• ফুটবল

জন্মদিনের শুভেচ্ছা ক্রিস!

পোস্টটি ১১৩৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রান-আপের মাঝে একবার থামলেন, এরপর কয়েক পা এগিয়ে ডান পায়ের শট। পেতর চেক অবশ্য আন্দাজ করে ফেলেছিলেন, ডানে ঝুঁকে শট ঠেকিয়ে দিলেন। মস্কোতে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতার " ইংলিশ" ফাইনালের পেনাল্টি শ্যুট আউটে তখন পর্যন্ত ২-২ সমতা ছিল। হতাশায় দু'হাতে মুখ ডাকলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাত নম্বর। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল কী? ঐ মৌসুমে ৪২ বার জালে বল জড়িয়েছেন, লুঝনিকিতে "রেড ডেভিল"রা এগিয়েও গিয়েছিল তাঁর দুর্দান্ত এক হেডে। কনকনে ঠাণ্ডা রাশিয়া থেকে প্রায় তিন হাজার মাইল দূরের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দেশের লোক তিনি, সেখানে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের চেয়েও বিখ্যাত তিনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এমনিতে দুনিয়ার সবচেয়ে আশীর্বাদপুষ্ট ক্লাব, সে রাতেও স্টেডিয়ামের অর্ধেকটা রাঙা হয়ে ছিল। অথচ সেই মুহূর্তটায় ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো দস সান্তোস আভেইরো একা, বড্ড একা। তবে ভাগ্যবিধাতা যেন তাঁর চিত্রনাট্য আগে থেকেই লিখে রেখেছিলেন, জীবনের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। অনেক নাটকীয়তা শেষে ফন ডার সার আনেলকার শট ঠেকিয়ে দিলেন, ইউনাইটেডের ফুটবলারেরা ডাচ কিংবদন্তিকে আলিঙ্গনে বাঁধতে ছুটছেন। রোনালদো অবশ্য মুখ ঢেকে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। অভিব্যক্তিতে উছ্বাসের উল্লাস উপচিয়ে পড়ছিল, আনন্দের অশ্রু সাথে ঝরছিল স্বস্তিও। সেটাই প্রথমবার ছিল, এরপর ইউরোপসেরার ট্রফিটা আরো চারবার আসমানের পানে তুলে ধরার সুযোগ হয়েছে, দেশের ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ট্রফিটাও। উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের বৃষ্টির বিষণ্ণতা ছেড়ে রোদ ঝলমলে মাদ্রিদে এসেছিলেন, এরপর নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে আল্পসের কোলঘেঁষা তুরিনে। যেখানেই গেছেন গোল করেছেন, করছেন, করবেন। রেকর্ডবুকের পাতাগুলোকে উল্টে-পাল্টে দিচ্ছেন। জিতেছেন শিরোপা, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যক্তিগত স্বীকৃতি। অর্থ, খ্যাতি, বিত্ত, লোকের ভালোবাসা - আজ কমতি নেই কিছুরই। তবুও সাফল্যের ক্ষুধা যে কমে না, সেটা কি তিনি ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো বলেই?

 

