• ফুটবল

হোসে ম্যানুয়েলের ছেলেটা

পোস্টটি ১১৫৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
শাবি আলন্সোর থ্রু বলটা দারুণ ছিল। কিন্তু ফার্নান্দো তোরেস দৌড়ে সেটা ধরার আগেই বক্স ছেড়ে বেরিয়ে এলেন প্রতিপক্ষ দলের গোলরক্ষক। স্লাইড করে ক্লিয়ার করলেন চিলির গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভো। তবে দলকে বিপদমুক্ত করতে গিয়ে দুর্বিপাকে ফেলে দিলেন ব্রাভো। দুর্বল মাটি কামড়ানো ক্লিয়ারেন্স বাঁ প্রান্তে দাভিদ ভিয়াকে খুঁজে নিলো। যন্ত্রচালিতের মতো বাঁ পায়ে ফার্স্ট টাইম শট নিলেন ভিয়া। মাঠের বাকি ২১ জন খেলোয়াড়ই হয়তো এমন দূরপাল্লার শট নেবার আগে দু'বার ভাবতো। কিন্তু তিনি যে দাভিদ ভিয়া সানচেজ। প্রিটোরিয়ার ফুলটাইম রাগবি আর পার্টটাইম ফুটবল স্টেডিয়াম লফটাস ভের্স্ফেল্ডের দর্শকেরা তাই জাদুকরী এক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে গেলো। তবে এই গোলের নৈপথ্য নায়ককে খুঁজতে হলে আমাদেরকে উত্তর স্পেনের এক খনিশ্রমিকের শরণাপন্ন হতে হবে। হোসে ম্যানুয়েল ভিয়ার কাছে ছেলে দাভিদ তো বটেই পুরো স্প্যানিশ জাতিই চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
 
 
  • স্পেনের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ আস্তুরিয়ার এক সাদামাটা শহর তুইয়া। পাথরের খনিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরটার প্রতি ঘরেই কেউ না কেউ খনিতে কাজ করে। তবে রুজির সন্ধানে পৃথিবীর তমসাচ্ছন্ন জঠরে যাদের নিত্য বসবাস, মৃত্যুভয়কে জয় করে ঘাম ঝরিয়ে চলে যারা তাদেরই একজন হলেও হুয়ান ম্যানুয়েল ভিয়া লোকটাকে বেশ আলাদা বলেই মনে হওয়ার কথা। আধাঁরে বসেও তাঁর চোখজোড়ায় রংগিন স্বপ্ন খেলা করতে থাকে। ছেলে দাভিদকে ফুটবলার বানাবেন তিনি, দেশ-বিদেশের মাঠে বল পায়ে ছুটে বেড়াবে সে, লাল জার্সিটার পেছনে ভিয়া বংশের নামটা জ্বলজ্বল করবে। কেবল চার পেরিয়েছে দাভিদ, এরই মধ্যে তুইয়ার রাস্তায় বড় ছেলেপিলেদেরকে ফুটবল খেলায় নাস্তানাবুদ করে দাভিদ, "এল গুয়াহে" (বাচ্চা) হিসেবে বেশ নাম কামিয়েছে সে। তবে খেলতে খেলতেই বাস্তবতার স্বাদ পাওয়া হয়ে গেলো দাভিদের। ডান পায়ের ফিমারের চিড় ধরা পড়ল, অপারেশন করতে হবে। কিন্তু তার ফলে আজীবন দাভিদের ডান পাটা বাঁয়েরটার এক ইঞ্চি ছোট হয়ে থাকবে। তাহলে তো আর ফুটবলার হয়ে হচ্ছে না? তবে হোসে ম্যানুয়েল লোকটা এতো সহজে দমে যাবার পাত্র নন। কে জানে, হয়তো পাথরে আঘাত করতে করতে তাঁর ভেতরটাও কেমন নিরেট হয়ে গেছে? পুরো স্পেনজুড়ে হন্য হয়ে ডাক্তারের খোঁজ লাগালেন তিনি। শেষমেশ মিলে গেলো একজন, তবে তাঁর দাওয়াইটা চঞ্চল দাভিদের জন্য বেশ নিষ্ঠুরই বলতে হবে। দড়ি দিয়ে ডান পাটাকে উঁচু করে বেঁধে রাখতো হতো ২৪ ঘন্টা। একসময় হাড় পুরোপুরি জোড়া লেগে গেলো, দাভিদও ফিরলো ফুটবল মাঠে। তবে তখনই ডান পাটা ব্যবহার করা যাবে না। তাই হোসে ম্যানুয়েল সাহেব অনেক ভেবে নতুন অনুশীলনের রুটিন ঠিক করলেন। দাভিদকে বাঁ পায়ে একের পর এক বল পাস দেন, ওর কাজ হচ্ছে সেগুলোকে মেরে দূরে পাঠানো। ডান পায়ের ফিমারের সেই চোটই দু'পায়ে ভিয়াকে সমান দক্ষতা দিয়েছে। পরিণত বয়সেই যা তাকে বানিয়েছে ভয়ংকর এক ফিনিশার। স্থানীয় ক্লাব লাংগ্রেয়োয় আট বছর কাটানোর পর পেশাদার ক্লাব স্পোর্টিং গিহনের বি দলের হয়ে খেলার সুযোগ মিলল। তবে "সিরিয়াস" ফুটবলের আলোর রোশনাইয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যাবার দশা ভিয়ার। যতই তৃতীয় বিভাগ হোক হাজার হাজার দর্শকের সামনে খেলতে নামলে প্রত্যাশার চাপ পেয়ে বসতে বাধ্য। বয়স আঠারো হওয়ার আগে কখনো বিমানে চাপার সুযোগ হয়নি, লাস পালমাসের ফ্লাইটটা তাই ভিয়ার মনে আলাদাভাবে দাগ কাটার কথা। বি দলের হয়ে ১৪ গোল করার গিহনের মূলদলে সুযোগ পেয়েই বাজিমাত। দুই মৌসুমে করলেন ৪১ গোল। এরপর রেয়াল সারাগোসার হয়ে স্পেনের প্রথম বিভাগে খেলার স্বপ্নটা বাস্তবের মুখ দেখলো। তবে লা লীগাও ভিয়ার গোলবানে বাঁধ হয়ে উঠতে পারলো না। দুই মৌসুমে লীগে ৩২ গোল করে ফেললেন, তাঁকে সই করানোর জন্য বড় দলগুলোর লাইন লেগে গেলো। তাঁকে দলে টানার জন্য ১২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছিল ভালেন্সিয়া, সেই অংকের প্রতিটা পয়সাই যে উসুল করেছে ভালেন্সিয়া, সেটা বলাই বাহুল্য। পাঁচ মৌসুমে ১২৯ গোল করলেও ট্রফির খাতায় শুধুই কোপা দেল রে। শিরোপা জেতার জন্যই হয়তো বার্সেলোনায় যাওয়া। কাতালোনিয়ায় গিয়ে লা লীগা পেয়েছেন, চ্যাম্পিয়ন্স লীগও জেতা হয়েছে। পরে লা লিগা জিতেছেন আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়েও। ইউরোপে স্বদেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে খেলেননি, তবে যতদিন ছিলেন, গোলরক্ষকদের জন্য মূর্তিমান আতংক হয়ে ছিলেন তুইয়ার সেই বাচ্চা।

