুটবলের প্রতি ফাতি পরিবারের ভালোবাসা এইটুকুও কমলো না। বড় ভাই ব্রাইমার সাথে সুযোগ পেলেই বলে লাথি কষানোর চেষ্টা করতো ছোট্ট আনসু। খেলাটায় যে একেবারে খারাপ ছিলো না তার প্রমাণ মাত্র ছয় বছর বয়সেই স্থানীয় ক্লাব সিডিএফ এরেরার বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেলো আনসু। ওদিকে ব্রাইমাকে দলে ভেড়ালো সেভিয়া। বোরি ফাতির কষ্টের দিনগুলো বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। ২০১১ সালে ব্রাইমা সুযোগ পেলো লা মাসিয়ায়, পরের বছরেই অগ্রজের দেখানো পথে হাঁটলো আনসু। দূরতম কল্পনায়ও হয়তো এতোটা আশা করেননি বোরি। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, পিকে, পুয়েলদের উত্তরসূরি হবার দীক্ষা নেবে তাঁর ছেলে! আনসু নিজে অবশ্য অতোকিছু বুঝতো না। তার কাছে ফুটবল খেলাটা উপভোগের – মাঠে বন্ধুদের সাথে মজার সময় কাটানো। গতি, বলের নিয়ন্ত্রণ আর ড্রিবলিংয়ে তিনি যে সমবয়সীদের চেয়ে একেবারেই আলাদা, সেটা লা মাসিয়ার কোচদের নজর এড়ালো না। বয়সভিত্তিক দলগুলোতে আনসু ফাতি মানেই গোলের নিশ্চয়তা।
 
processবল পায়ে কখনোই বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ মনে হয় না
 
২০১৯ সালের জুলাইতে বোরি ফাতির জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটা এলো। বার্সেলোনার সাথে তিন বছরের পেশাদার চুক্তি স্বাক্ষর করলেন আনসু ফাতি। এরপরে যা ঘটলো তা সিনেমার কল্পলোকের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য চিত্রনাট্যকেও হার মানাবে। লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা তরুণেরা সাধারণত রিজার্ভ দল “বার্সেলোনা ‘বি’ এর হয়ে খেলে পেশাদার ফুটবলের কাঁকর বিছানো পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নেয়। কিন্তু আনসু ফাতি তো নিজেকে আলাদা করে চেনাতে এসেছেন, তাঁর বেলায় সাধারণ নিয়ম খাটে নাকি। প্রাক মৌসুমে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ফাতির পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে কোচ মূলদলের কোচ ভালভার্দে তাঁকে ডেকে নিলেন। উত্তেজনায় নাকি নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ফাতির। স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ নিতে বেশি সময় লাগলো না। আগস্টের ২৬ তারিখে রেয়াল বেতিসের বিপক্ষে ম্যাচের ৭৮তম মিনিটে কার্লেস পেরেজের বদলি হিসেবে ন্যু ক্যাম্পের বিখ্যাত পিচে দেখা গেলো ১৬ বছর ২৯৮ দিন বয়সী আনসু ফাতি। এই সেই ফাতি যাকে গভীর রাতের ম্যাচগুলোতে বেঞ্চে রাখতেও লা লিগার নিয়মানুযায়ী অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয় বার্সেলোনাকে। তিনিই কিনা প্রায় দ্বিগুণ বয়সী ডিফেন্ডারকে নাকানি চুবানি খাওয়ালেন। ছ’দিন বাদেই ক্যারিয়ারের প্রথম গোল পেয়ে গেলেন, ওসাসুনার বিপক্ষে বদলি হিসেবে নামার পাঁচ মিনিটের মাথায়। ডান প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কার্লেস পেরেজের ক্রসটায় লাফিয়ে উঠে মাথা ছোঁয়ালেন। ছোঁয়ালেন বললে ভুল হবে দারুণ দক্ষতায় বলটাকে জালের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। ওসাসুনার গোলরক্ষক রুবেন ঝাঁপ দিয়েও সেই নিখুঁত হেড ফেরাতে পারলেন না। বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামা সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড়ের পাশে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার তকমাটাও লেগে গেলো।
 
