• ফুটবল

হুলেন লোপেতেগি : উত্থান-পতনের এক অনন্য উদাহরণ

পোস্টটি ১৩২১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পরিচয় হিসেবে বলা যায় সাবেক স্পেন জাতীয়  ফুটবল দলের কোচ কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক ম্যানেজার। তবে তাতে সঠিক জাস্টিফাই করাটা সম্ভব হয়ে উঠেনা। শেষটা ঠিক ভালো কাটেনি এই দুই জায়গায়। তবে ট্যাক্টিক্স মাস্টার থেমে থাকেননি, ঘুরে দাড়িয়েছেন বারবার। কালো সূটবুট কিংবা ঢিলে টিশার্ট পরিহিত লোপেতেগির দেখা এখনও মিলে ডাগ আউটে, চলে ফুটবলীয় ইঞ্জিনিয়ারিং।        

 

জন্মসূত্রে স্পেনীশ, নামকরণেও স্পেনীশ রীতিনীতি। বেড়ে উঠা, ক্যারিয়ার প্রায় সবকিছুই স্পেনে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রিয়াল সোসিয়েদাদ একাডেমি থেকে শুরু করেন যাত্রা। এরপর রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দল কাস্তিয়ার গোলরক্ষক ছিলেন, খেলেছেন ৬১ ম্যাচ। সিনিয়র ক্যারিয়ার রঙিন হয়নি তেমন, মাদ্রিদের জ্যেষ্ঠদলের হয়ে মাঠে নামার সূযোগ হয়েছিলো মাত্র এক ম্যাচে। দলবদল করেছেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনাতেও পারি জমিয়েছেন। সেখানেও অবশ্য সূযোগ মেলেনি আশানুরূপ,    খেলেছেন কেবল ৫ ম্যাচ। তবে নিয়মিত সূযোগ পেয়েছিলেন লোগ্রোনিয়েস আর রায়ো ভায়েকানোর হয়ে। এই দুই দলের হয়ে দুইশোরও কিছু বেশি ম্যাচ খেলেছিলেন। সব মিলিয়ে প্রথম ডিভিশন লা লীগাতে খেলেছেন ১৪৯ ম্যাচ, দ্বিতীয় ডিভিশন সেগুন্দাতে খেলেছেন ১৬৮ ম্যাচ।  জাতীয় দলেও ছিলেন উপেক্ষিত, স্পেনের হয়ে  খেলতে পেরেছিলেন মাত্র এক ম্যাচ। সে পর্যন্তই খেলোয়াড়ি জীবন।

images (5)

 ছবি - বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে গোলরক্ষক লোপেতেগি।

 

খেলোয়াড় লোপেতেগি তেমন একটা পরিচয় করাতে পারেননি নিজেকে। নিজের পরিচয় জানান দিতে এরপর বেছে নিয়েছেন কোচিং ক্যারিয়ার। সেখানেও ব্যার্থতা সফলতার মিশেলে গল্প তৈরি করেছেন। পাসিং ফুটবলের পসরা দিয়ে মুগ্ধ করেছেন, মাঠে ট্যাক্টিকাল ব্যাটল উপহার দিয়ে দর্শকপ্রিয়ও হয়েছেন।    

 

প্রথম যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে স্পেনের যুব দলের এসিস্ট্যান্ট কোচ হিসেবে। হেড কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সে বছরেই। রায়ো ভায়েকানোর ডাগ আউটের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ছ মাস বাদেই।   তবে যাত্রা দীর্ঘায়িত হয়নি সেখানে, তখনকার সেকন্ড ডিভিশনের এই দল থেকে ছাঁটাই হন ব্যার্থতার দায়ে। এরপর লম্বা বিরতি দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার দায়িত্ব বুঝে নেন ২০০৮ সালে, ২০০৯ এসে সেই যাত্রারাও ইতি ঘটে।