1479831883_493006_1479832058_noticia_normal



অথচ মারিয়া দলোরেস তাঁকে পৃথিবীতেই আনতে চাননি। টানাটানির সংসারে মদ্যপ স্বামী আর তিন-তিনটা সন্তান ছিল তাঁর, মারিয়া চাননি তাঁর চতুর্থ সন্তান নিঠুর পৃথিবীর আলো দেখুক। গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন, ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও নিজেই সেই চেষ্টা করেছিলেন। ভাগ্য ভালো, সফল হননি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা ছেলেটার জন্ম কিন্তু পর্তুগালের মূলভূমিতে নয়, প্রায় সাতশ মাইল দূরের দ্বীপ মাদেইরাতে। অবকাশ যাপনের জন্য পুরো বিশ্বের পর্যটকদের কাছে মাদেইরার দারুণ কদর, গ্রীষ্মকালে সেখানকার জনসংখ্যা ফুলে-ফেঁপে তিনগুণ হয়ে যায়। সাগর পাড়ের আলো-হাওয়া খেয়ে বড় হওয়া রোনালদোর, চামড়ার হালকা তামাটে ভাব বলে দেবে বেড়ে ওঠার সময়টাতে সূর্যের আলোর কখনো অভাব হয়নি তাঁর। ইউরোপের মানুষ হলেও রোনালদোর গল্পটা যেন দক্ষিণ আমেরিকার আর দশটা ফুটবলারের মতোই। পেলে, রিভালদো, রবার্তো কার্লোসদের মতোই ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যকে সংগী করে বড় হয়েছেন, বাস্তবতাকে দূরে ঠেলে দিতেই হয়তো ফুটবলের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। এই ফুটবলের টানেই একদিন বাড়ি ছাড়তে হলো; আন্দোরিনহা, নাসিওনালের হয়ে টুকটাক ফুটবল খেলার পর পর্তুগালের দৈত্যত্রয়ীর মধ্যে অন্যতম স্পোর্তিং লিসবনের একাডেমিতে ঠাঁই মিললো। স্পোর্তিংয়ের হয়ে খেলার সময় চোখে পড়লেন আর্সেনালের, হাইব্যুরি যাত্রা পাকাপাকি হওয়ার আগেই পাকা জহুরি অ্যালেক্স ফার্গুসন তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এলেন। এরপরের গল্পটা সবারই জানা। পশ্চিম মিডল্যান্ডসে আইবেরিয়ার মতো সূর্যের সাথে দেখা হয় না, কিন্তু রোনালদোর কি এতো কিছু ভাবার সময় আছে? তিনি এসেছেন সফল হতে, শিরোপাসন্ধানে। শুরুতে পায়ের কারিকুরিতে মনোযোগী ছিলেন বেশি, এরপর আস্তে আস্তে নিজের খেলায় "এন্ড প্রোডাক্ট" যোগ করে নিলেন। গতি, বল নিয়ন্ত্রণ, বাতাসে দক্ষতা, গোলার মতো শট, দুর্বলতর পায়ে ভালো দক্ষতা নিয়ে এক পূর্ণাংগ প্যাকেজ। দলবদলের রেকর্ড চূর্ণ বিচূর্ণ করে মাদ্রিদে এসে যেন রোনালদো যেন আরো ভয়ংকর, ভীষণ ভয়াল সুন্দর। ২৯২ ম্যাচে ৩১১ লীগ গোলের পরিসংখ্যানটা অবাস্তব ঠেকার কথা, কিন্তু রোনালদো-মেসি আছেন বলেই এগুলো বোধহয় গা সওয়া হয়ে গেছে। "লস ব্লাঙ্কোস"দেরকে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এনে দেবার পর "তুরিনের বুড়ি" ইউভেন্তাসে পাড়ি জমানো। সেখানে লীগ জিতেছেন, তবে দু'যুগ পরে উত্তর ইতালিতে আবার কি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এনে দিতে পারবেন তিনি? উত্তরটা জানা নেই। ক্যারিয়ারে আটশ'র কাছাকাছি গোল করেছেন, তাই সেরা গোল বাছতে গেলেও যে কারো ভীষণ মুশকিলে পড়ার কথা। পোর্তোর বিপক্ষে চল্লিশ গজি শটটা সেই তালিকায় থাকবে কি? কিংবা পোর্টসমাউথের বিপক্ষে "নাকলবল" ফ্রী-কিকটা? বদলি হিসেবে নেমে বার্সেলোনার বিপক্ষে সুপার কাপে দারুণ সেই জয়সূচক গোলটা থাকবে না? চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কোয়ার্টার ফাইনালে ইউভের বিপক্ষে বাইসাইকেল কিকটাকে বাদ দেয়ারও যে অবকাশ নেই। লোকে তাঁকে আত্মকেন্দ্রিক বলুক, স্বার্থপর তকমা তো তিনি হরদম পেয়েই থাকেন, নিজেকে প্রমাণের তাড়নাটা এখনো আগের মতোই অনুভব করেন। কে জানে হয়তো "ইগোয়িস্ট" বলেই রোনালদো এতো পরিশ্রমী, চেয়েছেন সবার সেরা হতে।

 

cristiano-ronaldo-juve-1200



পর্তুগালের বাইরেও মাদেইরার ওয়াইনের ব্যাপক নামডাক আছে। কিন্তু মাদেইরার বাসিন্দা হয়েও রোনালদো নিজে মদিরা ছুঁয়ে দেখেন না। সুরাসক্তি নিজের বাবার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, শৃংখলাকে তাই আপন করে নিয়েছেন। তবে এই বেশি না, আর কয়েকটা বছরই তো। তারপর টাচলাইন পেরোতে দেখা যাবে না তাঁকে, বল জাল ছোঁয়ার পর দৌড়ে গিয়ে "সিইইইইউউউ" উদযাপন করবেন না। ইউরো জিতলেও বিশ্বকাপটা পাওয়া হয়নি, সামনের বছর কাতারে আরেকটা সুযোগ পাচ্ছেন। পর্তুগাল নামটার সাথে রোনালদো সমার্থকই হয়ে গেছে, জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর স্বদেশী হলেও আন্তোনিও গুতেরেসকে চেনেই বা ক'জন। মাঠের সাথে তাঁর বন্ধনটা ছিঁড়ে যাবার আগে আমরা তাই শেষটুকু বুভুক্ষের মতো সাবড়ে নেই। চমৎকার সব শট, শুন্যে ভেসে করা হেড, পেনাল্টি স্পটের নির্ভরতা আর কে-ই বা দিতে পারে? তাঁকে ভালোবাসুন বা ঘৃণা যেটাই করুন ফুটবল খেলাটার খাঁটি ভক্ত না কেন ফুটবল মাঠে তাঁর খেলা দেখে অন্তত একটিবারের জন্যেও হলেও আপনার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। নয়তো আপনি ভালোবাসার ক্ষমতাটা না নিয়েই জন্মেছেন।

ছত্রিশের আগাম শুভেচ্ছা পর্তুগালের রোনালদো। মানুষের অবাক হবার ক্ষমতা নি:সীম, আমাদেরকে বিস্ময় উপহার দিতে থাকুন।