• ফুটবল

জিদান কি পারবেন সেই রিয়াল ফেরাতে?

পোস্টটি ২১৬৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

সময়টা ২০০৯ সালের জুন-জুলাইয়ে। রিয়াল মাদ্রিদে ফিরে এসেছেন স্যান্তিয়াগো বার্নাব্যুর পর ক্লাবের সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। এসেই শুধু ঝড় না রীতিমত প্রলয় ঘটালেন ট্রান্সফার মার্কেটে। গত দুইবারের ব্যালন ডি অর জয়ী রোনাল্ডো আর কাকার গায়ে উঠল বিখ্যাত সাদা জার্সি। সাথে এলেন জাবি আলন্সোর মত মাঝমাঠের সৈনিক। রাউল, গুতিদের অভিজ্ঞতা আর রোনাল্ডো, হিগুয়াইনদের ক্ষীপ্রতায় ইউরোপ শাসন করার কথা সেই স্বপ্নের দলের।

article-2380721-059DAF86000005DC-682_634x406

 

কিন্তু হল না তার কিছুই। এই দলের কোচ ছিলেন আগের মৌসুমে ভিয়ারিয়ালকে নিয়ে চমৎকার সময় পার করা ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি। ইনজুরি, বড় প্রোফাইলের খেলোয়াড় সামলানোর ক্ষেত্রে কোচের অনভিজ্ঞতা আর পেপ গার্দিওলার বার্সার অপ্রতিরোধ্য ফর্ম মাথা তুলে দাঁড়াতেই দিল না রিয়ালকে। ফলাফলঃ আবারো হতাশা। যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল 'লা ডেসিমা' তাড়া করে বেড়ানো এই দলের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই আকস্মিক বিদায়। আলিম্পিক লিওঁর মত দলের সাথে নিজের মাঠে জিততে না পারার দুঃস্বপ্ন আজও ভোলেনি লস ব্লাংকোস সমর্থকেরা।

২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের পর পেরেজ দলের দায়িত্ব তুলে দিলেন 'দ্য স্পেশাল ওয়ান' হোসে মরিনহোর হাতে। দলে ভিড়লেন আর্জেন্টাইন সেনসেশন ডি মারিয়া, জার্মানির ওজিল, খেদিরা আর লোকাল প্লেয়ার হিসেবে পেদ্রো লিওন এবং কানালেসের মত খেলোয়াড়। সমর্থকেরা ইতিমধ্যে মরিনহোর রিয়ালকে ঘিরে আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। খোলস ছেড়ে ক্ষীপ্র চিতা বাঘের রূপে ফিরে এলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। কিন্তু মৌসুমের প্রথম ক্লাসিকোতেই বার্সার কাছে ৫-০ গোলে ধরাশায়ী। উড়তে থাকা বার্সার টিকি-টাকার সামনে মরিনহোর "ওয়ান অন ওয়ান" কৌশল মুখ থুবড়ে পড়ল। এটিকে হোসের কোচিং ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে আজও। লীগ শিরোপা এক সময় চলে গেল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু মরিনহো ভেলকি দেখালেন ১৮ দিনে হওয়া চার ক্লাসিকোতে। ২ ড্র, ১ হার আর ১ জয়ের সেই ১৮ দিনে রিয়াল 'কোপা দেল রে' শিরোপা ঘরে তোলে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সেমির প্রথম লেগে মরিনহোর ফাঁস হওয়া ৬ ডিফেন্ডারের কৌশল আর মেসির অনবদ্য এক পারফরম্যান্স বাদ দিলে এই চার ম্যাচের বাকি সময়টায় রিয়াল কাউন্টার অ্যাটাক আর ডিফেন্সিভ ফুটবলের মিশেলে চমৎকার খেলা উপহার দেয়। যদিও ক্লাসিকোতে দুই দলের খেলোয়াড়দের নোংরা এবং অনাকাঙ্খিত ব্যবহার চোখে পড়ে।তবে সমর্থকরা জেনে যান, এই রিয়াল এত সহজে হার মানবেনা।

