লিটন দাশের সাথে কি এটা ঠিক ছিল
পোস্টটি ১০২০ বার পঠিত হয়েছেউইন্ডিজের সাথে টেস্ট সিরিজ হারের পর বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স, টিম সিলেকশন, টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত, ক্যাপ্টেনসি সবই অনেক চাঁচাছোলা ও কড়া সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যায়। আর যাবে না-ই বা কেন। গত কয়েকবছর ধরে উইন্ডিজের মূল দল যেখানে বাংলাদেশের কাছে বারবার পরাস্ত হচ্ছে সেখানে এরকম তূলনামূলক আনকোরা একটি দলের বিপক্ষে সহজেই জেতা যায় এমন দুটি ম্যাচে হারে তো সমালোচনার বাণ উড়ে আসারই কথা। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি। কিন্তু এই সিরিজের প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উপর দৃষ্টিপাত করে আর সেটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারতাম না। ম্যাচটা পরে হারার কারণে তো বটেই যদি কোনোক্রমে বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেও যেত তখনও হয়ত এই ব্যাপারটা সমালোচনার ঊর্ধ্বে যেত না।
চট্টগ্রাম টেস্টের চতুর্থ দিনে তখন বাংলাদেশ তাদের দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং করছে। শুরুর দিকের ইদানীং খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠা বিপর্যয় সামলে ক্রিজে তখন বেশ ভালোভাবেই থিতু হয়ে গেছেন অধিনায়ক মুমিনুল হক ও উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লিটন দাশ। দুজনে মিলে ১২০+ রানের একটি দুর্দান্ত জুটিও গড়ে তোলে পঞ্চম উইকেটে। মুমিনুল হক চট্টগ্রামে তার ফর্ম ও রেকর্ডের উপর সুবিচার করে ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ড করলেন। অপর প্রান্তে লিটন তখন ৬৫ রানের সাবলীল ইনিংস খেলে সেঞ্চুরির পথে। মুমিনুল হক নিজের সেঞ্চুরির উদযাপন শেষ করে ক্রিজের মাঝখানে গিয়ে লিটন দাশের সাথে কথা বলে কিছু একটার ইঙ্গিত দিলেন। তার কথা অবশ্য কেউই শুনতে পাইনি আমরা। কিন্তু তার ভাবভঙ্গি আর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে বুঝা গেল যে তিনি লিটন দাশকে নির্দেশ দিলেন যত দ্রুত সম্ভব রান তুলতে যেন তাড়াতাড়ি ইনিংসের ডিক্লেয়ার করে উইন্ডিজকে চতুর্থ ইনিংসে অলআউট করতে পর্যাপ্ত সময় হাতে পাওয়া যায়। মোটাদাগে ভাবতে গেলে ম্যাচের ঠিক এই জায়গাটা থেকেই মোমেন্টাম বাংলাদেশের হাত থেকে চলে যায়। আর এরপরে যা যা ঘটল তার সাক্ষী তো আমরা সবাই-ই। এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে বাংলাদেশ জিতলেও কেন এক্ষেত্রে সমালোচনা করা হত।
যদি আমরা একটু চেতনাগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করি তাহলে এই ঘটনাটার দুইভাবে সমালোচনা করা যায়। প্রথম দিক হল দলগত ক্ষতি। প্রথম ইনিংসে ১৭১ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ওই সময় ১২০+ রানের পার্টনারশিপ গড়ে মোমেন্টাম যখন পুরোপুরি হাতের মুঠোয় এবং ম্যাচ তখনও সাড়ে চার সেশনের বেশি বাকি তখন কেন উইন্ডিজকে হালকাভাবে নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে যাওয়া হল। সেটা অবশ্যই একটা ভিন্ন আলোচনা। আমার এ লেখার পুরো ফোকাসটাই থাকবে সমালোচনার দ্বিতীয় দিকের যার পুরোটা জুড়েই শুধু এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে যে লিটন দাশের সাথে এটা কি ঠিক হল।
মুমিনুলের সাথে লিটন দাশের শলাপরামর্শ করার ঠিক ওই মূহুর্তটা পর্যন্ত যদি আমরা লিটন দাশের টেস্ট ক্যারিয়ারের দিকে আলোকপাত করি তাহলে সেখানে দেখব ২১ টেস্টের ৩৬ ইনিংসে ২৭.৪৮ গড়ে ৯৬২ রান। ৬টি হাফ সেঞ্চুরি এবং একটিও সেঞ্চুরির দেখা এখনো তিনি পাননি। তিনি তখন ওই ইনিংসে ব্যক্তিগত ৬৫ রানে দাঁড়িয়ে এবং খুবই দৃঢ়ভাবেই ব্যাটিং করছিলেন বোলারদের কোনো সুযোগ না দিয়েই। মুমিনুল হকের সাথে ওই শলাপরামর্শ শেষ হবার পরেই তার মধ্যে দ্রুত রান তোলার তাড়নাটা স্পষ্ট দেখা গেল এবং এই করতে গিয়েই একটা সম্ভাবনাময় ইনিংসকে ৬৯ রানে রেখেই তিনি সাজঘরে ফিরলেন। তিনি পুরোটা ইনিংস যেভাবে খেলছিলেন তাতে এই রান তোলার তাড়াহুড়ো না করলে সেঞ্চুরি পর্যন্ত যে যেতে পারতেন এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। এখানেই সেই সমালোচনার জায়গাটা চলে আসে।
