• ফুটবল

এল ক্লাসিকো - স্পেনীশ দ্রুপদী লড়াই

পোস্টটি ১৫৭০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

"জাতীয়তা মুক্তির পথ খুলে দেয়" এ ধারণা থেকেই প্রত্যেক জাতি লালন করে তার নিজস্ব জাতীয়তা। সে ধারায় অবলম্বন হয় ধর্ম, বর্ণ, ভুখন্ড কিংবা ভাষা।

এসবের মাঝে অবশ্য সবচাইতে ব্যাতিক্রম সংযোজন একটা সবুজ মাঠের খেলা। কাতালান জাতীয়তা লালন করা ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা সেই ব্যাতিক্রমের বাহক। হোয়াইট আর্মি খ্যাত রিয়াল মাদ্রিদ অপরদিকে স্পেনীশ জাতীয়তার পতাকা উড়ায়।

মাদ্রিদ আর বার্সেলোনা স্পেনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর। ভূমধ্যসাগর ঘেঁষা কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা। নয়নাভিরাম এই শহর পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। অপরদিকে দেশের একেবারে মধ্যভাগে মাদ্রিদের অবস্থান, স্পেনের কেন্দ্র বা সরকারের প্রশাসনিক রাজধানী।

এই দুই শহরের প্রধান দুই ক্লাবের দৌরাত্ম্য ইতিহাস বিখ্যাত। এর কারণ হিসেবে যেমন আছে মাঠের প্রতিযোগিতা তেমন আছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব।


ইতিহাসে স্পেনীশ ফুটবল আর রাজনীতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯, স্পেন পার করে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এরপর ডিক্টেটর ফ্রাঙ্কোর শাসনামল, স্পেন বন্ধী হয় স্বৈরশাসনের শিকলে। প্রথম আঘাতটা পরে বার্সেলোনার উপর, কারণ হিসেবে বলা যায় ফ্রাঙ্কো বিরোধী প্রথম আওয়াজের অপরাধ। সে বছরই বার্সার সভাপতি জোসেপ সুনিয়োল বন্ধী হয়ে নিহত হন ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনীর হাতে।

এরপর আঘাতটা আরো শক্ত। নিষিদ্ধ হয় কাতালান ভাষা, নষ্ট করে দেওয়া হয় বহু গুরুত্বপূর্ণ বই।

Defiant-During-the-war-Franco-was-adamant-that-Spain-did-not-have-a-Jewish-problem

 (ছবি- জেনারেল ফ্রাঙ্কো)


দমন পীড়নে পিষ্ট হয়ে কাতালানরা মুক্তির উপায় হিসেবে বেছে নেন ক্লাব বার্সেলোনার স্টেডিয়ামকে। তখন থেকেই কাতালান স্বাধীনতার বুলি উচ্চারিত হয় ন্যু ক্যম্পে। একটা ক্লাব আর ক্লাবের স্টেডিয়াম হয়ে উঠে একটা জাতির কন্ঠস্বর। ক্লাব বার্সেলোনার গ্যালারিতে আজও তাই স্পষ্ট করে লিখা mes que un club যার বাংলা অর্থ দাড়ায় "ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু"।

Barca-miracle-5

(ছবি: ন্যু ক্যাম্পে উড়ছে কাতালান পতাকা এস্তেলাদা)


অপরদিকে ফ্রাঙ্কোর স্বেচ্ছাচারিতায় রিয়াল মাদ্রিদকে সময়ে সময়ে কিছু বিপদে পরতে হলেও তার মাত্রা ছিল তুলনামূলক কম। বরং নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার মাধ্যম হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদকে দেখা শুরু করেন ফ্রাঙ্কো। রাজনৈতিক ভাবে ব্যাবহার হতে শুরু হয় ক্লাবের স্টেডিয়াম। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মদদপুষ্ট হওয়ার জন্য স্টেডিয়াম সান্টিয়াগো বার্নাব্যুতে জড়ো হতেন স্পেনের অভিজাতরা। এতে লাভবান হতে শুরু করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

 

1506880675_395265_1506884974_noticia_normal

(ছবি - মাদ্রিদের স্টেডিয়ামে ভিভা এস্পানার জয়োগান)