এর প্রমাণ পরবর্তী মৌসুমেই মেলে। কোয়েন্ত্রাওকে দলে টেনে ব্যালেন্স নিয়ে আসেন মরিনহো। মজার ব্যাপার হল লা লীগায় এক পর্যায়ে বার্সা থেকে ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ৭ পয়েন্টের ব্যবধানে রেকর্ড ৩২তম শীরোপা জিতে নেয় রিয়াল। ন্যু-ক্যাম্পে রোনাল্ডোর সেই "কাম-ডাউন" সেলিব্রেশন কোন রিয়াল কিংবা বার্সা সমর্থকের ভোলার কথা নয়।

 

144360486

 

কিন্তু লা ডেসিমা এল না এবারো। পেনাল্টি শুট আউটে বায়ার্নের কাছে ধরাশায়ী এবার।

এরপর সবাইকে অবাক করে বার্সা ছাড়লেন গার্দিওলা। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন তরুণ টিটো ভিলানোভা। সবাই ধরেই নিলেন রিয়াল এই সুযোগে স্পেন শাসন করবে এবার। কিন্তু আবার হতাশা। ক্যাসিয়াসের ফর্মহীনতা, কোচের সাথে সম্পর্কের অবনতি, তার এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের ইনজুরিতে নাকাল হয়ে পড়ল রিয়াল। লা লীগা হাতছাড়া হল। সিগনাল ইদুনা পার্কে নড়বড়ে রিয়ালের ডিফেন্স স্রেফ ধসিয়ে দিলের লেওয়ান্ডস্কি।

 

o-ROBERT-LEWANDOWSKI-570

বার্নাব্যুতে এসে রামসের চোখের জলে শেষ হল 'লা ডেসিমা' স্বপ্ন আবারো। টাল-মাটাল রিয়াল ঘরের মাঠে 'কোপা দেল রে' ফাইনাল হারল চিরশত্রু এটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে। সব মিলে বিধ্বস্ত রিয়াল। বিদায় নিলেন মরিনহো।

এর পরের গল্পটা একটু ভিন্ন। পেরেজের অনেক দিনের টার্গেট আঞ্চেলত্তি ডাগ-আউটে এলেন।রিয়াল ট্রান্সফার মার্কেট ওলট-পালট করে দিল। ছাঁটাই হলেন ওজিল, হিগুয়াইন আর কাকার মত খেলোয়াড়। দলে আসলেন গ্যরেথ বেল, ইয়ারামেন্ডী, ইস্কো আর কারভাহাল। বদলে যাচ্ছিল রিয়াল। লা লীগায় দুইবারই অল্পের জন্য বার্সার সাথে হেরে গেলেও 'কোপা দেল রে' তে রোনাল্ডোকে ছাড়াই বার্সাকে হারিয়ে দেয় তারা।গ্যারেথ বেল একটি অতিমানবীয় গোল করেন এই ম্যাচে।

এর পর তৎকালীন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নকে ঘরে এবং বাইরে রীতিমত নাকানি-চুবানি খাওয়ায় রিয়াল।"রিয়ালের কাউন্টার অ্যাটাক কিভাবে থামাবেন?"  সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে বায়ার্ন বস গার্দিওলা বলেন, "রিয়ালের কাউন্টার অ্যাটাক থামানোর কোন উপায় নেই।" ফাইনালের রূপকথার নায়ক সের্জিও রামোস অনবদ্য এক সমতাসূচক গোল করে দলকে টেনে তোলেন। রিয়াল পেয়ে যায় স্বপ্নের আরাধ্য "লা ডেসিমা"।

 

154902984__705320c

 

পরের মৌসুমে পেরেজের কিছু সিদ্ধান্ত ডোবায় রিয়ালকে। দলের প্রাণভোমড়া আলন্সো আর ডি মারিয়ার বিদায়ে সামলে উঠতে পারেনি রিয়াল। এছাড়া  মড্রিচের ইনজুরী, বেলের বাজে ফর্ম এই সিজনেই টানা ২২ ম্যাচ জেতা দলটাকে ভেঙ্গে দেয় মানসিক ভাবে।

