• ক্রিকেট

রকিবুল হাসান এবং তাঁর সাহসিকতার গল্প!

পোস্টটি ৩৫৬১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সময়টা পাকিস্তান আমল, চলছে আইয়ুব খানের শাসনামল।

এক বাঙালি তরুণ ক্রিকেটার স্থান পেয়েছেন পাকিস্তান অনুর্ধ্ব-২৫ দলের ক্যাম্পে। একজন বাঙালি ক্রিকেটারের জন্য পাকিস্তান দলের হয়ে খেলাটা তখন কল্পনার চেয়েও বেশি কিছু। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাপটে কালেভদ্রে কোনো বাঙালি ক্রিকেটারকে পাকিস্তানি জার্সি গায়ে দেখা যেত, সেখানে এক তরুণ আছেন এর হাতছোয়া দূরত্বে।     

ক্যাম্পের মধ্যে সেদিন চলছিল আড্ডা। আড্ডার এক পর্যায়ে চলে এল রাজনীতি। হঠাৎ ক্যাম্পে থাকা বাঁহাতি স্পিনার, পেশোয়ারের কামরান রশীদ বলে উঠল,

'আইয়ুব খান মেড আ মিসটেক। হি শুড কিলড দ্য *** মুজিব।'    

বাক্যটা শেষ করার এক সেকেন্ডও পেরোয়নি। ক্যাম্পে থাকা সেই বাঙালি ক্রিকেটার উত্তেজিত মূর্তি ধারণ করলেন। কামরানের উদ্দেশ্যে মারলেন এক সপাট ঘুষি!

ঘুষি খেয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেল কামরান। তাতেই শেষ নয়, সে বাঙালি ক্রিকেটার শুরু করলেন ভয়ংকর পিটুনি। হাতের কাছে যা পেলেন, তা দিয়েই চলতে লাগল উপর্যপুরি আঘাত। ততক্ষণে রক্তাক্ত কামরান জীবনভিক্ষা চাইতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের বুকে, করাচিতে বসে একজন বাঙালির এই রুদ্রমূর্তি দেখে যেন বিস্ময়ে, আতঙ্কে পাথর হয়ে রইল পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। 

এরকম একটা দুঃসাহসী কাজের পর ক্যারিয়ার শঙ্কার মুখে পড়ে গিয়েছিল সে যুবকটির। ডাকা হলো কোর্ট মার্শাল। মেজর সুজা জিজ্ঞেস করলেন, এরকম করার কারণটা কী।  

যুবকটির উত্তর শুনতে চান? তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলে উঠলেন,

'ও আমার নেতাকে গালি দিয়েছে, বাঙালির নেতাকে গালি দিয়েছে। যতবার গালি দেবে, ততবার আমি এমন করব।'

নিজের বাঙালিত্ব নিয়ে গর্ব করা এ যুবকটির নাম ইতোমধ্যে জানার ইচ্ছা জেগেছে? তো জেনে রাখুন, তাঁর নাম রকিবুল হাসান; বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক।

ক্রিকেট নিয়ে টিভিতে চলা নানা টকশোতে তাঁকে আমরা সবাই দেখেছি। দেখেছি সাকিব-তামিমদের আতশি কাচের নিচে দাঁড় করাতে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ রেফারি হিসেবেও তাঁকে আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু সেসকল পরিচয়ের উর্ধ্বে, তিনি একজন গর্বিত, সাহসী বাঙালি! যার সাহসিকতার পরিচয় আরেকবার পেয়েছে পাকিস্তানিরা, সেটা পুরো বিশ্ববাসীর সামনে।  

সময়টা ১৯৭১ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক একাদশ বনাম পাকিস্তান একাদশের অনানুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচ। দলে সুযোগ পেয়েছেন আমাদের রকিবুল। যে দলের হয়ে খেলার স্বপ্নে তিনি বিভোর ছিলেন আজীবন, সে মূহুর্ত এখন খুব কাছে। ঠিক তখন একটা বিষয় জানতে পেরে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন।

২৫শে ফেব্রুয়ারি,ম্যাচের আগের দিন। পাকিস্তান দলের সব খেলোয়াড়দের দেওয়া হয়েছে 'গ্রে নিকোলস' ব্র্যান্ডের ব্যাট; কিন্তু ক্ষোভের ব্যাপার হলো, সেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ার চিহ্ন লাগানো!  