রাজনৈতিকভাবে দুই মেরুতে পৌঁছে যাওয়া তখন থেকেই শুরু এই দুই ক্লাবের। এরপর প্রতিযোগিতা দিনদিন উত্তপ্তই হয়েছে। তারই মাঝে ইতিহাস সেরা খেলোয়াড় আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর দলবদলের ঘটনা এল-ক্লাসিকোর উত্তেজনা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ।


আর্জেন্টিনাতে স্টেফানোকে প্রথম আবিষ্কার করে বার্সেলোনার স্কাউট দল। বার্সেলোনার হাত ধরে ইউরোপে আগমন যখন প্রায় নিশ্চিত তখন ক্লাব মাদ্রিদও স্টেফানোকে পেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। আটঘাট বেঁধে মাদ্রিদও লেগে পরে স্টেফানোকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিতে। ট্রান্সফার হয়ে উঠে জটিল, সেই ট্রান্সফার গড়িয়েছে মামলা পর্যন্ত। অবশেষে ১৯৫৩ তে মাদ্রিদে যোগদান করেন স্টেফানো।

বাকিটা সবারই জানা, সাদা জার্সি পরিহিত স্টেফানো আজ অবদি মাদ্রিদের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে সম্মান কুড়ান। ছিলেন মাদ্রিদের আজীবন সম্মান সূচক সভাপতি পদে।

 

e406e154dc03029890d1595588f7cf52

(ছবি - মাদ্রিদের জার্সি গায়ে আলফ্রেডো ডি স্টেফানো)


স্পেনীশ দ্রুপদী লড়াই এরপরথেকেই আত্মসম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাড়ায়, যার গন্ডি পেরোয় মাঠ থেকে মাঠের বাইরে।

স্পেনীশ শব্দ "এল-ক্লাসিকো" ইংগিত দেয় এই ম্যাচের ঐশ্বর্যপূর্ণ ঐতিহ্যের দিকে। সময়ে সময়ে নতুন ঘটনাপ্রবাহে এই ক্লাসিক ম্যাচের মর্যাদায় লেগেছে নতুন নতুন পালক।

আর তাই ট্রফি কিংবা অন্যসকল প্রশ্ন এই ম্যাচে থাকে একপাশে, অন্যপাশে থাকে কেবলই জয়ের চিন্তা। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে প্রায়ই দেখা যায় দুদলের খেলোয়াড়দের বিবাদে জড়িয়ে যেতে, গ্যালারিতে বসে হুংকার ছুড়ে দর্শকরা জানান দেয় তারাও কম জাননা।

সাদা জার্সি পড়া মাদ্রিদের লস ব্লাঙ্কোস আর ব্লু-গ্রানা জার্সিধারী কিউলদের মাঠের লড়াইটা দর্শকদের কাছেও একইরকম উত্তেজনার চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া নব্বই মিনিট। দুদলের বাইশ জন খেলোয়াড় সবুজ গালিচায় ব্যাস্ত থাকেন গোলাকার ফুটবল নিয়ে, যে বলের সাথে লেগে থাকে রাজনীতি, সসংস্কৃতি কিংবা আত্মসম্মানের অস্তিত্ব। 


স্পেন তো বটেই, পুরো বিশ্ব এলক্লাসিকো প্রশ্নে ভাগ হয়ে যায় দুভাগে। স্পেনের রাজকীয় আভিজাত্য নাকি কাতালান শাসিত সমাজের আবেগ এই প্রশ্নে ফুটবল প্রেমিরা ভাগ হয়ে যায় মাদ্রিদিস্থা কিংবা কিউল হয়ে। ন্যু ক্যাম্প কিংবা সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রতি বছর যে ফুটবলীয় যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধের দর্শক পরিমাণ ৬৫ কোটিরও বেশি।


সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া ফুটবলের মহারণ এল-ক্লাসিকোর সৌন্দর্য্য মাপার চেয়ে বরং উপভোগ করাই শ্রেয়। তারকা আর মহাতারকাদের মিলনমেলা কিংবা ইউরোপ সেরা দুদলের ছন্দময়ী ফুটবলের নিঁখুত কারুকার্য দেখতে চোখ রাখতেই হবে ডিজিটাল পর্দায়। দিনশেষে এল-ক্লাসিকো ফুটবলেরই সৌন্দর্য্য।