• ফুটবল

নীরবে তুলির আঁচড় দিয়ে যাওয়া নিভৃত এক শিল্পী

পোস্টটি ১৯৬৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে কাকার পাসটা একেবারে মাপমতোই ছিল। পেনাল্টি স্পটের কাছাকাছি এসে সেটি খুঁজে পেলো গুতি এরনান্দেজকে। বলের সাথে ডান পায়ের মোটামুটি সংযোগ হলেই চলতো। অবধারিতভাবে জালে ঢুকে যাবে বল। অন্তত গালিসিয়ার রিয়াসর স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়া দর্শকেরা অন্তত সেটাই ভেবেছিল। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে অপ্রত্যাশিত একটা কাজ করে বসলেন গুতি। নাহ্‌, বলটা বাইরে দেননি কিংবা হুমড়ি খেয়ে পড়েননি, গোলরক্ষকের একেবারে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তিনি কিনা ব্যাকহিল করলেন। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা করিম বেনজেমা অবশ্য কোনো শৈল্পিকতার ধার ধারলেন না, নিমিষেই বল জালে জড়িয়ে ছুট লাগালেন। উদযাপনের সময় বেনজেমার হাসিমুখের আড়ালে হতভম্ব ভাবটা স্পষ্টতই ফুটে উঠছিল। আসলে হোসে মারিয়া গুতিয়েরেস এমনই। ফুটবল মাঠে অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দিয়ে গেছেন, ক্লাবের হয়ে জিতেছেন সবকিছুই, কিন্তু পাদপ্রদীপের আলোটা কখনোই খুঁজে পায়নি তাঁকে, নিরবে-নিভৃতেই নিজের কাজটুকু সেরে নিয়েছেন। রেয়াল মাদ্রিদের ঘরের ছেলে তাই তারকার ভিড়ে অনেকটা পর হয়েই ছিলেন।
 
  • তোরেহন দি আরানহোয নামে যে এলাকায় গুতির জন্ম, সান্তিয়াগো বেরনাবাউ থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩ মাইল। ছোটবেলায় স্কুল আর ফুটবল খেলার বাইরে আর কিছুই বুঝতে না কিংবা বুঝতে চাইতেন না হয়তো। সেই ছোট্ট বয়সেই সমানতালে ফুটবল আর ফুটসাল খেলা হতো। মাদ্রিদের স্কাউটদের চোখে পড়তেও বেশি সময় লাগলো না। তাই অবধারিতভাবেই রেয়াল মাদ্রিদের একাডেমি “লা ফাব্রিকা”য় দশ বছর বয়সে ফুটবলদীক্ষা নিতে চলে আসা। ইউরোপের ফুটবলে সবচেয়ে সফল দলটার বয়সভিত্তিক প্রতিটি দলেই খেলা হয়েছে গুতির। শুরুতে পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার ছিলেন, গোলের সামনে হিমশীতল মাথার সাথে পায়ের কারুকার্যের মিশেলে অল্প দিনের মধ্যে নামডাক হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য দলের প্রয়োজনে মিডফিল্ডার হয়ে গিয়েছিলেন। বয়সভিত্তিক দলে নয় বছর কাটিয়ে অবশেষে স্বপ্নপূরণের পালা এলো। সেভিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো মূল দলের হয়ে প্রথমবারের মতো পিচের প্রান্তরেখা পার করলেন গুতি, হোর্হে ভালদানোর অধীনে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক। প্রথম মৌসুমে ন’বার খেলার সুযোগ হয়েছিল, এর মধ্যে একটি গোলও পেয়ে গিয়েছিলেন।

59b6529b35df96583cc6602fd7eaa291

  • রেয়াল মাদ্রিদের হয়ে তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন, লা লিগা মাথার উপর তুলে ধরেছেন পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বছরে; কিন্তু গড়পড়তা ফুটবল সমর্থকদের কাছে গুতির নামটা অতটা পরিচিত নয়। জিদান-ফিগো-রোনালদো-বেকহামদের আলোর রোশনাইয়ের ভিড়ে গুতি যেন এক টিমটিমে প্রদীপ। ২০০০-০১ মৌসুমে ফার্নান্দো মরিয়েন্তেসের চোটের সুযোগে স্ট্রাইকার খেলেছেন। কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক গোলের সামনে তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিকে ডানা মেলবার সুযোগ দিয়েছেন। ফলাফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। লিগে ১৪ গোলসহ সব মিলিয়ে ১৮ গোল করে লা লিগা জেতায় গুতির বড় ভূমিকা ছিল। তবে মূল মঞ্চটা কখনোই তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিল না। রোনালদোর মতো মহাতারকার আগমনে আবার মিডফিল্ডে ফিরে যাওয়া। তবুও ২০০১-২০০২ এই দুই মৌসুমে ১৩টি করে গোল করেছেন। এরপরে মাঝমাঠ থেকে গোল করার চেয়ে গোল বানিয়ে দেয়ার কাজটার দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়। কখনো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে “হোল” এ খেলেছেন, কখনোবা নম্বর ৮ হিসেবে আক্রমণ ও রক্ষণে ভারসাম্য এনে দিয়েছেন, আবার “ডিপ লায়িং প্লেমেকার” হিসেবে নিচ থেকে খেলা গড়ে দিয়েছেন। জিদানের অবসরে হয়তো নিজের সৃষ্টিশীল সত্ত্বাটা দেখানোর সুযোগ পেলেন, আবার হয়তো কাকা আসার পর রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ফেরত গিয়েছেন। তবে মাদ্রিদে আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা গুতি কখনোই না করেননি, দলের প্রয়োজনে সকল কাজের কাজি হয়েছেন।

