চাকাভা, গুরবাজ : একই দিনে দুই 'উইকেটকিপারের' দুই রকম দিন
দেখে মনে হবে, জিম্বাবুয়ে বোলারদের নিয়ে খেলছেন রহমনউল্লাহ গুরবাজ। মিরপুরে নাজিবুল্লাহ জাদরান ও মোহাম্মদ নবির টর্নেডো তখনও শুরু হয়নি, আফগানিস্তানকে পাওয়ারপ্লেতে দারুণ শুরুটা এনে দিলেন গুরবাজ, তাদের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। এদিন নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন এই ডানহাতি।
গুরবাজের ধরে দেওয়া সুরে ঝঙ্কার তোলা শেষ ততক্ষণে নবি-জাদরানের। আফগান পেসাররা শুরুতে এনে দিলেন এরপর গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু, আগের ম্যাচে নায়ক হতে হতে না হতে পারা রায়ান বার্লও ফিরে গেলেন। জিম্বাবুয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে তখন আক্ষরিক অর্থেই প্রায়। রেজিস চাকাভা এলেন সাতে, চার বছর পর আরেকটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে।
গুরবাজের বয়স ১৭। চাকাভার প্রায় এর দ্বিগুণ, প্রায় ৩২। দুজনের ব্যাটিং, কিংবা পরে কথাবার্তাতেও কি মিশে থাকলো দুই প্রজন্মের গান?
****
চাকাভাকে অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক অভিষেকের জন্য। টাটেন্ডা টাইবু, ব্রেন্ডন টেইলর, এমনকি রিচমন্ড মুতুমবামির কারণেও। ২০১১ সালে টেস্ট অভিষেক, গত বছর বাংলাদেশ সফরে এসে খেলে গেছেন ক্যারিয়ারের ১৪তম টেস্টটি। প্রথমবার বাংলাদেশে এসে ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটি করেছিলেন, গতবার এসে তেমন কিছু করতে পারেননি।
ওয়ানডে ক্যারিয়ার থমকে গিয়েছিল ২০১৫ সালে, এ বছরের এপ্রিলে সংযুক্ত আরব আমিরাত সিরিজ দিয়ে ফিরেছেন আবার। চার বছর আগে খেলেছিলেন ৫ টি-টোয়েন্টির সর্বশেষটি, এ ম্যাচের আগে। ৫ ম্যাচে রান ছিল ১৮, চাকাভা এ ফরম্যাটে তাকে মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেননি।
বাংলাদেশে ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য জিম্বাবুয়ের ঘোষিত স্কোয়াডটা একটু অদ্ভুত, টেইলর ছাড়াও এখানে আছেন আরও দুজন স্পেশালিস্ট উইকেটকিপার- চাকাভা ও মুতুমবামি। বাংলাদেশের বিপক্ষে আগেরদিন খেলেননি চাকাভা, এদিন ফেরানো হলো তাকে। চাকাভা টি-টোয়েন্টি খেলতে নামলেন চার বছর পর।
আফগানিস্তানের শক্তি সাধারণত স্পিন, বাংলাদেশের কন্ডিশনেও হওয়ার কথা সেটিই। এদিন অবশ্য তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ সব ব্রেকথ্রু এনে দিলেন পেসাররা-- ফরিদ আহমেদ, করিম জানাত, গুলবাদিন নাইব। ফরিদকে স্কুপ করে চার মেরে নিজের টি-টোয়েন্টি প্রত্যাবর্তনের ফ্লেয়ারটা জ্বালালেন চাকাভা।
চাকাভা যখন উইকেটকিপার : ২০১৫ সালে মুশফিককে স্টাম্পিং করছেন চাকাভা, এক ওয়ানডেতে।
স্লো-লো-ফুলটস আর লেগসাইডের সীমানায় ফিল্ডারদের ঘনত্ব বাড়িয়ে করিম তাকে আহবান করছিলেন বড় শট খেলার, তাতে চাকাভা সাড়া দিলেন একটু অন্যভাবে। তিনি করলেন রিভার্স পুল। এরপর অফস্টাম্পের বাইরে আবারও ফুললেংথে স্লোয়ার দিলেন করিম, চাকাভা এবার করলেন স্কুপ। ছয়, চার। নাইব এলেন শেষ ওভারে। হাঁটু ফেলে স্লগ করলেন চাকাভা। টি-টোয়েন্টিতে তার স্ট্রাইক রেট ১০৯-এর একটু বেশি, এদিন ব্যাটিং করলেন ১৯০-এ।