 

 
  • তবে দাভিদ ভিয়া সাধারণ দর্শকের মনে চিরদিনের মতো জায়গা করে নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে। স্পেনের আট গোলের পাঁচটিই এসেছে ভিয়ার পা থেকে। মিডফিল্ডে দারুণ সব প্রতিভা থাকলেও আক্রমণে দলের ভার একা বয়েছেন এই দাভিদ ভিয়াই। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার পা থেকে জয়সূচক গোলটা এলেও বিশ্বকাপে ৬৬ বছরের অপেক্ষা ঘোচাবার সবচেয়ে বড় নায়ক তিনি। দারুণ টেকনিকাল দক্ষতা ছিল, বক্সের আশপাশ থেকে অবলীলায় যে কোনো পায়েই গোল করতে পারতেন। মুভমেন্টে তাঁর তুখোড় ফুটবল মস্তিকের ছাপ পাওয়া যেত। সেন্টার ফরোয়ার্ডের চেয়ে একটু বাঁ দিক ঘেঁষে খেলতেই পছন্দ করতেন। স্পেনের হয়ে তাঁর চেয়ে বেশি গোল করেনি কেউ (৯৮ ম্যাচে ৫৯)। এই রেকর্ডের মতোই আরেকটি রেকর্ডও আপাতত নিরাপদ বলা যায়। বিশ্বকাপের আসরে তাঁর নয় গোলের ধারেকাছেই নেই কেউ। পাশাপাশি ২০০৮ ইউরোতে চারবার জাল খুঁজে নিয়েছেন, বড় টুর্নামেন্ট মানেই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে যেতেন ভিয়া।

 

 
লা লিগার পাট চুকানোর পর মেলবোর্ন ও নিউইয়র্ক সিটিতে কিছু সময় কাটিয়ে অবসরে চলে যাওয়া। রাউলের রেখে যাওয়া স্পেনের সাত নম্বর জার্সিটার উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেয়া ভিয়াকে তাই আর প্রতিপক্ষ নিয়ে ভাবতে হয় না। তবে এক জীবনে যা দিয়েছেন, স্পেন তো বটেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পুরো বিশ্বের ফুটবল অনুরাগীদের ঠোঁটে তাঁর নাম ঘুরে বেড়াবে। তবুও জাভি, ইনিয়েস্তা, তোরেস, কাসিয়াসদের চেয়ে তাঁর নামটা কমই শোনা যায়। কেনো? সেই গল্প হয়তো কোনো একদিন হবে। তবে তুইয়া শহরের হাজার দুয়েক লোকে ভিয়া নামটা নিশ্চয়ই মন্ত্রের জপতে থাকে। কারণ সে শহরের প্রতিটা ইট জানে, জানে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা রাস্তাটা, নির্দয় খনিগুলোরোও জানা আছে - হোসে ম্যানুয়েলের সেই ছোট্ট ছেলেটা ভিয়া বংশের নামটা অমর করে ফেলেছে।