• ক্রিকেট

কিউইদের কতটুকু চমকাতে পেরেছিল উঠতি টাইগার পেসাররা?

পোস্টটি ১২৪২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

নিউজিল্যান্ড সফরের প্রস্তুতির সময় টাইগার কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো ও তামিম জানান কিউই মাটিতে না জেতার ২০ বছরের আক্ষেপ এবার ঘুচাতে চলেছেন বাংলাদেশের তরুণ ও প্রতিভাবান এক ঝাঁক পেস অ্যাটাকের মাধ্যমে। আশাজাগানীয়া পরিকল্পনা শোনালেও বাস্তবে তার ছাপ কতটুকু পাওয়া গেছে কিংবা আদৌ পাওয়া গেছে কিনা, ৬-০র সফর শেষে এমন প্রশ্ন করা মোটেও অবান্তর নয়।

 

সফর নিউজিল্যান্ড-এ বলেই কিনা স্পিন নির্ভর বাংলাদেশ দলের স্কোয়াডে ছিল ৭ পেসার। দলের পরিকল্পনায়ও ছিল তারুণ্য নির্ভর পেস অ্যাটাক দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়া। দলে যেমন ছিল রুবেল, মুস্তাফিজের মত পুরনো কাণ্ডারি, ছিল সদ্য অভিষিক্ত হাসান মাহমুদ, ঘরোয়া টুর্নামেন্টে পারফর্ম করে দলে ফিরে আসেন তাসকিন, অভিষেকের অপেক্ষায় থাকেন বিশ্বকাপজয়ী আরেক প্রতিভাবান তরুণ শরিফুল ইসলাম। পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়েও সিরিজ শুরুর পুর্বে তামিম ইকবাল তার সন্তুষ্টির কথা মিডিয়াকে জানান।

 

তবে প্রথম ওয়ানডেতে দর্শক যেন আবারো সেই পুরনো এক দুর্বল বাংলাদেশকে দেখতে পায়। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং তিন ডিপার্টমেন্টেই ছিলনা পেশাদারিত্বের কোনো ছাপ যা পুরো সিরিজ জুড়েই চলমান থাকে। যদি তিন ডিপার্টমেন্টের ব্যর্থতার কথা বাদ দিয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশকে বিচারের জন্য তরুণ ও প্রতিভাবান পেস বোলিং এর রেকর্ডের দিকে তাকাই সেখানেও সন্তুষ্ট হবার সুযোগ নেই।

 

আপাতদৃষ্টিতে তাসকিন আহমেদই ছিল সেরা পারফর্মার। পুরো সফরে কেবল পাঁচটি উইকেট শিকার করলেও দাপুটে বোলিং কেবল তিনিই করেছেন। তৈরি করেছিলেন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগও যা লুফে নিতে পারলে সিরিজের পরিসংখ্যান ভিন্নও হতে পারত! ওয়ানডেতে ওভার প্রতি ৫.৯২ করে তিন ম্যাচে নিয়েছেন ৩ উইকেট আর ২ টি২০-তে ১২ ইকোনমিতে ২ উইকেট। বাকি সব পেস বোলাররাই ছিল ছন্নছাড়া। কারোর ইকোনমি-ই ওডিয়াইতে ৬ এর নিচে নয়। মুস্তাফিজ ও রুবেল হোসেনও তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। দুজনে তিন উইকেট করে নিলেও ছিলেন অনেক খরুচে। দলের ভারসাম্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরেক অলরাউন্ডার সাইফুদ্দিন তার খেলা দুই ম্যাচে ওভার প্রতি ১০ এর ও বেশি রান দিয়ে নিয়েছেন ১টি মাত্র উইকেট। নিয়মিত বোলারদের তুলনায় সৌম্য সরকার অন্যদিকে ছিলেন বেশ হিসাবী। উইকেট মাত্র ১টি নিলেও ওভারপ্রতি কেবল ৫.১৬ রান দিয়ে ছিলেন সিরিজের সবচাইতে ইকোনমিকেল পেসার!

 

টি২০ অভিষেকে তরুণ শরিফুল ইসলাম ছিলেন বেশ আগ্রাসী। তবে প্রথম ম্যাচে ততটা সফল না হলেও ২য় ম্যাচে দারুণ বল করেছেন। ৩ ওভারে ১৬ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। তবে ৩য় ম্যাচে আর সেই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়নি। অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কিউই ব্যটারদের লাগাম টানতে তারই মত ব্যর্থ হন তাসকিন, রুবেল, সাইফুদ্দিন। টি-২০ স্পেশালিষ্ট মুস্তাফিজও তার খেলা ১ ম্যাচে এর বিপরীত ছিলেন না। শরিফুল বাদে পেসার কারোর-ই ওভার প্রতি রান ১০ এর নিচে ছিলনা। টাইগার পেস বোলিং অ্যাটাক উভয় ফরম্যাটেই নিউজিল্যান্ড ব্যাটারদের কাছে ছিল অসহায়।

 

