• বঙ্গবন্ধু বিপিএল ২০২২
  • " />

     

    অন্ধের যষ্টি এডিআরএসই যখন অন্ধ

    অন্ধের যষ্টি এডিআরএসই যখন অন্ধ    

    ‘নেক্সট ম্যাচ থেকে রিভিউ উঠায়ে দেন। রিভিউ রাখার দরকার নেই।’ স্টাম্প মাইকে ধরা পড়া কথাগুলো বলছিলেন লিটন দাস। যে রিভিউয়ের জন্য কত কান্ড, সেই রিভিউ নিয়েই লিটনের এই কথা? না, ডিআরএস বা ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমের কথা বলছেন না লিটন। বলছেন তিনি বিকল্প ডিআরএস, বা এডিআরএসের(অলটারনেটিভ ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম) কথা। বিপিএলে আম্পায়ারিং নিয়ে একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর যা নিয়ে এসেছিল বিসিবি। কিন্ত সেটিও এখন কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা বিতর্কের। 

    বিপিএলের ১৬তম ম্যাচেই ঘুরে আসা যাক। বরিশাল ব্যাটিংয়ে, স্ট্রাইকে তখন শান্ত। আফিফের বলটায় সামান্য সরে গিয়ে শান্ত কাট করতে চাইলেন। বল ব্যাটের নিচ দিয়ে কিপারের গ্লাভসবন্দী হলো, কিন্ত ব্যাটের ছোঁয়া কি পেল? আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুল জানালেন, না। মুকুলের মাথা নাড়ানো দেখে সঙ্গে সঙ্গেই এডিআরএস নেওয়ার ইশারা দিলেন আফিফ। এডিআরএসের দায়িত্বে থাকা টিভি আম্পায়ার মোর্শেদ আলী খান জানালেন উল্টো মত। মুকুল তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে আঙুল তুললেন ঠিকই। একইসঙ্গে মাথাও নাড়ালেন আরেকবার, যেন মানতেই পারছিলেন না, যা জানিয়ে দিচ্ছিলো ওই সিদ্ধান্তের সাথে তাঁর দ্বিমতের কথা। আম্পায়ারই যখন এ সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ, তাতে যে ব্যাটার শান্তের রাগের ঝাল শুধু প্যাডেই ব্যাট বাড়ি মারাতে সীমাবদ্ধ থেকেছে, সেটিই ভালো। 

    এবার আসা যাক লিটনের ম্যাচে, বিপিএলের ২১তম ম্যাচ। সেদিন লিটনদের এলবিডব্লিউয়ের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। কুমিল্লা কাপ্তান ইমরুল কায়েস রিভিউ নেন। কিন্ত রিভিউ দেখে টিভি আম্পায়ারও পরে আর সিদ্ধান্ত বদলানোর পরামর্শ দেননি। এরপরেই লিটন উইকেটের পেছন থেকে বলেছিলেন, ‘নেক্সট ম্যাচ থেকে রিভিউ উঠায়ে দেন।’ সিদ্ধান্তটা লিটনের পক্ষে আসেনি বলেই লিটন তাঁর ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন এই কথা বলে। কিন্ত আদতে সে বল দেখে যেমন মনে হতে পারে আউট, তেমনই নট আউটও। এখানে আসলে আম্পায়ারদের দায়ের চেয়ে এডিআরএসের অন্ধত্বের দায়ই বেশি। 

    টিভি রিপ্লে দেখেই কোন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্যেই আসলে এই এডিআরএস। নেই হক আই প্রযুক্তি, নেই আল্ট্রা-এজ। এজন্য স্টাম্প মাইকের আওয়াজের উপর ভরসা করেই ব্যাটে লাগলো কি না সে সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হচ্ছে। আর বল ট্র্যাকিং নাই বলে বল গিয়ে উইকেটে হিট করবে নাকি না সেটিরও দৃশ্যত প্রমাণ মিলছে না। যা বুঝে নিতে হচ্ছে আম্পায়ারের বিবেচনার সাহায্যেই। এখানে আসলে আম্পায়ারের ‘বিবেচনা’র উপরই নির্ভর করছে সব। বাড়তি পাওয়া হচ্ছে, খালি চোখে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেটি আবার বারবার দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগটা। এবং সেটির দরকারও কম নয়! 

