• ফুটবল

মার্কিং এর খুটিনাটি - 'ম্যান মার্কিং vs জোনাল মার্কিং'

পোস্টটি ৩৫৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

স্যার এলেক্স ফারগুসন একবার বলেছিলেন, "Attack wins you games but Defence wins you titles!"  তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা কোচের এই উক্তিটি দ্বারাই ফুটবলে ডিফেন্সের গুরুত্ব বুঝা যায়! একজন ভালো ডিফেন্ডার হতে হলে আপনাকে অবশ্যই ভালো পজিশনিং, শিল্ডিং, পাসিং এবিলিটির সাথে 'মার্কিং' এবিলিটিটাও অবশ্যই থাকতে হবে! ফুলবলের অন্যান্য স্কিলের মত মার্কিং এরও সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়েছে, এসেছে বৈচিত্রতা। আজ কথা বলবো ফুটবলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্কিল 'ম্যান মার্কিং' এবং 'জোনাল মার্কিং' নিয়ে।

,

পাঠকদের মনে প্রথম যে প্রশ্নটা জাগে তা হলো, ফুটবলে 'মার্কিং' টা আসলে কি?

- সোজা কথায় বললে ফুটবলে মার্কিং মানে হলো বিপক্ষ দলের প্লেয়ারদের এমন ভাবে মার্ক করে রাখা, যেনো তারা বলের উপর কন্ট্রোল না নিতে পারে! এই মার্কিংটা দলের ট্যাক্টিস, সিচুয়েশন কিংবা প্লেয়ারের উপর ভিত্তি করে একেক রকম হতে পারে!

ফুটবলে মূলত দুই ধরণের মার্কিং আছে, ১.ম্যান মার্কিং এবং ২.জোনাল মার্কিং। 

,

,
"ম্যান মার্কিং" অথবা "ম্যান টু ম্যান মার্কিং" 
-  ফুটবলের আদিকালে (১৯২০-১৯৫০) এই মার্কিং সিস্টেমটা খুবই জনপ্রিয় ছিলো! 
ম্যান টু ম্যান মার্কিং হলো ১ vs ১! এই মার্কিং সিস্টেমে ১ জন প্লেয়ার প্রতিপক্ষের ১ জন প্লেয়ারকেই মার্ক করবে! অর্থাৎ অই প্লেয়ার মাঠের যেখানেই যাবে, তার মার্কারও তাকে ফলো করে সাথে সাথে যাবে! এভাবে প্রতিটা প্লেয়ার অপোনেন্টের প্রত্যেকটা প্লেয়ারকে মার্ক করে রাখবে। অপোনেন্টের পায়ে বল গেলেই তাকে ট্যাকেল করে বল উইন করার পর যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে বাচিয়ে টিমমেটকে পাস দিবে।
,
ম্যান মার্কিং এর 'সুবিধা' হলো, এই সিস্টেমে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট প্লেয়ারকে মার্ক করতে হয় বলে ডিফেন্ডারদের কম পরিশ্রম করতে হয়! যে প্লেয়ারকে মার্ক করে রাখা হয়, তার ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে টিমে তার কনট্রিবিউশন অনেক কমে যায়!
,
কিন্তু, মর্ডান ফুটবলে 'রোটেশনের' যুগে 'ম্যান মার্কিং' ডিফেন্স অনেকটাই অচল বলা যায়! কেননা, বর্তমানে প্লেয়ারদেরকে ফলস এইট, ফলস নাইন, ফলস টেন, ফলস উইংব্যাক, ইনভার্টেট উইংগার ইত্যাদি রোলে খেলানোর ফলে পুরো মাঠেই একের পর এক রোটেশন চলতেই থাকে! 
দেখা যায়, দলের সেন্টার ফরওয়ার্ড তার পজিশন ছেড়ে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে মিডফিল্ডে চলে আসছে (লিভারপুলের ফিরমিনো) কিংবা রাইট উইং এ খেলা শুরু করা প্লেয়ার আস্তে আস্তে লেফট উইং/এটাকিং মিড এ চলে গেছে (বার্সায় মেসি)!!!  (চিত্র ১)

FB_IMG_1613418326987

এখন আপনি যদি অই প্লেয়ারের মার্কার হন তবে আপনাকে ত অবশ্যই অই প্লেয়ারকে ফলো করে সাথে সাথে যেতে হবে! যার ফলে আপনার রেখে যাওয়া জায়গায় তৈরি হবে হিউজ গ্যাপ! সেই গ্যাপে সহজেই অপোনেন্টের আরেক প্লেয়ার ঢুকে যাবে! আর ফ্রি স্পেস পেয়ে সুন্দর করে একটা গোল দিয়ে চলে আসবে! অর্থাৎ, আপনার টিমের ডিফেন্স পুরো মাঠে মারা যাবে!

