• ক্রিকেট

২০২০, করোনা এবং রাজাহীন রাজ্যের নতুন রাজা

পোস্টটি ৮৯০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০২০ সাল শেষের দিকে । এমন একটা বছর কাটলো যা কারোরই কোনো কল্পনাই ছিলো না । এক করোনা দুনিয়ার অর্ধেক জিনিসই পালটে দিয়েছে । ভালো জিনিসের থেকে খারাপ জিনিসই হয়েছে অনেক । আচ্ছা, ২০২০ সালের আমাদের সবচেয়ে খুশির দিনটার সেই মুহূর্তের কাছ থেকে ঘুরে আসি ।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, ২০২০।

চাইলে তুমি হারিয়ে যাও
রাজাহীন কোন রাজ্যে
জনশূন্য কোন প্রাচ্যে...

ভারত বনাম বাংলাদেশ, ফাইনাল ম্যাচ। বাংলাদেশ দলের কাপ্তান আকবর আলী, ১৮ বছরের তরুণ, টসে জিতে নিলেন বোলিং, চমক প্রথমেই। এরকম একটা ম্যাচ, যেটা কিনা ফাইনাল তাও নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার, যেখানে প্রতিপক্ষ চারবারের চ্যাম্পিয়ন তাই টার্গেটে ব্যাট করাটা কি কাজে দেবে? চেজিং এ ভালো ইন্ডিয়াকে তাদের দুর্বল জায়গা দিয়ে ঘায়েল করার প্রথম কৌশল, ওপেনারদেরকে তাড়াতাড়ি ফেরাতে পারলে তাদের ফ্লুক মিডল অর্ডারটা এক্সপোজড হয়ে যাবে এই কৌশল!

শরিফুল, লম্বা বাঁহাতি পেসারটা। মৃত্যুঞ্জয়ের অনুপস্থিতিতে পেস বোলিং এর নেতৃত্ব যার কাঁধে, প্রথম ওভার করতে আসলেন৷ ভারতীয়রা আমাদের অনেকের মতই নিশ্চিত ছিলো আমাদের বোলাররা চাপেই নুইয়ে যাবে, তারপর শরিফুলের প্রথম বল, গুড লেংথে পড়ে ব্যাটসম্যানকে বীট করে এওয়ে ফ্রম দ্যা বডি হয়ে কিপারের গ্লাভসে, সেকেন্ড বলেও ব্যাটসম্যান বীটেন - দ্যা মাইটি জয়সওয়াল। দ্বিতীয় বলের পরে ব্যাটসম্যানের দিকে তেড়ে আসা শরিফুলের শরিরী ভাষাই বুঝিয়ে দিলো - They have  planned something else india never even thought!!!

সেই চমকে ইন্ডিয়া সেই যে প্রেশারে পড়লো, তাদের যেতে হলো প্ল্যান বি'তে - stay in the middle as much as possible, Don't care about runs now. জয়সওয়াল ঠান্ডা মাথায় তাই করে যাচ্ছিলো, শরিফুল-সাকিবের চেপে ধরা আগ্রাসনে খোলসবন্দী ভারত যখন উইকেট টেকানোর কৌশলের দ্বারস্থ, তখনি আকবরের আরেকটা গেরিলা কৌশল। টুর্নামেন্টে এর আগে এক ওভার বলও না করা অভিষেক দাসকে নিয়ে আসলেন আক্রমণে, হাঁসফাস করতে থাকা সাক্সেনা তখন একটু অক্সিজেনের খোঁজে ব্যাটটা চালালেন, আর জয়ী হলো আকবরের গেরিলা কৌশলের, পয়েন্টে ধরা পড়লেন সাক্সেনা।

সেই যে চাপের শুরু, সেখান থেকে আর বেরই হতে পারেনি টিম ইন্ডিয়া। দুর্বল, চাপ নিতে না পারা বাংলাদেশ আশা করছিলো তারা, কিন্তু না, এ তো সিলেবাসের বাইরের অচেনা আগ্রাসী বাংলাদেশ! এই বাংলাদেশকে রুখবার সাধ্য তাদের আছে, এই বিশ্বাসে ফাটল ধরার শুরুটা হয়েছিলো তখনই!