২০১০ থেকে ২০১৪ সময়টা লোপেতেগির কোচিং ক্যারিয়ারের ব্রেকথ্রু বলা চলে, এই সময়টায় স্পেনীশ যুবা দলের হয়ে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন। জিতিয়েছেন ২০১২ অনুর্ধ্ব-১৯ ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ২০১৩ অনুর্ধ্ব-২১ ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ। পরপর দুইবার এমন সফলতা পাওয়া লোপেতেগির উপর নজর ফেলে পর্তুগীজ জায়ান্ট এফসি পোর্তো। ২০১৪ তে পোর্তোর দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ম্যানেজার হিসেবে  ছিলেন দুই বছর, বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছে অবশ্য সেখানে। দুই বছরে প্রায় কিছুই জেতা হয়নি, উল্টো হয়েছেন বায়ার্নের কাছে ৬-১ এ হিউমিলেশনের স্বীকার।

julen_lopetegui_with_thiago_alcantara_in_israel_last_summer

ছবি - অনুর্ধ ২১  চ্যম্পীয়নশীপ জয়ী কোচ হিসেবে লোপেতেগি।

 

উত্থান-পতনের সবরকম মাত্রা পার করা লোপেতেগির গল্পটা এরপর আরো নাটকীয়। পর্তুগাল থেকে ব্যার্থ হয়ে ফেরার পর স্পেনীশ ফুটবল এসোসিয়েশন আবারো ডেকে পাঠায় লোপেতেগিকে। ২০১৬ এর জুলাইয়ে স্পেন ন্যাশনাল দলের হেডকোচ হিসেবে নিয়োগ পান। যুবা দলের হয়ে পূর্ববর্তী সফলতাটাই হয়তো স্পেনীশ ফুটবল এসোসিয়েশনকে চালিত করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। ভিনসেণ্ট দেল বস্কের রেখে যাওয়া ডাগ আউটে দারানোটা লোপেতেগির জন্য খুব ভালো একটা সূযোগ ছিল, ইংলিশ ক্লাব ওলভস এর অফার ফিরিয়ে দিয়ে স্পেনকেই বেছে নিয়েছিলেন হয়তো সেজন্য।

 

প্রথম ম্যাচেই বেলজিয়ামের সাথে জয় দিয়ে খুব ভালো শুরুর জানান দিচ্ছিলেন পাগলাটে স্বভাবের এই মাস্টারমাইন্ড। ২০১৮ ওয়ার্ল্ডকাপ কোয়ালিফায়ার ক্যাম্পিং চলে সে ধারাতেই। কেবল এক ড্র এবং নয় ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপের টিকেট কাটে স্পেন। দুর্দান্ত ফর্ম দেখিয়ে ফেভারিট তকমা নিয়ে রাশিয়ায় পা রাখে রামোস, পিকেদের দল। শিরোপার দাবিদার দলটাকে নিয়ে যখন অন্যান্য দলের কোচেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তখনই বিধিবাম! বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর ঠিক দুইদিন আগে খবর আসে টুর্নামেন্ট শেষে রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানেজারিয়াল দায়িত্ব নিচ্ছেন লোপেতেগি। স্পেনীশ বোর্ড ভালোভাবে নিতে পারেনি সে খবর। সেদিনেই স্পেন ফুটবল এসোসিয়েশন চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয় লোপেতেগিকে। নিজের গোছানো দলটাকে বিশ্বকাপে না খেলাতে পারার আক্ষেপ নিয়ে সরে দাড়াতে হলো, হয়তো সাক্সেসের খুব কাছ থেকে ফিরে গিয়েছিলেন সে যাত্রায়! নিশ্চিত উত্তর আর পাওয়া হবেনা অবশ্য কখনোই।

GettyImages-971470976

ছবি - স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ব্যাস্ত লোপেতেগি।

 

এরপর জুনের ১৪ তারিখ বিকেলবেলায় সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রেজেন্ট হলেন নতুন মাদ্রিদ বস, দিলেন ইমোশনাল স্পীচ।

 

"Yesterday was, possibly since my mother died, the saddest day of my life, but today is the happiest day of my life."