তবে ম্যাচ ঠিকই হারলো জিম্বাবুয়ে। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরেই ফাইনাল তাই অনিশ্চিত তাদের। আপাতত চাকাভার কন্ঠে তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার আকুতিটাই, “দেখুন, সবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে মুখিয়ে থাকে। আপনি যেমন বললেন, বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে (এর আগে), আমি শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছি। নিজেকে খুব বেশি চাপে রাখতে চাইনি। উপভোগ করতে চেয়েছি।”
আরেকটু ওপরে ব্যাটিং করতে পারলে সুবিধা হতো কিনা, তার জবাবে বললেন, “আজ আমার ভিন্ন ভূমিকা ছিল। সামনে সুযোগ পেলে যে ভূমিকাই আসুক, পালনের চেষ্টা করবো।”
চাকাভা উইকেটকিপার হয়েও এদিন সেটা করেননি, সাতে খেলেছেন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে। ম্যাচ জেতাতে পারেননি। দারুণ ইনিংসের পরও তাই সিরিজে তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। ক্রিকেটেই অনিশ্চিত জিম্বাবুয়ের ভবিষ্যত। চাকাভা ও তার এই ইনিংস যেন সেটিরই প্রতিফলন।
****
হজরতউল্লাহ জাজাই আফগানিস্তান ক্রিকেটের ‘বিস্ফোরক’ নাম। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে টানা দুই ফিফটিতে আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন, টি-টোয়েন্টিতে তার স্ট্রাইক রেট ১৮৬-এর ওপরে। নিশ্চিতভাবেই বল হিটিংয়ে তার ক্ষমতা দুর্দান্ত। সেই জাজাই হয়ে গেলেন দর্শক।
আফগানিস্তান ক্রিকেটে হয়তো আপাতত শেষ মোহাম্মদ শাহজাদ অধ্যায়। টেস্টে আফসার জাজাই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছেন ভালভাবেই। গুরবাজ এদিন টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিলেন যেন। কাইল জারভিস, টেনডাই চাতারাকে নিয়ে খেললেন তিনি। কোচ তাদেরকে বলেছিলেন, পাওয়ারপ্লেতে উইকেট না হারিয়ে ৪৫-৫০ রান তুলতে।
জাজাই ও গুরবাজ এদিন ৫.৪ ওভারেই তুললেন ৫৭ রান, জাজাই অবশ্য ফিরে গেলেন। আগেরদিন আফিফ হোসেন ২৬ বলে ৫২ রানের এক ইনিংসে চলে এসেছেন শিরোনামে। আফগানিস্তান ‘এ’ দলের হয়ে গুরবাজ কদিন আগেই চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের বিপক্ষে করেছেন সেঞ্চুরি। আফিফের খেলা দেখেছেন, তার এমন ইনিংস তাই অবাক করেনি গুরবাজকে।
পরদিন বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ নিয়ে তার ভাবনা জানতে চাওয়া হলে সোজাসুজি বলে দিলেন, “বাংলাদেশকে নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি শুধু আমার খেলাটা খেলে যেতে চাই।” ১৭-পেরুনো এক তরুণের দীপ্তি যেন ফুটে উঠলো তাতে।
গুরবাজের ওপর এদিন ভাল শুরুর এক দায়িত্ব ছিল, সেটা তিনি পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটা আগমনী বার্তা দিয়েছেন। একটা ক্যাচ নিয়েছেন উইকেটের পেছনে। চাকাভাকে উইকেটকিপিং করতে হয়নি। সাতে নেমে একটা আলাদা ভূমিকা ছিল তার, সেটা পালনের চেষ্টা করেছেন। দলকে পার করাতে পারেননি। যেমন বলা হয়ে থাকে দুই প্রজন্মের পার্থক্য বুঝাতে-- ১৭ বছর বয়সী কারও সামনে স্বপ্নালু ভবিষ্যতের হাতছানি। আর ৩১ পেরিয়ে ৩২ ছুঁইছুঁই, পোড় খাওয়া কারও সামনে শুধুই বাস্তবের কষাঘাত।
দলের দেওয়া দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেও গুরবাজ ও চাকাভা নামের দুই উইকেটকিপারের দুই রকমের এক দিন ছিল আজ।