দ্বৈত সত্তা, এক ফুটবল শিল্পী
পোস্টটি ১৫২৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
তুরিনের স্তাদে দেল্লে আল্পি। ১৯৯০ সালের জুন মাস। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি, তাও আবার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে। উত্তেজনার পারদটা ম্যাচের আগেই বেশ উঁচুতে ছিল, কিন্তু বাস্তবে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বৈপরীত্যটা আরো একবার টের পাওয়া যাচ্ছিল। গ্যালারির ষাট হাজার দর্শকের ঠিক মন ভরাতে পারছিল না দক্ষিণ আমেরিকা ডার্বি, গোল না হলে ফুটবলে আবার মজা কীসের? শারীরিক রেষারেষি হচ্ছিল মাঠে, নিয়মিত বিরতিতে রেফারির বাঁশিতে ফুঁও পড়ছিল। একের পর এক আক্রমণে বারবার আর্জেন্টাইন রক্ষণকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল সেলেসাওরা, কিন্তু আলবিসেলেস্তে গোলপ্রহরী সার্জিও গয়কোচয়া সেদিন পরাস্ত হতে নারাজ। দুঙ্গার হেড পোস্টে লিগে ফিরে এলো, কারেকার শট দারুণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দিলেন গয়কোচয়া। প্রতিপক্ষকে প্রতি-আক্রমণে আহত করার পরিকল্পনা ছিল আকাশি-সাদাদের কোচ কার্লোস বিলার্দোর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ঘটনাটা ঘটলো ৮১তম মিনিটে।
পুরো ম্যাচেই নিষ্প্রাণ থাকা আর্জেন্টিনার "১০ নম্বর" গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন যেন। একটু আগেই পেনাল্টি বক্সে দারুণ এক স্লাইড করে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার ক্যানিজিয়াকে থামিয়েছেন রিকার্ডো গোমেজ। ব্রাজিলিয়ানদের পা ঘুরে সেই বল এলো আর্জেন্টাইন মাঝমাঠে। প্রতিপক্ষের গোলবার থেকে ৪০ গজ দূরে দলের দশ নম্বর পায়ে বল পেতেই একজনকে পরাস্ত করলেন। আলেমাওকে ট্যাকেল করার সুযোগই দিলেন না, এরপর দুঙ্গার ট্যাকেলকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চললেন। অন্য কেউ হলে হয়তো তাকে আটকাতে একজন সেন্টারব্যাক এগিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি যে ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বল নিয়ে ভাবলেশহীনভাবে এগিয়েই চলেছেন, যেন ড্রিবলিং করার জন্যই তাঁর এই দুনিয়ায় আসা। পুরো ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সই বিপদ আঁচ করে এগিয়ে এলো। বাঁ প্রান্তে ক্লদিও ক্যানিজিয়া ধারেকাছে কেউ নেই। চোখের কোণা দিয়ে ক্যানিজিয়াকে একবার দেখে নিলেন ম্যারাডোনা, এরিয়া ফরটিনে ঢুকেই ডান পায়ের পাসে ক্যানিজিয়ার পায়ে বল ঠেলে দিলেন। বল নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্য একবার টাচ দিলেন ক্যানিজিয়া, আগুয়ান ক্লদিও তাফারেলকে কাটিয়ে নিতে আরেকটা টাচ নিলেন, এরপর ফাঁকা পোস্টে বাঁ পায়ের শটে লক্ষ্যভেদ। উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়লো আলবিসেলেস্তেরা। ঐ এক গোলেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ - বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা শেষ আটে জায়গা করে নিলো আর টানা তৃতীয়বারের মতো আগেভাগেই দেশে ফেরার বিমান ধরতে হলো ব্রাজিলকে। ম্যাচশেষে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিতে দিতে কি আট বছর আগের বার্সেলোনার সেই বিকেলটার কথা মনে পড়েছিল ম্যারাডোনার? সেদিনেও বিশ্বকাপের ম্যাচ ছিল, সামনে ছিল এই ব্রাজিলই। সেমিফাইনালে জেতার জন্য আর্জেন্টিনাকে জিততেই হতো। তরুণ ম্যারাডোনা সেদিন একেবারেই নিষ্প্রভ ছিলেন। জিকো-সক্রেটিস-ফ্যালকাওদের কাছে তিন গোলে হেরে গিয়েছিল তাঁর দল। চিরায়ত ম্যারাডোনীয় কায়দায় মেজাজ ধরে না রাখতে পেরে ব্রাজিলের জোয়াও বাতিস্তাকে লাথি মেরে বসেছিলেন, রেফারির লাল কার্ড বের করাটা তাই অবধারিতই ছিল। আট বছর পর সেদিনকার খলনায়কই আজ নায়ক হয়ে গেলেন। আসলে ম্যারাডোনা এমনই। আর্জেন্টিনার "এল পিবে ডি অরো" (সোনার ছেলে) তে খাঁদ মেশানো ছিল। কে না জানে এই খাঁদ আছে বলেই সোনার এমন কদর। ফুটবল মাঠের দারুণ সব কীর্তিতে পত্রিকার প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন, আবার মাঠ-মাঠের বাইরে বাইরের নানা বিতর্কে জড়িয়েও শিরোনাম হয়েছেন অসংখ্যবার। ফুটবল পায়ে অতিমানবীয় সব কাণ্ড আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি শেষমেশ স্রেফ রক্ত-মাংসেরই একজন মানুষ, কারণ মানুষই তো ভুল করে। সে কারণেই হয়তো তিনি এতোটা জনপ্রিয়।