শরিফুল, সাকিব, অভিষেকদের পেসের সাথে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা স্পিনার রাকিবুল ভুগিয়েই গেছেন, আর তাতেই সর্বশেষ ১২টা ওডিআই ম্যাচে প্রথম অলআউট হয়েছে ইন্ডিয়া। তাদের আত্মবিশ্বাসের ফাকফোকর তখন দৃশ্যমান! তাইতো ১৭৭ এই মুখ থুবড়ে পড়া আর আমাদের আশার আলোটা ৪০ থেকে ১১০ ওয়াট হয়ে যাওয়া।

টার্গেট ১৭৮ , খুব বেশি না। গ্যালারীতে বাংলাদেশীরা রীতিমতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে । তবে ত্যাগী, আকাশ সিং কিংবা বিষ্ণোইদের নিয়ে গড়া ইন্ডিয়ান বোলিং টুর্নামেন্টেরই অন্যতম সেরা ছিলো। এই টার্গেটকেই তারা আকাশসম বানাতে পারে এটাও অমূলক চিন্তা ছিলোনা। তাই বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামার আগে একটু ভয় কাজ করছিলোনা যে তাওনা৷ অথচ ইমন আর তামিম নেমেই কি সুন্দর সেই আক্রমণের ধারা বজায় রাখলো, ত্যাগী আর আকাশ সিংকে পাত্তাই দিলোনা।

৮.৫ ওভারে কিনা ৫০ রানের ওপেনিং জুটি!!

ট্রফি হাতে আকবরের ছবি তখন মাথায় ঘুরছে বারবার, ভেতরে ভেতরে জ্যান্ত উত্তেজনা। অন্যকিছুইতেই মনও বসছেনা!

বোলিংইয়ে আসলো বিষ্ণুয় , এবং খেলা পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলো ! তামিম, জয়, হৃদয় আর শাহাদাত, চারজনকেই প্যাভিলিয়নে পাঠালেন, স্কোরবোর্ডে মাত্র ৬৫ রান, খেলার মোড়টাই ঘুরে গেলো।

এরপর , হ্যামস্ট্রিঙ্গয়ে পড়ে মাঠের বাহিরে ওপেনার ইমন ।

এবার আপনি হাতে টিভির রিমোট নিলেন , সুইচ অফ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। বাংলাদেশ তো হেরে গেলো!

ক্যাপ্টেন ক্রাউস যেভাবে গ্রে হাউন্ড নিয়ে জার্মান সাবমেরিন ওলফের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করা উত্তর আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন তেমনি আমাদের একজন সেদিন পচেফস্ট্রুমে পুরো দলের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ভারতীইয় বোলিং লাইনাপের সাথে।

আকবর আলী, দ্যা ক্যাপ্টেন !!

জেনে রাখবেন যেখানে আপনি হতাশ হয়ে ফোনটা অফ করে দেবেন, টিভির চ্যানেলটা চেঞ্জ করে দেবেন, খেলা না দেখে বাসার বাইরে যাবেন, এরপর এসে শুনবেন আকবর আলী আপনার দলকে জিতিয়ে দিয়ে এসেছে! 

৬৫/৪ (ওইসময়ে আদতে ৬৫/৫ হবে) এর পর জুটি বাধলেন আকবর আর শামীম। পাড়ি দিতে হবে লম্বা পথ। বিষ্ণোই বোলিং এ, কীপার, স্লিপ, ক্লোজ-ইন লেগ, ক্লোজ ইন অফ মিলিয়ে ব্যাটসম্যানকে চেপে ধরা হলো, সবাই মিলে ব্যাটসম্যানকে স্লেজিংয়ের নামে গালাগালি করতে থাকলো, আম্পায়ারকে মুহর্মূহ আপিল করে ব্যাতিব্যাস্ত রাখা হলো, ব্যাটসম্যানের জন্য নরক বানিয়ে ফেলা হলো। আমরা দর্শকরাই সেটা দেখে আশার চেরাগ ফু দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছিলাম। এমনকী আমাদের সিনিয়র টিমও তখন হাল ছেড়ে দিতো (প্রুভেন), কিন্তু সেই অবস্থাতে ওসব হাল টাল ছাড়া, প্রতিপক্ষের গালিগালাজ শোনার টাইম নাই ভাব করে আকবর আলী যেভাবে একের পর এক রক সলিড ডিফেন্স করে গেলেন, সেটা ইতিহাসের কোথাও লেখা না থাকলেও আমরা যারা খেলা দেখেছি, আমাদের মাঝেই প্রজন্মান্তরে রূপকথা হয়ে থাকবে!

