• ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    প্রতিদ্বন্দ্বীদের আরেকটি রমরমা থ্রিলার, ক্লাসিক কোহলি আর নাটকে ভারতের পরিতৃপ্তি

    প্রতিদ্বন্দ্বীদের আরেকটি রমরমা থ্রিলার, ক্লাসিক কোহলি আর নাটকে ভারতের পরিতৃপ্তি    

    সুপার ১২, মেলবোর্ন(টস-ভারত/বোলিং)
    পাকিস্তান- ১৫৯/৮, ২০ ওভার (মাসুদ ৫২*, ইফতিখার ৫১, আফ্রিদি ১৬, হার্দিক ৩/৩০, আর্শদীপ ৩/৩২, ভুবনেশ্বর ১/২২)
    ভারত-১৬০/৬, ২০ ওভার (কোহলি ৮২*, হার্দিক ৪০, সূর্যকুমার ১৫, রউফ ২/৩৬, নাওয়াজ ২/৪২, নাসিম ১/২৩)
    ফলাফল: ভারত ৪ উইকেটে জয়ী

     

    শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৬ রান; মোহাম্মদ নাওয়াজের মুখোমুখি হবেন হার্দিক পান্ডিয়া। প্রথম বলেই হার্দিককে ফিরিয়ে ম্যাচের কাটা আরেকবার পাকিস্তানের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন নাওয়াজ। তবে আরও একটি অবিশ্বাস্য রান তাড়ার ইনিংস খেলে কোহলি মারলেন ছয়; কোমরের ওপরের ফুল টসে যেটা হওয়ার কথা ছিল চতুর্থ বল সেটা থেকে ফ্রি হিটও পেয়ে গেল ভারত। পরের বলটা ওয়াইড হলে ফ্রি হিট তখনও বহাল। ফ্রি হিট অবশেষে যখন হল সেটাতে বোল্ড কোহলি, কিন্তু স্টাম্পে বল লেগে থার্ড ম্যান গলে বল বের হয়ে যাওয়াতে সেখানে ৩ রান নিলেন কোহলি। স্টাম্প ভাঙার পরেও রান নিতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন রিজওয়ান। সেসব প্রশ্ন ছাপিয়ে ২ বলে ২ রান প্রয়োজন হলে দীনেশ কার্তিকের মতিভ্রমে স্টাম্পড হয়ে ফিরলেন তিনি। ১ বলে তখন প্রয়োজন ২; ম্যাচে আবার পাকিস্তান পাচ্ছে জয়ের ঘ্রাণ। তবে স্নায়ুচাপ একেবারেই পেয়ে বসল নাওয়াজকে। আবার দিয়ে বসলেন ওয়াইড। শেষ বলটা মিড অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মেরে শেষ বলে তাই জয় সম্পন্ন করলেন রবিচন্দ্রন আশ্বিন। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কোহলি আবার দেখালেন রান তাড়ার রাজা এখনও তিনি; ভারতও দেখাল স্নায়ুচাপ কীভাবে সামলাতে হয়। খাদের কিনারা থেকে কোহলি-হার্দিকের শতরানের জুটিতে পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকা ম্যাচে ফেরার পর ভারতই হেসেছে জয়ের হাসি।


    আরশদীপ-ভুবনেশ্বরের ভেল্কি সামলে ইফতিখারের প্রতি-আক্রমণ

    এমসিজির দমকা হাওয়ার সুযোগ নিয়ে দু দিকেই বল সুইং করে দারুণ শুরু করেছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। সেটারই পরিক্রমায় দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে বাবর আজমকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেললেন আরশদীপ। গোল্ডেন ডাকের শিকার হয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক ফেরার পর সুইংয়ে খাবি খেতে থাকা মোহাম্মদ রিজওয়ানকে নিজের পরের ওভারে বাউন্সারের টোপ ফেললে আরশদীপের সেই টোপ গিলে ১২ বলে ৪ রানে ইনিংস শেষে ফেরেন তিনি। পাওয়ারপ্লে এরপর সাবধানে সামলে শান-ইফতিখার জুটি দলকে নিয়ে যান ৩২ রানে। আঁটসাঁট বোলিংয়ে তখনও ধুঁকছে পাকিস্তান; ১০ ওভারে তুলতে পেরেছে ৬০ রান। এরপরেই যেন বিশেষ কোন টোটকা পেয়ে গেলেন ইফতিখার। এমসিজির বিশাল বাউন্ডারির তোয়াক্কা না করে নিজের পেশির শক্তি দেখিয়ে রবিচন্দ্রন আশ্বিনকে মারলেন  দারুণ এক ছয়। আর পরের ওভারে অক্ষর প্রথম আক্রমণে এলে তাকে মারেন ৩ ছয়; ওভারের শেষ বলে ৩ রান নিয়ে সেই সাথে ৩২ বলে পূর্ণ করেন ফিফটি। শেকল ছিড়ে বের হওয়া দারুণ সেই ফিফটির পরের ওভারেই মোহাম্মদ শামির কাছে এলবিডব্লিউর শিকার হয়ে ৩৪ বলে ৫১ রানে ফিরে গেলেও পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র পড়িয়েছিলেন ইফতিখারই।  