    বাংলাদেশে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়েও যে প্রশ্নের শেষ নেই। এই বিপিএলেরই একটি ঘটনা, যে ঘটনার পর ডিএআরএস না থাকার সমালোচনাটা আরও জোর পেয়েছিল। বল নাঈম শেখের গ্লাভসে লাগলেও আম্পায়ার দিয়ে দিয়েছিলেন এলবিডব্লিউ। আন্দ্রে রাসেলের তো পরিস্কার ব্যাটে বল লাগার পরেও আম্পায়ারের তোলা আঙুলে ফিরতে হয়েছিল। আরেক ম্যাচে মুজিবের এক বল বোপারার পায়ে লেগে বেরিয়ে যায় লেগ সাইড দিয়ে, কিন্ত আম্পায়ার দুই হাত প্রসারিত করে জানিয়ে দেন ওয়াইড! ভাবা যায়, পরে সেই ওয়াইডেরও রিভিউ নিয়েছিল বরিশাল! রুবেলেরও এক ওয়াইড ইয়র্কারে ভিন্ন ম্যাচে আম্পায়ার ওয়াইড দিয়েছিলেন। বরিশাল এলবিডব্লিউয়ের রিভিউ নিয়ে ওয়াইডের ডিসিশন পাল্টাতে বাধ্য করেছিলো, কিন্ত রুবেলের বলটা পায়ে লাগেনি বলে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও রিভিউ নিতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ।  

    ডিআরএস থাকলে হয়তো শুধু ওয়াইডের জন্যেই সেটি নেওয়ার সাহস করতো না বরিশাল। ডিআরএসের মতো এডিআরএসের বেলায় রিভিউ কতটি নিতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই। যে কারণে একেবারে প্রায় সঠিক সিদ্ধান্তেই আবার অনেকে রিভিউ নিয়ে ফেলেন। এতে সময়ও নষ্ট হয় বেশ। সেদিনই যেমন খুলনার বিপক্ষে ম্যাচে অলক কাপালি নিশ্চিত এলবিডব্লিউয়েই রিভিউ নিয়ে নিলেন। স্ক্রিনে রিভিউয়ের কার্যকর্ম দেখার সময়েই মুশফিক বলছিলেন, ‘আরে অলক ভাই, হুদাই সময় নষ্ট।’ অনেক সময় বিরক্তির কারণও হয়ে দাঁড়ায় এটি। কিন্ত আম্পায়ারদের অপারদর্শিতা বিবেচনায় নিয়েই হয়তো রিভিউ সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। 

    এডিআরএস যে একেবারে সুফল বয়ে আনেনি, তা কিন্তও না! অনেক ‘ভুল’ সিদ্ধান্তও ‘সঠিক’ হতে পেরেছে এটির বদৌলতেই। এই যেমন ঢাকা ও খুলনার এক ম্যাচে নাবিল সামাদের বল তামিম ইকবালের মিডল স্টাম্প বরাবর গিয়ে পায়ে লাগে, তবু আম্পায়ার হয়তো ‘এজ’ ভেব আঙুল তুলেননি, পরে খুলনা সে উইকেট পেয়েছিল রিভিউয়ের সাহায্যে। তা লিটনদের ওই আপিলের বেলায় সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল নাকি ভুল? 

    কারিম জানাতের গুড লেংথের বলটা গিয়ে লাগে ব্রাভোর প্যাডের উপরের দিকেই। ব্রাভো ছিলেনও ক্রিজের বেশ পেছনে। দেখে বুঝার উপায় ছিল না সেটি কী? আউট ও নট আউট, দুদিকেই থাকবে মতামত। সেক্ষেত্রে আম্পায়ার আউট দেননি বলে টিভি আম্পায়ার অকাট্য প্রমাণের অভাবে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেননি। বল ট্র্যাকিং সিস্টেম থাকলে দেখতে পারতেন বল গিয়ে স্টাম্পে লাগছে নাকি না। শান্তের আউট দেওয়ার ক্ষেত্রেও আম্পায়ারকে ভরসা রাখতে হচ্ছিলো স্টাম্প মাইকের শব্দের উপর। কিন্ত স্টাম্প মাইকও উপযুক্ত প্রমাণ দিতে সক্ষম হতে পারে না সবসময়।

    শান্তের আউট নিয়ে অনেক সমর্থকেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করেছেন, কেউ কেউ তো আম্পায়ারকে ‘অন্ধ’ বলেও ফেলেছিলেন। এক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে এডিআরএসকেও অন্ধ বললে ভুল হওয়ার কথা নয়। যে এডিআরএস বিসিবি এনেছিল অন্ধের যষ্টি হিসেবেই। কিন্ত এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখাবেই-বা কেমন করে? শোনা গিয়েছিল, বিপিএলের শেষ দিকে ডিআরএস আসার কথা। এমনিতেই ‘নাটক’ নাম পাওয়া বিপিএলে রিভিউয়ে অন্ধত্ব দূর করতে সেটিরই ছিল বড্ড প্রয়োজন। যেটির বিকল্প কিছু কখনোই হতে পারে না! অবশ্য বিসিবি এক্ষেত্রেও ব্যর্থতার খাতায়ই নাম লিখিয়েছে, পারেনি ডিআরএসের ব্যবস্থা করতে।