সাকিবের সাথে বাবার শূন্য আর সৌভাগ্যক্রমে আমার এক মিনিট!
পোস্টটি ২৫৩৭ বার পঠিত হয়েছেছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই কমবেশি প্রক্সি জিনিসটার সাথে পরিচিত। বন্ধুদের বাঁচাতে কতবার যে প্রক্সি দিয়েছি তার হিসেব কষতে আমাদের ছেলেবেলোয় হারিয়ে যাওয়া সেইসব হাজিরা খাতা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্ত, আপনারা কি প্রক্সি মিটিং ব্যাপারটার সাথে পরিচিত? চলুন পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু পছন্দের ব্যক্তিত্ব থাকে। যাদের সংস্পর্শে আসা যায় না, শুধু দূর থেকেই দেখা যায়। কল্পনার জগতে কতজন তাদের সাথে সাক্ষাত করে, মনের কথা বলে তার হিসেব মেলানো দায়। কিন্তু, ভাবুন তো নিজের প্রিয় ব্যক্তিত্বদের একজন যদি সত্যিই আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন অনুভূতিটা কেমন হবে! নিঃসন্দেহে দারুণ, তাই না? ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা আর ক্রিকেট পাগল অনেক ক্রিকেটারদের মতো সাকিবও আমার প্রিয় ক্রিকেটার। প্রথমবার সাকিবকে দেখলাম ২০১২ সালে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলেও ভিড়ের কারণে সামনে যেতে পারি নি। হাত মেলানোর প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেদিন খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার ডিজায়ারটা আরও বেড়ে গেলো। সাক্ষাৎে দেরি হলে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ এ তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য ৩০শে জুলাই ২০১৯ সাকিবকে স্বপ্নের শহর চট্রগ্রামে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। আর সম্মান হিসেবে তুলে দেওয়া হলো নগর চাবি।
একই সাথে সেসময় আমি দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট এবং ক্রিকেট ইভেন্টগুলির সাথে সংযুক্ত ছিলাম। মূলত সাকিবকে সংবর্ধনা প্রদান করার সেই অনুষ্ঠানটি যুব সমাজকে আরও বেশি করে খেলাধুলা বিষয়ক পেশাদারিত্বের দিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। এবং যথারীতি সেখানে তিনি তার ক্ষুদে ক্রিকেট ভক্তদের সাথে কিছু চিট-চ্যাট আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের একদিন আগেও ভেবেছিলাম আমাদের একাডেমি থেকে আমি প্রতিনিধিত্ব করবো, মঞ্চে উঠে তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করবো। তবে আমার কোচ আমার পূর্বে অন্য কাউকে বেছে নেয়ায় আমি নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান বলে মনে করতে পারিনি। অভ্যর্থনার দিন আমি স্টেডিয়ামের উপরের গ্যালারীতে সামনের সারিতে বসেছিলাম। তখন আমার একাডেমির একজন সঙ্গীর কাছ থেকে শুনলাম যে আমাদের প্রতিনিধি আজ অনুপস্থিত থাকবেন। কারণ তার এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে সে আসতে পারবে না। আর আমি অন্য কিছু ভাবার আগেই শুনলাম তার জায়গায় আরেকজনকে যেতে বলা হয়েছে। আমি বললাম ধুর ছাই কপালটাই খারাপ। কিন্তু, তারপর যা ঘটলো তা নাটকীয় আর এটা হজম করতেও একটু কষ্ট হবে। যে ছেলেটিকে প্রশ্ন করার জন্য বাছাই করা হয়েছিলো সে আমার কাছে এসে বললো, " ভাই আমি খুব নার্ভাস। আমি কি জিজ্ঞাসা করবো কোনো ধারণা নেই। আমি যেতে পারবো না। আপনি আমার পক্ষ থেকে যান।" আমি এই মুহূর্তটি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। কাউকে না কাউকে যেতেই হতো। এ জাতীয় সুযোগগুলি কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। তবুও আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। তুমি কি নিশ্চিত? সে বললো, 'হ্যাঁ ভাই আপনি যান'। তারপর সেই আনন্দের মুহূর্তটি আসলো। সাকিবকে খুব কাছ থেকে দেখার আবারও সুযোগ হলো। তাঁকে কিছু প্রশ্ন করলাম আর এবার হাত মেলানোর সুযোগটাও ফসকে যায়নি।