তবে সেটপিসে (কর্নার/ ফ্রিকিক) এখনও ম্যান মার্কিং এর বিকল্প নেই! (চিত্র ২)

heade-1024x620

,
,
""জোনাল মার্কিং"" :
- জোনাল মার্কিং এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৫০ সালের দিকে ব্রাজিলের হাত ধরে। ৪-২-৪ ফর্মেশনে মুভ করা ব্রাজিলই সর্বপ্রথম ফুটবল মাঠকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে ডিফেন্স করা শুরু করে! তবে তখনও 'জোনাল মার্কিং' ফুটবল দুনিয়ার 'ম্যান মার্কিং' মত গ্রহনযোগ্যতা পায় নি! ১৯৭০ সালের দিকে রোটেশন বেইজড 'টোটাল ফুটবল' এর জাগরণ ম্যান মার্কিং এর ভিত নাড়িয়ে দেয়! ফুটবল ট্যাক্টিসিয়ানরা বুঝতে পারে যে, এই রোটেশন বেইজড খেলাকে আটকাতে হলে ম্যান মার্কিং সিস্টেম বাদ দিয়ে নতুন কোনো মার্কিং সিস্টেম আয়ত্ত করতে হবে! যার ফলে উত্থান ঘটে 'জোনাল মার্কিং' এর! পরবর্তীতে এসি মিলানের গ্রেট কোচ সাচ্চির ফিলোসোফি জোনাল মার্কিংকে অন্য লেভেলে নিয়ে যায়!
,
জোনাল মার্কিং কিভাবে করা হয়?
- ফুটবল মাঠের উভয় অর্ধে ৩ সারিতে ৯ টা করে টোটাল ১৮ টা জোন থাকে। (চিত্র ৩)
জোনাল সিস্টেমে নির্দিষ্ট একটি প্লেয়ারের জন্য নির্দিষ্ট জোন (এক বা একাধিক) সিলেক্ট করা থাকে, সে শুধু অই নির্দিষ্ট জোনেই অপোনেন্টকে ডিফেন্ড করে! অপোনেন্ট তার অই নির্দিষ্ট জোন ছেড়ে অন্য জোনে চলে গেলে, অপোনেন্টকে ফলো করে অন্য জোনে যাওয়া লাগবে না! তখন অপোনেন্টকে মার্ক করবে অই জোনের দায়িত্বে থাকা অন্য আরেকটি প্লেয়ার! জোনাল মার্কিং এ ডিফেন্সকে অবশ্যই কম্প্যাক্ট রাখতে হয়। 