তার উপর সারা মৌসুম জুড়ে এটলেটিকোর চরম ডিফেন্সিভ ফুটবলের কাছে বার বার হার মানে রিয়াল। লা লীগা হাতছাড়া হয় আবার। নিজেদের একাডেমির মোরাতার গোলে কপাল পোঁড়ে ইউরোপে।

এরপর সমর্থকদের মনে বার্সার ট্রেবল জয়ের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন পেরেজ। আসলে তার মাথায় ছিল বার্সার মত একাডেমির কোচ দিয়ে মূল দল চালানোর থিওরি। আগে বহুবার না বললেও এবার তার প্রস্তাবে রাজি হন সাবেক একাডেমি কোচ রাফা বেনিতেজ।

মনে মনে আঞ্চেলোত্তির বিদায়ে ফূঁসে উঠলেও খেলোয়াড়রা ধৈর্য ধারণ করলেন। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হল না।ম্যানেজমেন্ট এর ভুলে নিষিদ্ধ চেরিসেভকে খেলিয়ে শুরুতেই কোপা থেকে বাদ পড়ল রিয়াল। বেনিতেজ আসলে ছিলেন ছোট বা মাঝারি সারির দলের বড় কোচ। রিয়াল সামলানোর মত ট্যাক্টিকাল ক্ষমতা তার কখনোই ছিল না। বার্সার বিপক্ষে ডিরেক্টর'স বোর্ডকে খুশি রাখতে গিয়ে চরম অপমানের শিকার হলেন।ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস আর রাকিতিচ ৪-২-২-২ এ খেলা রিয়ালের দুই অপ্রস্তুত হোল্ডিং মিডফিল্ডার ক্রুস আর মদ্রিচকে স্রেফ নাচিয়ে ছাড়লেন। ফলাফল বার্নাব্যুতে ০-৪ গোলে ধরাশায়ী। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই ধৈর্য হারালেন প্রেসিডেন্ট এবং স্কোয়াডের মূল খেলোয়াড়রা। বরখাস্ত হলেন রাফা।

লাইম লাইটে চলে এলেন সাবেক রিয়াল তারকা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ,ব্যালন ডি অর এবং বিশ্বকাপ জয়ী জিনেদিন জিদান।আঞ্চেলত্তির সময়ের এই সহকারী কোচকে এবার মূল কোচ হিসেবে পেয়ে প্রাণ ফিরে এল রিয়ালের স্কোয়াডে। ফর্মে ফিরলেন রোনাল্ডোও। ফর্মহীন হামেস আর ইস্কোকে বাদ দিয়ে ক্যাসেমিরোকে মূল একাদশে আনলেন জিজু। কয়েকটা হতাশাজনক ফলাফল ছাড়া তার রিয়ালের মধ্যে সেই আগের স্পৃহা আর সুন্দর ফুটবলের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। গোলপোস্টের নিচে আছেন দুর্দান্ত নাভাস। যিনি সমর্থকদের ডেভিড ডা হিয়ার ট্রান্সফার নাটক ভুলিয়ে দিচ্ছেন। তবে কি জিদান পারবেন রোনাল্ডো, বেল, বেঞ্জেমা, নাভাস আর রামোসকে নিয়ে রিয়ালকে আগের উচ্চতায় নিয়ে যেতে? যে উচ্চতায় ১০ বার ইউরোপ আর ৩২ বার স্পেনের রাজা হয়ে একমাত্র রিয়ালই যেতে পেরেছে।লা লীগা এবারো হাত ছাড়া হলেও  ক্লাসিকোর ঠিক আগে, চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আশাবাদী এই রিয়ালের মৌসুমের সমাপ্তিসূচক দিন গুলো কেমন যায় তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সকল মাদ্রিদিস্তা।