মাদ্রিদের দায়িত্ব পেয়ে ঠিক কতটুকু উচ্ছ্বসিত ছিলেন সেটাই যেনো বুঝিয়ে দিলেন এই এক কথা দিয়ে।

1528980909_213486_1528998534_noticia_normal

ছবি - রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে অভিষিক্ত সময়।

 

লস ব্লাংকোসদের হয়ে তার প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ ছিল নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এতলেটিকো মাদ্রিদের সাথে। উইয়েফা সুপার কাপের সেই ম্যাচে হারতে হয়েছিলো তৎকালীন ইউরোপ সেরাদের। শুধু হার না, খেলানোর স্টাইল নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করে ভক্তরা। মাদ্রিদের চিরচেনা গতীময় কাউন্টার এটাকিং ফুটবল ছেড়ে লোপেতেগি প্রয়োগ করেন তার নিজস্ব পাসিং ফুটবল। ফলাফলটা ভালো হয়নি, মাঠে পাওয়া যায়নি সফলতা। ১৪ ম্যাচের মাত্র ছয়টিতে জয় তুলে ধুঁকতে থাকে রিয়াল মাদ্রিদ। তার উপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার কাছে ৫-১ এ হেরে মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের ইতি ঘটান লোপেতেগি। মাত্র চার মাসের মাথায় ব্যার্থতা নিয়ে বিতাড়িত হতে হয় এস্তাদিয়ো সান্তিয়াগো বার্নাব্যু থেকে।

 

সমালোচিত হতে থাকা লোপেতেগির জন্য এরপর আরেকটা সূযোগ আসে পরের মৌসুমে। স্পেনের আরেক ক্লাব সেভিয়া আমন্ত্রণ জানায় তাদের ডাগ আউটে, ২০১৯-২০ সিজনের দায়িত্ব বুঝে নেন সেবছরের জুন মাসে। আগের মৌসুমে লীগ টেবিলের ছয়ে থাকা সেভিয়ার দায়িত্বটা এবার একটু কঠিন ছিল। তবে সেটা খুব ভালোভাবে সামাল দিলেন। চ্যাম্পিয়নস লীগে কোয়ালিফাই করালেন লীগের টপ ফোরে থেকে। বাজিমাৎ করলেন অন্য জায়গায়, ইউরোপা লীগের ট্রফি তুললেন সেভিয়ার ঘরে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড,  ইন্টার মিলানের মত দলগুলোকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার দৌড়ে অসাধারণ ফুটবল শৈলি দেখালেন, হলেন ফ্যানফ্যাভারিট। নিখুঁত ফুটবলীয় কারুকার্য, শর্ট পাসের এটাকিং ফুটবল দর্শনে আবারো আলোচনায় ফিরলেন লোপেতেগি। যেন পতনের পর আবারো উত্থান, আর সেই উত্থানটা খুব দ্রতগামী।

el-elogio-menos-sincero-a-lopetegui-tras-ganar-la-europa-league

ছবি - ইউরোপা ট্রফি হাতে সেভিয়ার কোচ লোপেতেগি।

ব্যার্থতার গল্পগুলো নাকি সফল হওয়ার পরেই মুখরোচক হয়৷ সেভিয়ার হয়ে সফল ম্যানেজার হওয়ার পরে যেনো লোপেতেগির ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। ব্যার্থতা থেকে বারবার ফিরে ফিরে আসা লোপেতেগি ফুটবলের জন্য সৌন্দর্যই বটে, তার মতো মাস্টারমাইন্ড কোচদের জন্যইতো মাঠে ফুটবলের যুদ্ধটা জমে উঠে, উপভোগ্য হয় দু দলের কৌশলী লড়াই।