bbaede83bc5d634cfbf4f0cbef875004

  • একুশ শতকের প্রথম জিদান-বেকহাম-রবার্তো কার্লোস-ফিগোদের সাথে প্রথম "গ্যালাক্টিকোস” আবার দশকের শেষে এসে রোনালদো-কাকাদের দ্বিতীয় "গ্যালাক্টিকোস”-এর সাথে খেলেছেন। কিন্তু নিজের প্রতিভা দিয়েই দলে জায়গা টিকিয়ে রেখেছেন প্রতিনিয়ত। রেয়াল মাদ্রিদের বিখ্যাত সাদা জার্সিতে ৫৪২ বার মাঠে নেমেছেন। একাডেমি থেকে উঠে আসা মাদ্রিদ খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্লাবের হয়ে এর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দু’জন – একুশ শতকের দুই গ্রেট ইকার ক্যাসিয়াস ও রাউল গনযালেস। অথচ তাঁদের সাথে একই বন্ধনীতে থাকা তো দূরে থাক, অনেকের স্মৃতিতেই ঝাপসা হয়ে গেছেন। প্রতিভার কমতি থাকলেও কিছুটা খেয়ালি যে ছিলেন না সে কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। মাঝে মাঝেই মনোযোগে চিড় ধরতো, মেজাজ হারিয়ে ফেলাটাও অস্বাভাবিক ছিল না। ক্যারিয়ারজুড়ে ১০টি লাল কার্ড তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। তবে লম্বা চুলের গুতি ফুটবল মাঠটাকে আর দশজন ফুটবলারের চেয়ে আলাদাভাবে দেখতে পেতেন। অভাবনীয় সব পাসে প্রতিপক্ষ বোকা বনে যেত, এমনকি সতীর্থরাও ধন্দে পড়ে যেত। ২০০৫-০৬ মৌসুমে সেভিয়ার বিপক্ষে একটি অ্যাসিস্টের কথা না বললেই নয়। সেভিয়ার বক্স থেকে ক্লিয়ার হয়ে আসা বলটা নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা গড়বড় হয়ে গেলো, কিছুটা পিছিয়ে গেলো সেটা। ড্রপ খাওয়া বলটাকে গুতি ব্যাকহিল জাতীয় কিছুটা করলেন, তিনজন ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে সেটা জিদানের পায়ে চলে গেলো। অবধারিতভাবে তাঁর জোরালো শট জালের ঠিকানা খুঁজে পেলো। এই না হলে গুতি।

 

রেয়াল মাদ্রিদের সাথে গুতির ২৫ বছরের ছিন্ন হলো ২০১০ সালে, এরপর তুর্কি ক্লাব বেশিকতাসের হয়ে অবশ্য মাত্র এক মৌসুম খেলে ফুটবল ক্যারিয়ারের যবনিকা টেনে দেন গুতি। বিদায়ক্ষণে হয়তো ক্লাবের কাছ থেকে আরেকটু স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল তাঁর। জাতীয় দলেও খুব একটা সুযোগ মেলেনি কখনোই, মাত্র ১৩ “ক্যাপ”এর পরই থেমে গেছে সেই যাত্রা। তবে মাদ্রিদিস্তাদের মনে অবশ্য গুতি চিরদিনই থাকবেন। ১৪ নম্বর জার্সি গায়ে “Guti Haz.” তাঁদের প্রাণপ্রিয় “লস ব্লাঙ্কোস”দের হয়ে মাঠে মাতিয়ে গেছেন, দারুণ সব ডিফেন্সচেরা পাস দিয়ে প্রতিরক্ষণের রক্ষণকে ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। দিনশেষে “Star Power” কিংবা “তারকাখ্যাতি”ই কি সবকিছু নাকি!