চলে গেলো শামীম, আসলো অভিষেক, সেও একটু পর আউট। অগত্যা সেই ইমনকেই আবার নামতে হলো, নেমেই আকবরের সাথে পাল্টা কৌশলে খেলতে লাগলেন। দেখাতে থাকলেন ম্যাচিউরিটির চূড়ান্ত নিদর্শন। বিষ্ণোইকে খেলতে পারছিনাতো? ওকে তাকে খেলারই দরকার নাই, তার ওভারগুলো পার করে দাও।

একটা একটা করে বল গুনি, আমি গুনি, আপনি গুনেন, ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান বিশপ গুনছেন, আম্পায়ারতো গুনছেনই, আরো একজন গুণে যাচ্ছিলেন - আকবর আলী, মাঠে দাড়িয়ে। অবশেষে চার উইকেটের বেশী না দিয়ে বিষ্ণোই এর বোলিং কোটা শেষ হলো, এবার শুরু হলো তিয়াগীর তাণ্ডব, মাঝে ব্যাট চালাতে গিয়ে ভরসার শেষ প্রদীপ ইমন আউট হয়ে গেছে জয়সওয়ালের বলে। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে ওই এক আকবরই, নামলেন রাকিবুল। আমরা বল আর রান গোণা বাদ দিয়ে গুনতে বসলাম বাকী তিন উইকেট কখন যাবে। জিততে লাগে ৩৫ রান যেটার আসল প্রভাব তখন ১০০ রানের মতই। আবারও সেই ক্যালকুলেটিভ ক্রিকেট, আকবর-রাকিবুল মিলে পার করে দিলো তিয়াগীর বোলিং কোটা, ইন্ডিয়ান ফিফথ বোলারের অভাবটা তখন এক্সপোজড, চাপটা ইন্ডিয়ার উপর শিফট হচ্ছে, ভীতু আমরা তখনো ভয়েই কাবু হয়ে গেছি।

ঘরপোড়া গরুতো, তখনো মেঘের ভয়ই করে যাচ্ছিলাম।

আকবরকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা হচ্ছিলো, বল খেলার জন্য টেম্পটেড করা হচ্ছিলো, রাগানো হচ্ছিলো, উত্যক্ত করছিলো ইন্ডিয়ানরা, তাদের ভেতরকার কদর্যতার সর্বোচ্চটাই দেখিয়ে দিয়েছিলো তারা, স্পোর্টসম্যানশীপ নামে কিছুতো অনেক দূরের ব্যাপার ; কিন্তু আকবর ছিলো স্থির, আকবর ছিলো নিজের উপর বিশ্বস্ত, আকবরের চোখে ছিলো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রতিজ্ঞা। টানা ২৫/৩০ বল ডট দেয়ার পর যখন একটা সিংগেল নিলো, সেটাকেও ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে এপ্রিশিয়েট করে হচ্ছিলো তখন। প্রেশারটা বাংলাদেশকে দিতে গিয়ে উল্টো নিজেদের উপরেই ব্যাকফায়ার করা ইন্ডিয়ান তাই এক্সট্রাও দিয়েছিলো কোনো কার্পণ্য না করে। টুকটুক করে তাই আকবররা জয়ের কাছাকাছি চলে আসে, শেষের বৃষ্টির ঝাপটা তাতে বরং রংই দিয়েছিলো।

রাকিবুলের শেষ সিংগেলটাতে তাইতো অমরত্বের সুখ পাওয়া গিয়েছিলো, আকবরের, রাকিবুলদের আর বছরের বছর অল্প সাফল্যে সন্তুষ্ট হয়ে অধিক ব্যর্থতা কাঁধে মেনে নেয়া পাগল আমাদের (দর্শকরা)!! 

ফলাফল আমরা চ্যাম্পিয়ন , বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন । রাজাহীন রাজ্যের নতুন রাজা ।