এমন লজ্জাজনক সিরিজের পর সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সমালোচনা হওয়া চাই যৌক্তিক এবং গঠনমূলক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পেস অট্যাককে যেখানে এক নিয়মতান্ত্রিক ছন্দের মধ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের পেস অ্য়াটাকে তেমন কিছুরই দেখা পাওয়া ভার। ব্যাটিংয়ে যেমন ওপেনিং ব্যাটসম্যান থাকে, থাকে মিডেল অর্ডার, ফিনিশার, তেমনি বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও একই। ব্যাটিংয়ের ন্যায় বোলিংয়েও তেমন নির্দিষ্ট কিছু ভুমিকা থাকে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে বাংলাদেশের ওপেনিং বোলার কারা? মিডেলের রান আটকানোর সেই দায়িত্বভারটাই বা কার? আবার ডেথ ওভার সামলানোর  স্পেশালিষ্টটাই বা কে? জানিনা স্বয়ং নির্বাচকদের কাছেও এর সদুত্তর আছে কিনা। গত ছয় বছরে একমাত্র মাশরাফি ছাড়া ধারাবাহিক আর কোনো ওপেনিং বোলার ছিলনা। মাঝেমধ্যে সাইফুদ্দিন-মুস্তাফিজ আবার রুবেল-তাসকিনদের দিয়েও সারানো হয়েছে ওপেনিং এর দায়িত্ব। মিডেল ওভারে মিরাজ, সাকিবের দায়িত্ব থাকে ইকোনমি ঠিক রেখে চাপ সৃষ্টি করা এবং ধারাবাহিকতার ফলে তারা তাদের কাজে সফলও বটে। কিন্তু তাদের অবর্তমানে বিদেশের মাটিতে মিডেলের এই গুরুদায়িত্ব কার তা আমার অন্তত পক্ষে জানা নাই। আবার মুশকিল বাঁধে শেষের ১০ ওভারে গিয়ে হার্ড হিটার ব্যাটারদের সামলাতে। গত ৫-৬ বছরে রুবেল, সাইফুদ্দিন, মুস্তাফিজকেই সবচাইতে বেশি দেখা গেছে এই দায়িত্বে, তবে কিছু বাতিক্রমী ম্যাচের কথা বাদ দিলে কেউই এতে সফলতার ছোঁয়া দেখতে পাননি। রুবেল, সাইফুদ্দিন তাদের ইয়র্কার ডেলিভারির জন্য পরিচিত হলেও চাপ সামলিয়ে ধারাবাহিকভাবে একই লাইন-লেন্থে বল করা আপাতদৃষ্টিতে এখনো তাদের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য বলেই মনে হয়। ফিজের অফ-কাটার এখন সকলের কাছে অনেকটাই অনুমেয়। তাই তার ডেথ ওভার এবিলিটিও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্বের অন্যান্য বোলারদের হাতে প্রচলিত বলের পাশাপশি থাকে নাকেল বল, লেগ কাটার, স্লোয়ার বাউন্সার, স্লোয়ার ইয়র্কারের মত আরো অনেক চমকপ্রদ ডেলিভারি যা ব্যাটারদের ছন্দ পতন ঘটায়। তবে টাইগার বোলারদের এমন ডেলিভারির সঠিক ব্যবহার করতে দেখা যায়না বললেই চলে। টাইগার শিবিরের পেসাররা যতই সম্ভাবনাময় হউকনা কেন তাদের সামর্থের সম্পূর্ণটা পেতে হলে চাই আরো নিয়মতান্ত্রিক চর্চা। কোচ, নির্বাচক, ক্যাপ্টেনকে বেছে নিতে হবে ফরম্যাট ভেদে তার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এক দীর্ঘমেয়াদী পেস স্কোয়াড। প্রত্যেককে তার নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে লক্ষ্য অনুযায়ী পরিশ্রম করে নিজ সামর্থের সম্পূর্ণটাকে কাজে লাগাতে হবে নিজ দলের জন্য। নির্বাচক-কাপ্তানকে যেমন নিজ প্লেয়ারদের প্রতি ভরসা রাখতে হবে তেমনি মিডিয়া ও দর্শকের চাপকেও সামলাতে হবে কেননা এটিও তাদের পেশাদারিত্বের মধ্যেই পরে। দীর্ঘমেয়াদী সফলতা ভোগ করতে হলে এতে সময়, বিশ্বাস, ভরসা সবই থাকতে হবে। কয়েক ম্যাচের কথা ভেবে ফর্ম বিবেচনায় এক সিরিজের জন্য স্কোয়াডের তেমন পরিবর্তন করা কখনোই উন্নতির লক্ষণ নয় বরং নির্বাচকদের দূরদৃষ্টিটার অভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে। পেসারদের উন্নতিতে যেমন চাই কোচ, প্লেয়ার ও নির্বাচকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা তেমনি বোর্ডেরও সেকথা মাথায় রেখে ঘরোয়া পিচকে করতে হবে আরো পেস সহায়ক। সিম-সুইয়িং সহায়ক উইকেট একদিকে বোলারদের জন্য যেমন হবে ইতিবাচক তেমনি ব্যাটারদেরও পেসের সুয়িং সামলানোটা হবে সহজতর। দেশের মাটিতে এমন পিচ বানানো সম্ভব না হলে ড্রপ-ইন পীচ বানিয়ে আনা এখন কেবল সময়ের দাবি।

 

এভাবে বোর্ড, নির্বাচক, কোচ, প্লেয়ার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই আসবে সফলতা। বাংলাদেশ ক্রিকেটও এভাবে একদিন হয়ে উঠবে পেস-স্পিনের এক দারুণ মিশ্রণ যা দেশ-বিদেশ সকল জায়গায় হবে সমান কার্যকর। এই সিরিজের মত অসহায় আত্মসমর্পণ হয়ে থাকবে কেবল ইতিহাস এমন প্রত্যাশাইতো দেশের কোটি ক্রিকেট ভক্তের। সেদিনের অপেক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা নিয়ে এই সিরিজের কথা হয়তো ভুলে থাকতেই চাইবে সকলে ততদিন।