FB_IMG_1613418333288


এখন প্রশ্ন হলো কম্প্যাক্ট ডিফেন্স কি?
- কম্প্যাক্ট ডিফেন্স হলো মাঠকে ছোট করা, অর্থাৎ মাঠের যে সাইডে বল থাকবে সে সাইডে সব প্লেয়ার চেপে যাবে। যার ফলে দেখা যায় প্লেয়ারদেরকে তাদের নির্দিষ্ট জোন ছেড়ে অন্য জোনে চলে আসতে হয়!
কম্প্যাক্ট ডিফেন্স রাখার সুবিধা হলো এতে করে অপোনেন্টে সহজে পাস দেওয়ার অপশন খুঁজে পাবে না, যার ফলে সহজেই বল উইন ব্যাক করা যাবে! তবে ফুলব্যাকরা চেপে সিবিদের পজিশনে চলে আসায় ওয়াইড এরিয়াতে প্রচুর স্পেস পড়ে থাকে। অপোনেন্ট যদি এক ওয়াইড এরিয়া থেকে আরেক ওয়াইড এরিয়াতে বল পাঠায় তবে ফুলব্যাকদের দ্রুত অই স্পেস কাভার করতে হয়। 
,
জোনাল মার্কিং এর 'সুবিধা' অনেক! ম্যান মার্কিং এর মত এই সিস্টেমে অপোনেন্ট প্লেয়ারকে ফলো করে মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া লাগে না! যার ফলে ডিফেন্স লাইনে গ্যাপ ক্রিয়েট হয় না এবং অপোনেন্ট প্লেয়ার সহজে ফ্রি স্পেস পায় না! যার ফলে 'টোটাল ফুটবলের' মত রোটেশন বেইজড ফুটবল সহজে ডিফেন্ডারদের কনফিউজড করতে পারে না! 
জোনাল মার্কিং এ ডিফেন্স কম্প্যাক্ট রাখারা ফলে অপোনেন্ট সহজে পাসিং অপশন পায় না, ফলে সহজেই বল হারায়! কম্প্যাক্ট ডিফেন্সে সবাই একসাথে ডিফেন্ড করায়, কোনো একটা নির্দিষ্ট ডিফেন্ডারের 'টেকনিকাল' উইকনেস থাকলেও সেটা অন্য ডিফেন্ডারদের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়!  
,
তবে জোনাল মার্কিং এর কিছু 'অসুবিধাও' আছে। কম্প্যাক্ট ডিফেন্সে ওয়াইড এরিয়াতে অনেক ফাকা জায়গা থাকে! অপোনেন্ট অই ওয়াইড এরিয়াতে মুভ করলে পুরা টিমকে একসাথে অই এরিয়াতে মুভ করতে করতে হয়! এই শিফটিংটা টাইম মত না হলে অপোনেন্ট প্রচুর স্পেস পেয়ে যায়! 
জোনাল মার্কিং এ ডিফেন্ডারদের 'ট্যাক্টিকাল' সেন্স অনেক ভালো হতে হয়! নয়ত দেখা যায় একজন ডিফেন্ডারের কারণে পুরা ডিফেন্স লাইনই মাঠে মারা যায়! যেমন, অফসাইডে ট্রাপে নিজেই ধরা খাওয়া, জোনাল ডিফেন্সের মাঝে গ্যাপ ক্রিয়েট হওয়া ইত্যাদি। 
,
,
মর্ডান ফুটবলে শুধু একধরণের মার্কিং এর উপর নির্ভর করা কষ্টকর! অপোনেন্টের স্ট্রেন্থ, নির্দিষ্ট কোনো প্লেয়ার, অপোনেন্টের ফরমেশন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে আপনাকে মার্কিং ট্যাক্টিস সাজাতে হবে! 
অনেক কোচই এখন জোনাল মার্কিং এবং ম্যান মার্কিং কে একসাথেই ইউজ করে! আপনি জোনাল ডিফেন্স নিয়ে মাঠে নামলেও অপোনেন্টের কোনো প্রচন্ড স্কিল্পফুল প্লেয়ার যদি ফ্রি রোলে খেলে তবে অই নির্দিষ্ট প্লেয়ারকে ম্যান মার্ক করাই লাগবে! 
যেমন, এলক্লাসিকো তে মাঝেমাঝে ক্যাসামিরোকে মেসির ম্যান মার্কার হিসেবে রাখা হয়! অর্থাৎ মেসি মাঠের যেই জোনেই মুভ করুক তাকেও সেখান সাথে সাথে যেতে হবে এবং সেই জোনের দায়িত্বে থাকা ডিফেন্ডারের সাথে মিলে মেসিকে ডাবল ম্যান মার্ক করতে হবে! এ সিস্টেমকে বলা হয় 'মিক্সড সিস্টেম অফ মার্কিং'। 
,
,
ইতালীয় সাংবাদিক জিয়ানি ব্রেয়ারা একবার বলেছিলেন, " The perfect match would end 0-0"  এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এতে করে ফুটবলের এটাকিং এবং ডিফেন্ডিং উভয় সাইডেরই প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। 
এই ডিফেন্ডিংকে সুন্দর করার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো 'মার্কিং'। একজন ডিফেন্ডার শারিরীকভাবে শক্তিশালী না হয়েও কিংবা খুব বেশি উচ্চতা সম্পন্ন না হয়েও শুধুমাত্র মার্কিং এবিলিটি দিয়েই প্রতিপক্ষের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিতে পারে। এজন্য একজন প্লেয়ারকে ভালো ডিফেন্ডার হতে হলে মার্কিং স্কিল আপ টু দ্যা মার্ক থাকা খুবই জরুরি।