এক মিনিটের সেই সাক্ষাৎে ক্রিকেট রিলেটেড প্রশ্ন করলেও একটা প্রশ্ন করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও করতে পারিনি। আর সেটা হলো, সাকিব হওয়ার বিড়ম্বনা কেমন। যাহোক সেটা তো আর করা হয়নি। তবে সামনা-সামনি দেখা হবার যে আনন্দ তার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। মনে হচ্ছিলো এটা সত্যি না, কাল্পনিক। কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছিলাম যে, আমার প্রিয় ক্রিকেটার আমার সামনে। তো এ পর্যন্ত আপনাদের মনে হতে পারে আমি হয়তো সেই ছেলেটা না যাওয়ার কারণে ভাগ্যবান। তবে মন থেকে কিছু না চাইলে সম্ভবত ভাগ্যবান বলে দাবি করাটাও মুশকিল! ২০১৯ সালের ২৬ শে জুলাই আমার বাবা মারা যান। সাকিবের সাথে দেখা হওয়ার ঠিক তিন দিন আগে। আমি শকড ছিলাম, ব্যথিত ছিলাম। এই দিনটা আমার জন্য নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল। আমি এর বাইরে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু, তাও পরের দিনই আমি মাঠে ছিলাম আমাদের দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট দলকে সমর্থন করার জন্য। যদিও আমি সেখানে ছিলাম তবে আমি কোনো অনুশীলন করিনি এবং ম্যাচেও অংশগ্রহন করিনি। ৩০ শে জুলাই সাকিবের সাথে দেখা করার দিন সকালে বেশ ভারি বৃষ্টিপাত হয়। পুরো হালিশহর এরিয়া প্রায় আধা ফুট পানির নিচে। আমি বাসায় বসেছিলাম আর নিজেকে বলছিলাম আজকের দিনটাও ২০১২ সালের মতোই হবে। আমি যদি যাই তবে তাঁকে দেখবো আর তিনি ঠিক আমার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবেন কিন্তু তবুও আমি তাকে অভ্যর্থনা জানাতে পারবো না, তার সাথে হাত মেলাতে পারবো না। তাই যাওয়ার কোনো মানে নেই। তবে আবার আমি নিজেকে বলেছি না থাক! চলেই যাই। আমি এই মানুষটাকে ভালবাসতাম। তাই আমি এক্সাইটেড হয়ে স্টেডিয়ামের দিকে রওয়ানা শুরু করলাম। কিন্তু, কিছুদূর যাবার পর নিজেকে কোন অর্থ ছাড়া আবিষ্কার করলাম। টাকার জন্য বাসায় ফিরলে পোঁছাতে দেরি হতো। তাই আমি হাঁটা শুরু করলাম এন্ড ওয়াল্কড অ্যালোন। এই সবকিছুর পর অবশেষে আমি সাকিবের সাথে দেখা করতে স্টেডিয়ামে পোঁছাই। যেভাবে সবকিছু ঘটেছিল এবং তাঁর সাথে দেখা হবার পর হাত মেলাতে পারার মুহুর্তটি ছিল অন্যরকম। আমার তখন বাবার কথা মনে পড়ছিলো। আজ বেঁচে থাকলে তিনি কত খুশি হতেন! তিনিও সাকিবকে অনেক ভালোবাসতেন। স্টেজ থেকে নামার পর ভাবছিলাম আজ যদি আমি বৃষ্টির কারণে আর পকেটে টাকা না থাকার অভাবে বাসা থেকে বের না হতাম তবে হয়তো আমার প্রক্সি মিটিংটা আর কখনোই হতো না। যেহেতু ডান কাঁধে আঘাতের কারণে আমাকে পেশাদার ক্রিকেট থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো। আর এক মিনিটের সেই সাক্ষাতে বাবার শূন্যতাটাই বার বার ভেসে আসছিলো। যেহেতু বাবাও সাকিব আল হাসানের একজন ভক্ত ছিলেন। সাকিবের সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা তা অজানা। তবে এই মানুষটার সাথে এক মুহূর্তের সেই স্মৃতিচারণ এজ অ্যামেইজিং এজ হিম। সাকিব যখন আইসিসি কর্তৃক নিষিদ্ধ হন তখন সেটা মানতে বেশ কষ্ট হয়েছিলো।
তখন মন থেকে একটাই দোয়া করছিলাম এই সময়টা দ্রুত শেষ হয়ে যাক। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ। সাকিব খুব দ্রুত ফিরবে। বীরের বেশেই ফিরবে। সবার কথা জানি না তবে আমার কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজা সাকিব আল হাসান। আর রাজা ছাড়া যেমন রাজ্য অসম্পূর্ণ ঠিক তেমনি সাকিব ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও কি যেন নেই নেই বিদ্যমান। সাকিব বলতেন তিনি ভাগ্যবান। কিন্তু, আমার মনে হয় তাঁর উপর বাংলাদেশের মানুষের দোয়াটাই বেশি। যার ফলে, নিষিদ্ধ হবার পরেও তিনি খুব বেশি ম্যাচ মিস করেননি। তবুও এই সময়টা যে তার জন্য কষ্টের এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আর সাকিব এমন একজন মানুষ যার জন্য দোয়া আর অপেক্ষা দুটোই মন থেকে করা যায়। দেখতে দেখতে অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে রাজার রাজ্যে ফেরার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। সাকিব মাঠে ফিরতে যাচ্ছে। ভক্ত হিসেবে এর চাইতে আনন্দের আর কি হতে পারে! মাঠে ফিরে সাকিব এভাবেই আবার সব ফরম্যাটে রাজত্ব করবেন এমনটাই প্রত্যাশা।
- 0 মন্তব্য