1568557892_091413_noticia_normalবার্সার জার্সি গায়ে নিজেকে চেনাতে সময় লাগেনি
 
পরের মাসে ভালেন্সিয়ার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম “স্টার্ট” -এ ১১১ সেকেন্ডে গোল এলো, সপ্তম মিনিটে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে দিয়ে গোল করিয়ে প্রথম অ্যাসিস্টও পাওয়া হয়ে গেলো। ভালেন্সিয়া বক্সের বা-প্রান্তে অভিজ্ঞ ডিফেন্ডারকে শরীরের মোচড়ে পরাস্ত করে কাটব্যাক করলেন ফাতি, প্লেটে সাজানো গোলটা মিস করলেন না ডি-ইয়ং। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অভিষেক হলো বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে, সেই ম্যাচে ফাতি রেকর্ড গড়লেও কোনো দলেরই গোল পাওয়া হলো না। এরপর ইউরোপীয় কাপের সুদীর্ঘ ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হলেন ফাতি। সান সিরোতে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচের ৮৫তম মিনিট পর্যন্ত। ডি বক্সের সামনে বল পেয়ে সুয়ারেজের সাথে ওয়ান-টু করলেন ফাতি। সুয়ারেজের “লে-অফ” থেকে ডান পায়ের শটে হানদাভোচিকে পরাস্ত করলেন, পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী ফুটবল তীর্থ থেকে পুরো তিন পয়েন্ট নিয়ে ফিরলো “ব্লাউগ্রানা”রা। ফেব্রুয়ারিতে লেভান্তের বিপক্ষে জোড়া গোলে আবার রেকর্ড। তবে দুঃসহ এক মৌসুমে বার্সা ভক্তদের গুটিকয়েক সুখস্মৃতির একটা প্রথম গোলের উদযাপন। ফাতিকে আলিংগণে বাঁধলেন লিওনেল মেসি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও দেখা গেলো। গত মৌসুমে সবমিলিয়ে ৩৩ ম্যাচে ফাতির নামের পাশে ৮ গোল আর এক অ্যাসিস্ট – শরীরে এখনো বাল্যকালের গন্ধ লেগে থাকা কারো জন্য সেটাকে যথেষ্ট ভালোই বলতে হবে। এর আগেও তো কতজন এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করেছে, কিন্তু পেশাদারি ফুটবলের তুমুল প্রতিযোগিতার মঞ্চে সেটাকে সাফল্যে অনুবাদ করতে পারেন খুব অল্প ক’জনই। ফাতি কি পারবেন? উত্তরটা হয়তো আরো পরে জানা যাবে, কিন্তু তাঁকে নিয়ে মাতামাতিটা যে থামছে না সেটা যেন নিশ্চিত করেছেন ফাতি নিজেই। স্পেনের হয়ে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে দারুণ এক গোল করেই ৯৫ বছরের পুরনো এক রেকর্ড ভেঙ্গেছেন তিনি। স্পেনের সর্বকনিষ্ঠ এখন বোরি ফাতির ছোট ছেলেটা।
 
147102-ghpxaikthi-1599453891লা ফুরিয়া রোহাদের নতুন প্রজন্মের নায়ক?
 
হুয়ান ম্যানুয়েল সানচেজ গর্দি লোকটাকে স্পেনের লোকে “রবিন হুড” নামে চেনে। সুপারমার্কেটের দোকানে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে দারিদ্র্যপীড়িতদের মধ্যে খাবার বিলিয়ে দেন বলে এমন নাম। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছেন এই শ্রমিকনেতা, অর্থনৈতিক বৈষ্যমের প্রতিবাদ জানিয়ে করেছেন অনশন। মারিনালেদার সব কটি বাড়ি একই আদলে গড়া, স্থানীয় দু হাজার অধিবাসীর সবাই মিলেমিশে ক্ষেতে কাজ করে, মজুরিতেও কোনো বৈষম্য নেই। তবে প্রতিপক্ষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক দুঁদে রাজনীতিক ম্যানুয়েল সানচেজ বার্সেলোনার খেলার সময় আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। সব ধরণের বিলাসিতা ম্যানুয়েল সানচেজের বাসায় একখানা টেলিভিশন সেট আছে কিনা সেটা জানা নাই। থাকলে হয়তো বার্সেলোনার খেলার সময় মুখের কাঁচা-পাকা দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল ভেদ করে সরু হাসির রেখা ফোটে। গর্বভরা কণ্ঠে টিভির পর্দার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, “দেখলো তো, ঐতো আমাদের আনসু।"