লিটন দাশের ব্যাটিং প্রতিভা নিয়ে কারোরই কখনো সন্দেহের কোনো জায়গা ছিল না। এবং গত এক বছর ধরে তিনি যে দুর্দান্ত ফর্ম দেখিয়ে যাচ্ছেন তাতে তার প্রতি আস্থার জায়গাটা আরো বাড়তে শুরু করেছে সমর্থকদের। একই সাথে টিম ম্যানেমেন্টেরও। সাকিব-তামিম-মুশফিক পরবর্তী সময়ে তিন ফর্ম্যাটেই বাংলাদেশের ব্যাটিংকে তিনিই নেতৃত্ব দিবেন এমনটাই সবার প্রত্যাশা। এমন একজন ব্যাটসম্যানের জন্য তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি তার আত্মবিশ্বাসের এবং নিজের প্রতি সুবিচার করার সামর্থ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ওডিআইতে তিনি ইতোমধ্যে তিনটা সেঞ্চুরিও পেয়েছেন। কিন্তু টেস্টে তখন পর্যন্ত ছয়টা হাফ সেঞ্চুরি থাকলেও সেঞ্চুরি তার একটাও ছিল না। অর্থাৎ ছয়বার কাছাকাছি গিয়েও তিনি ফিরে আসেন। যাকে আমরা আমাদের ব্যাটিং লাইনআপের অন্যতম কান্ডারি হিসেবে ভবিষ্যতে দেখবার আশা করি তার কাছ থেকে শুধু এই ৫০-৬০ না বরং ১৫০-২০০ রানের ইনিংসও দেখার প্রত্যাশাতে থাকে সবাই। কিন্তু ছয়বার পঞ্চাশ পার করেও তিনি শতক পূরণ করতে পারেননি (বর্তমানে সাতবার পঞ্চাশ পার করেন তিনি) এ ব্যাপারটা অবশ্যই বড় ইনিংস খেলার ক্ষেত্রে তার কাছে একটা মানসিক বাধা হয়েই থেকে যাবে। যতদিন না তিনি তার প্রথম সেঞ্চুরিটার দেখা পাবেন ততদিন সমর্থকরা তো পরে তার নিজের প্রতিই নিজের সেই আস্থাটা একটু একটু করে ভাঙতে থাকবে। এই বাধাটা কাটিয়ে উঠতে তিনি পারতেন ওইদিন সেঞ্চুরিটা করতে পারলে। এবং তখন পর্যন্ত যেভাবে তিনি খেলছিলেন তাতে ওইদিনই তিনি ঠিকই তা করতে পারতেন।
ক্রিকেট যে একটা ঘোর অনিশ্চয়তার খেলা সেটা তো ওই টেস্টের শেষেই আমরা সবাই বুঝে যাই। তাই নিশ্চিত করে এটা বলাটা কোনোভাবেই সম্ভব না যে তার মধ্যে তাড়াতাড়ি রান তোলার তাড়না কাজ না করলে তিনি ওইদিন সেঞ্চুরি করতেনই। আমি ওইটা বলতেও চাইছি না। আমি শুধু ওই সিদ্ধান্তটা লিটন দাশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এমনকি ওই সিদ্ধান্তটা নেওয়া কেন হল তার সমালোচনা করছি। মুমিনুল হক দলের অধিনায়ক। যদি তিনি দীর্ঘদিন অধিনায়কত্ব করতে চান তাহলে তার উচিত ছিল এই ব্যাপারগুলোর দিকে নজর দেওয়া। তিনি নিজে সেঞ্চুরি সম্পূর্ণ করে ফেলেছিলেন। তিনি দ্রুত রান তোলার দায়িত্বটা শুধু নিজের কাঁ্ধে নিয়ে লিটন দাশকে তার খেলাটা চালিয়ে যেতে বলতে পারতেন। এমনকি দ্রুত রান তোলারও দরকার হয়তো ছিল না। সাড়ে চার সেশনের উপর বাকি খেলা। মোমেন্টাম পুরোপুরি বাংলাদেশের দিকে তখন। আর পিচও এমন ছিল না যে চারশর নিচে যেকোনো একটা টার্গেট দিয়ে, একটা সেফ জোনে না গিয়েও ডিক্লেয়ার করার সাহস দেখানোটা দরকার ছিল। এবং এই সাহস দেখিয়ে আখেরে কারোরই ভালো হয়নি। কিন্তু একবার ভাবুন যদি লিটন দাশ সেঞ্চুরিটি করেই ফেলতেন তাহলে ওই ম্যাচে দলের ভালো হত তো বটেই, এই ইনিংস থেকে পাওয়া কনফিডেন্স ভবিষ্যতে লিটনেরও অনেক কাজে আসত। আর যার ফলভোগী তিনি নিজেই এবং বাংলাদেশ দলও তার সুফল পেত। তারপরেও কেন মুমিনুল হক দলের অধিনায়ক হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নিলেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। সবদিক বিবেচনায় প্রশ্নটা হয়তো এভাবেও করা যায় যে বাংলাদেশের সাথে কি এটা ঠিক হল। কিন্তু আপাতত এই প্রশ্নটুকুই থাকল।
“লিটন দাশের সাথে কি এটা ঠিক হল?”
- 0 মন্তব্য