"আপনি জর্জ হ্যাডলিকে চেনেন না? হাউ ডেয়ার ইউ!"
পোস্টটি ৬৯২ বার পঠিত হয়েছে
রাইন্ডার্স খেলাটা কিছুটা বেসবলের মতো যার সাথে গ্রাম বাংলার লাঠি খেলার সাথে মিল পাওয়া যায়। সেদিন পানামা নামের এক গ্রামে কিছু ছেলে রাইন্ডার্স খেলছিলো, সেই মাঠের এক কোনে এক ছেলে অবাক ভাবে তাকিয়ে ছিলো মাঠের দিকে যার পরনে ছিলো শর্ট প্যান্ট আর বয়স বড়জোর আট হবে হয়তো৷ খেলার মাঝে হঠাত করেই একটা বল তার দিকে তেড়ে আসলো, আর মাঠের যুবকরা চেঁচিয়ে উঠলো বল ধরার জন্য। সেই ছেলেটি প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু হুট করে লাফ দিয়েই বলটা অদ্ভুতভাবে তালুবন্দি করে ফেললো। তাকে তখন জিজ্ঞেস করা হয় আগে কখনো খেলেছে কিনা, সে উত্তরে বলে, না আগে কখনো খেলেনি। এই উত্তরের পরেও তাকে পরের রবিবারে একটা বড় ম্যাচ খেলতে বলা হয়। সে বলে, বাবা-মা এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জানাবে। তার বাবা-মা বেশ দোটানায় পড়েন খেলতে দিবেন কি না। অবশেষে অনুমতি দিলেন। আর দিকে রবিবার উপস্থিত। সেদিন প্রথম ম্যাচ থেকেই তার কাছে যতগুলো বল এসেছে সবগুলা ক্ষীপ্রতার সাথে তালুবন্দী করেছে তিনি। এর পর ম্যাচ শেষে তাকে কাঁধে তুলে নেন দলের সতীর্থরা। রবিবারেই উত্থান হয় তার।
ডিকোর্স হ্যাডলি তখন কাজ করতে পানামা খালের অবকাঠামো আর তার স্ত্রী ইরিন রবার্টস বাড়ি থাকতেন। ১৯০৯ সালের ৩০ মে তাদের ঘরে জন্মনেন জর্জ হ্যাডলি। জর্জের ৫ বছর বয়সে পানামা খালের কাজ শেষ হয়। এরপর বাবা ডিকোর্স হ্যাডলি চাকরির সন্ধানে কিউবার চলে যান। ১৯১৯ সালে তার মা তাকে নিয়ে জ্যামাইকা ফিরেন। জর্জ হ্যাডলি স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ ছিলো আর ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হবার জন্য তাকে ভর্তি করানো হয় এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। জর্জ হ্যাডলি কালাবার এলিমেন্টারি স্কুলে পড়াকালীন তার স্কুল দলের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলতেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে কিপিং গ্লাভস ছাড়াই কিপিং করতে তিনি।
আর এদিকে তিনি ব্যাটিংয়ে তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে অভ্যস্ত। রেটাউন ক্লাবে যখন তিনি যোগ দিয়েছেন তখন তার বয়স ১৬, ক্লাবে যোগ দেয়ার পর তিনি যখন তার প্রথম সেঞ্চুরি করেন তখন তিনি তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাটিং করতেন।
১৯৩০ সালের ১১ জানুয়ারি তার টেস্ট অভিষেক হয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২১ রান করলেও দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৭৬ রান। যা ছিলো কোনো অভিষিক্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানের প্রথম সেঞ্চুরি। সেই টেস্ট ড্র করে উইন্ডিজ তাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ড্র এর স্বাধ পায়।
পোর্ট অব স্পেনে দ্বিতীয় টেস্টে কিছু না করতে পারলেও তৃতীয় টেস্টে করেছেন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি এবং যার ফলে ইংল্যান্ড পরাজিত হয় ২৮৯ রানে। এদিকে সিরিজ ১-১ এ ড্র হওয়ায় চতুর্থ টেস্টের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় যে এটি একটি টাইমলেস টেস্ট ম্যাচ হবে। অর্থাৎ, ফলাফল না আসা পর্যন্ত খেলা হবে। টসে জিতে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে ইংল্যান্ড। এন্ড্রু স্যান্ডহামের ট্রিপল সেঞ্চুরি নিয়ে ২৫৮ ওভার ব্যাট করে ইংল্যান্ড সংগ্রহ করে ৮৪৯ রান। জবাবে নিজেদের প্রথম ইনিংসে নেমে ২৮৬ রানে অল-আউট উইন্ডিজরা। জর্জ করেন মাত্র ১০। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড ২৭২ রান করে উইন্ডিজকে টার্গেট দেয় ৮৩৬ রানের। এই ম্যাচের ফলাফল হবে হয় হার নাহলে জয় কারণ এইটা টাইমলেস ম্যাচ। এই অবস্থা দলের হাল ধরেন জর্জ হ্যাডলি। ৩৮৫ বল খেলে করেন ২২৩ রান। সপ্তম দিন শেষে উইন্ডিজ ৫ উইকেটে ৪০৮ রান সংগ্রহ করে। এদিকে প্রবল বৃষ্টির কারণে দুইদিন মাঠে গড়ায়নি খেলা। পরে দুই দলের সম্মতিতে ড্র হয় এই ম্যাচ।