বুয়েনোস আইরেসের জন্ম তাঁর, কিন্তু ম্যারাডোনাকে আসলে ধর্ম,গোষ্ঠী কিংবা জাতির গণ্ডিতে আটকানো যাবে না। কঙ্গোর কাঠুরে পল্লিতে, ফিনল্যান্ডের জেলেপাড়ায় কিংবা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে ম্যারাডোনার নাম একবারও শোনেনি এমন লোকের দেখা পাওয়া ভার। পেলের আমলে টিভিতে সম্প্রচারের সুযোগ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল, ম্যারাডোনার সময় আসতে আসতে সেই টিভিগুলোই রঙিন হয়ে গেছে। আশির দশকের প্রজন্মের কাছে ডিয়েগো ম্যারাডোনা তাই এক আবেগের নাম। দক্ষিণ আমেরিকান রক্তেই যেন জীবনটাকে উপভোগ করার মন্ত্রটা মিশে আছে। ম্যারাডোনাও এমনই ছিলেন, অনুশীলন করার সময়ে তাঁর আমুদে ভাবটা দারুণ উপভোগ্য ছিল। তবে তখনকার আমলে ফুটবল খেলাটা অবশ্য শারীরিকভাবে সুখকর কিছু ছিলো না। একটু বৃষ্টি হলেই পাড়ার মাঠের মতো কাঁদা মাখামাখি হয়ে চোটের জন্য মৃত্যফাঁদ তৈরি হয়ে যেত, পেছন থেকে ট্যাকেল করাটা জায়েজ ছিল। তাই পুরো দলকে পংগু করতে ম্যারাডোনাকেই টার্গেট করা হতো। তবুও ফুটবল খেলাটার প্রতি ভালোবাসাটার কমতি ছিল না, সমসাময়িকদের মতো ম্যারাডোনাও আঘাত সহ্য করে খেলে যেতেন। মাঠের বাইরের জীবনেও "উপভোগ" মন্ত্র যপে গিয়েছেন, মাদক কিংবা সুরার সাথে আপোষ করেননি, সিগারও পছন্দ ছিল খুব। প্রথম ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়ের রেকর্ডটা দু'বার ভেঙেছেন - বার্সেলোনা (১৯৮২, ৫ মিলিয়ন ইউরো), নাপোলি (১৯৮৪, ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো)। নেপলস শহরটা ততোদিন পর্যন্ত বিখ্যাত ছিল রন্ধনশৈলীর জন্য। পিজ্জা আর পাস্তা নামক সুস্বাদু খাবার দুটোকে বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এই নিয়োপলিতানেরাই। তবে দক্ষিণ ইতালির শহরটার কুখ্যাতিও ছিল, সেটা আমেরিকান মাফিয়াদের উতসভূমি হওয়ার জন্য। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে এই ম্যারাডোনার হাত ধরে বিশ্বের ফুটবল মানচিত্রে জায়গা করে নিলো নাপোলি। মিলানের দুই কুলীন ক্লাবকে দর্শক বানিয়ে দু'বার স্কুদেত্তো জিতে নিলো পারতেনোপেইরা, এর মাঝে ইউয়েফা কাপ ও কোপ্পা ইতালিয়াও ঘরে তুলে ফেললো। নেপলস শহরে তাই ম্যারাডোনার স্থানটা এতোটা উঁচুতেতে যে তাঁকে ধরা যায় না, চাইলেই যায় না ছোঁয়া। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ কেবল ম্যারাডোনারই ছিল, আবার '৯৪ বিশ্বকাপে এসে এফেড্রিন নামক ড্রাগের কারণে নিষিদ্ধ হলেন। সাধারণ মানুষ হিসেবে আরো অনেক কিছুর মতোই সত্যটা জানার অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত আমরা, তাই আসলে কী হয়েছিল সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনাই করা সম্ভব। '৮৬ তে সোনার ট্রফি নিয়ে হেসেছেন, '৯০ তে এক পেনাল্টি শটেই সেই ট্রফির স্বপ্ন চুরমার। ম্যারাডোনা মানেই তাই উত্থান-পতনের কড়চা, নাটকীয়তা-বিতর্ক-ভালোবাসা সেখানে হাত ধরাধরি করে চলে।
১৯ শতকের শেষভাগে ইংরেক লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের "ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড" উপন্যাসটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডক্টর জেকিল নিতান্তই ভদ্রগোছের মানুষ, কিন্তু এক ওষুধের প্রভাবে মাঝেমাঝে তাঁর "অল্টার ইগো" হিংস্র, খুনে মানসিকতার মিস্টার হাইড বেরিয়ে আসে। স্টিভেনসন সাহেব আসলে প্রতিটা মানুষের মধ্যে চলমান ভালো-মন্দের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতি ইংগিত করেছেন। ম্যারাডোনাকেই দেখলেও সেই জেকিল-হাইডকে চিনতে ভুল হয় না। ফুটবল মাঠের শিল্পী জেকিল ম্যারাডোনা, মাঠের বাইরে গেলেই উদ্দাম হাইড হয়ে যেতেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে করা "হ্যান্ড অফ গড" আর "গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি" দিকে তাকালেই যেন সবকিছু পষ্টভাবে বোঝা যায়। তাই এতো দিন পরেও ম্যারাডোনাকে মানুষ মনে রেখেছে। চিরপ্রয়াণেও তাঁর কীর্তির মহিমাও এতোটুকু আঁচড় লেগেনি। ম্যারাডোনা "জিনিয়াস" ছিলেন, কখনোবা "ব্যাডবয়"; হিরো আবার ভিলেন। কিন্তু দিনশেষে দোষে-গুণে শুধুই একজন মানুষ। স্টিভেনসন লোকটা তো এমন মানুষের কথাই বলে গেছেন।
- 0 মন্তব্য