সদ্য জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া রকিবুলের মাথায় রক্ত উঠে গেল। এইতো সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে; বাঙালির দল জিতে গেছে নির্বাচনে। এখন বাঙালির সরকার গঠনের অপেক্ষা। এমন সময়ে ব্যাটে আইয়ুব খানের প্রতীক নিয়ে ব্যাটিং করতে নামতে হবে? হ্যাঁ; এসময় অন্য কেউ হলে হয়তো নিজের উদীয়মান ক্যারিয়ারের কথাই মাথায় আসতো। কিন্তু মনে রাখবেন, নামটা রকিবুল। 

রাতেই হুট করে খেলোয়াড়দের জন্য নির্ধারিত পূর্বাণী হোটেল থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন বন্ধু শেখ কামালের কাছে। পরামর্শে বসলেন—কী করা যায়? শেখ কামাল বুদ্ধি দিলেন,

'তলোয়ারের বদলে তোর গান অ্যান্ড মুরের ব্যাটে জয় বাংলা লেখা স্টিকার লাগিয়ে খেলতে নাম!' 

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। জোগাড় করা হলো স্টিকার। যারা ভেতরের ঘটনা জানত, উত্তেজনায় সবাই ছটফট করছে। কী জানি কী হয়! কিন্তু ছেলেটি নির্বিকার। পাকিদের দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়া লাগবে না!

অবশেষে এল সেই ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল। পাকিস্তানি আজমত রানাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটিং শুরু করতে নামল ছেলেটি। একজন ফটোগ্রাফার প্রথম খেয়াল করলেন ব্যাপারটা। ছুটে এলেন ছবি তুলতে। মুহূর্তে স্টেডিয়াম জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল—'জয় বাংলা' স্টিকার নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে খেলছে একটি বাঙালি ছেলে। স্টেডিয়াম জুড়ে উঠল সেই অবিস্মরণীয় স্লোগান—জ য় বা ং লা, জ য় বা ং লা! 

ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা মুহুর্তে মুহুর্তে বন্দি করছে রকিবুলের ব্যাটে লেখা জয় বাংলাকে। বাংলাদেশের ‘ইত্তেফাক’ থেকে শুরু করে ‘লন্ডন টাইমস’, সকল খ্যাতনামা পত্রিকায় ছাপা হলো খবর: এক বাঙালি ক্রিকেটার ব্যাট করতে নেমেছেন, জয় বাংলা প্রতীক নিয়ে!  

সেই 'জয় বাংলা' স্টিকারের ফল হিসেবে জীবনটাই দিতে হচ্ছিল রকিবুল হাসানকে। ম্যাচ চলা অবস্থাতেই সংসদ ভেঙে গেল, আগুন জ্বলে উঠল শহরে, খবর পৌঁছাতে স্টেডিয়ামের প্যান্ডেলেও লাগল আগুন। পুরো নগরীই তখন জ্বলছে, ক্রিকেট কি আর বাঁচে। বাকি পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা তখন ক্যান্টমেন্টে আত্মগোপন করল। আর রকিবুল মিশে গেলেন ছাত্র-জনতার মিছিলে। শোকজের পর ওয়ারেন্ট জারি করা হলো রকিবুলের জন্য, দেখা মাত্র গ্রেফতার! অথচ রকিবুল তখন কিছুই জানেন না।  

পলায়নপর অবস্থায় থাকতে থাকতে চলে এল ৭ মার্চ; জাতি পেয়ে গেল মুক্তির দিশা। রকিবুল বুঝে গেলেন, যুদ্ধেই যেতে হবে। ২৫ মার্চ ঢাকায় নামল পাকিস্তানি বাহিনী; রকিবুল জানলেন, তাঁকে খোঁজা হচ্ছে মেরে ফেলার জন্য। পরিবার চলে গেল গোপালগঞ্জে নিজেদের বাড়িতে; আর রকিবুল হাসানরা দুই ভাই বাবার সার্ভিস রিভলবার হাতিয়ে নিয়ে চললেন ট্রেনিং ক্যাম্পে। ছুটে চললেন সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের গন্তব্যে, যে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন জহির আব্বাসকে, সেই ম্যাচের দিন।      

ম্যাচ ইতোমধ্যে পণ্ড। জহির আব্বাসরা ফিরে যাচ্ছেন পাকিস্তানে। যাওয়ার সময় জহির হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

'রকিবুল, করাচিতেই দেখা হবে আবার।'   

রকিবুল তখন দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন,

'অবশ্যই। তবে আমার সঙ্গে তখন নতুন পাসপোর্ট থাকবে'।

দৃঢ়চেতা সেই রকিবুল হাসানের জন্মদিন ছিল এ মাসে, পহেলা জানুয়ারি। তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যে দেশপ্রেমের নিদর্শন তিনি রেখে গিয়েছিলেন আমাদের সামনে, সে দেশপ্রেম যেন বুকে অটুট রাখতে পারি আজন্ম; এটাই রইল প্রত্যাশা।      

 

 

তথ্যসূত্র: 

১। রকিবুল হাসানের অনন্য প্রতিবাদ

২। ‘জয় বাংলা’ ব্যাপারটি আমার ক্রিকেটার পরিচয়ের সমার্থকই হয়ে গেছে