১৯৩৩, ১৯৩৫ আর ১৯৩৯ - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তিনটি সিরিজ খেলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে উইন্ডিজ ইংল্যান্ড সফরে যায় তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের জন্য। কুখ্যাত বডি লাইন সিরিজের পরই এই সিরিজ হয়। ভালো-খারাপ মিলিয়ে সিরিজ কাটান তিনি। ১৯৩৫ সালে আবার ইংল্যান্ড সফরে যায় উইন্ডিজ তবে এইবার চার ম্যাচের সিরিজ। প্রথম তিন ম্যাচে দুইটা হাফ সেঞ্চুরি করলেও, কোনো সেঞ্চুরি করতে পারেননি। কিংস্টনে চতুর্থ টেস্টে ইংল্যান্ডকে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ২৭৫ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। তার এই রানের উপর ভর কর উইন্ডিজ করেছিলো সেদিন ৭ উইকেটে ৫৩৫ রান। ইংল্যান্ড সেই টেস্ট ইনিংস সাথে ১৬১ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়। আর এই সিরিজ জয়ই ছিলো উইন্ডিজদের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম সিরিজ জয়। এর চার বছর পর ১৯৩৯ সালে আবার সিরিজ খেলতে যায় উইন্ডিজ, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই এইটাই তার শেষ সিরিজ ছিলো। নিজের ২৭০* রানের ইনিংসের চার বছর পর লর্ডসে খেলতে নেমে দুইটা সেঞ্চুরি করেছিলেন জর্জ হ্যাডলি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন জর্জ হ্যাডলি। যেখান্দ রয়েছে তার ৫টি হাফ-সেঞ্চুরি সাথে ১০টি সেঞ্চুরি। ১৯ ম্যাচে করেছেন ২১৩৫ রান এভারেজ ৬৬.৭১। এরপর নয় বছর ক্রিকেটের বাইরে। ফের যখন ক্রিকেটে ফিরলেন তখন বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ভারতে বিপক্ষে প্রথম ও ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলের হ্যাডলি। মাত্র দুইরান করতে পেরেছিলেন সেই ম্যাচে। ১৯৫৪ সালে খেলেন নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। প্রথম ইনিংসে ১৬ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ১ রান করেই সমাপ্ত হয় ক্রিকেট জীবন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৪ ম্যাচে রান করেন ৫৫। এতে ৬৬ এর এভারেজ নেমে দাঁড়ায় ৬০ এর কোটায়৷ আর সেই সময় স্যার ডন ব্রাডমানকে টেক্কা দেয়ার ব্যাটসম্যান ছিলেন এই জর্জ হ্যাডলি যার কারণে তাকে উপাধি দেয়া হয় “ দা ব্ল্যাক ব্রাডমান ”।
সব প্লেয়ারদের গ্রেটনেস পরিসংখ্যান দিয়ে হয় না। যেমন জর্জ হ্যাডলি তখনকার সময়ে তার দলের অন্যদের থেকে হাজারগুণে ভালো পারফরম্যান্স করতো। তার একটা হুক শট বিপক্ষ দলের বোলারের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে হ্যাঁ ক্রিকেটে প্লেয়ারের পারফরম্যান্স মাপা হয় পরিসংখ্যান দিয়েই। তবে এই জর্জ এমন ক্রিকেটার ছিলেন তাকে গ্রেট বলার জন্য পরিসংখ্যান লাগেনা। তার খেলার স্টাইলই বলে দিতো তার গ্রেটনেসের কথা। আশা করি আজকে থেকে জর্জ হ্যাডলিকে না চেনার ভুল করবেন না, ভুলবেনও না
আজকে ৩০ মে, “ দা ব্ল্যাক ব্রাডমান" এর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন জর্জ এলফানসো হ্যাডলি।
- 0 মন্তব্য