    হার্দিকে হতভম্ব পাকিস্তানের পরিত্রাণ মাসুদ-আফ্রিদিতে

    ইফতিখার ফেরার পরেও ম্যাচে নিজেদের খুঁজে পাওয়া পাকিস্তান যখন সঠিক পথে হাঁটার পরিকল্পনা সাধছে তখনই বাঁধ সাধেন হার্দিক। এক ওভারেই শাদাব খান ও হায়দার আলীকে ফিরিয়ে পাকিস্তানের আশা ভেস্তে দেন। নিজের শেষ ওভারে এসে মোহাম্মদ নাওয়াজকে ফিরিয়ে পাকিস্তানকে যেন এমসিজির বাউন্ডারি বুঝে খেলার একটা বার্তাও দিয়ে দেন। সেই বার্তা কানে পৌঁছেছিল মাসুদের। এক প্রান্ত আগলে রেখে কোনও ছয়ের চেষ্টা করেননি; নিয়মিত প্রান্ত বদল করার পাশাপাশি ফিল্ডিংয়ের ফাঁকফোকর খুঁজেছেন। মাঝে আর্শদিপের বাউন্সারে কাবু হয়ে আসিফ ফিরে গেলে স্বভাবতই কিছুটা মিইয়ে গিয়েছিলেন মাসুদ। উইকেটে এসে পাকিস্তানের ইনিংসে তাই প্রয়োজনীয় প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন আফ্রিদি। ৮ বলে ১৬ রানের দারুণ ক্যামিও খেলে আফ্রিদি ফেরার পর শেষ ওভারে নেমেই ছয় মেরেছিলেন রউফ। অন্য প্রান্তে মাসুদ ৪২ বলে ৫২* রানে টিকে থেকেই পাকিস্তানের লড়াইয়ের রসদ জোগাড়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

    পাওয়ারপ্লেতে পাকিস্তানি পেসারদের দৌরাত্ম্য

    ১৬০ রানের রসদ নিয়ে পাওয়ারপ্লেতে আগুন ঝরিয়েছিলেন নাসিম-রউফ জুটি। নাসিমের বল স্টাম্পে ডেকে এনে রাহুল ফেরার পর হারিসের লাফিয়ে ওঠা গুড লেংথের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ৭ বলে ৪ রান করে ফেরেন রোহিত। পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে ঠিক ওরকম এক লাফিয়ে ওঠা বলে স্টাম্পের পিছে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন দারুণ শুরু করা সূর্যকুমার যাদব। পাওয়ারপ্লেতে তিন উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে ৩১ রানে বেঁধে পাকিস্তান পেয়েছিল দুর্দান্ত শুরু।

    হার্দিকের ঠাণ্ডা মাথা, রানতাড়ার রাজা কোহলি

    পাওয়ারপ্লের পরের ওভারে রান আউট হয়ে ফিরলেন অক্ষর পাটেল। চাপ নিয়ে উইকেটে এসে হার্দিক বুঝে নিলেন সাবলীল ভাবে খেলার নিজের অধিকারটুকু। কোহলি মন দিলেন প্রান্ত বদলে। ৩১ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর ১০ ওভার শেষে ভারত তুলতে পারে ৪৫ রান। যেই ১২তম ওভারে ঝড় তুলেছিল পাকিস্তান, সেই ১২তম ওভারেই ম্যাচের মোড় ঘোরাল ভারত। দৃশ্যপট একই - বাঁহাতি স্পিনারের ওপর চড়াও ডানহাতি ব্যাটার, ওভারে ৩ ছয়। পার্থক্য শুধু ভারতের হয়ে এখানে তিন ছয় মারলেন দুজন মিলে। ১৫তম ওভারে যেয়ে এরপর ভারত ছোঁয় নিজেদের শতরান। তখনও কোহলি ব্যাট করছেন ৩৭ বলে ৪২ রানে। যেই শাহীন আফ্রিদির ওপর অধিনায়কের অগাধ আস্থা সেই শাহীনের করা ১৮তম ওভারেই কোহলি সিদ্ধান্ত নিলেন গিয়ার পাল্টানোর। যেন সবটাই হিসেব কষা, যেন পাকিস্তানের আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করতেই এই সিদ্ধান্ত। প্রথম বলেই দারুণ এক চার নিজের ৩৪তম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ফিফটি কোহলি পেলেন ৪৩ বলে; এরপরে আরও দুই চারে অই ওভারে আনলেন ১৭ রান। ১৯তম ওভার করতে বাবর বল তুলে দিলেন তখন পর্যন্ত তার সেরা বোলার রউফের হাতে। প্রথম ৪ বলে তিনি দিলেন মোটে ৩ রান। রউফ যে গতি দিয়ে তাদের পরাস্ত করতে চাইছেন সেটা ততক্ষণে পড়ে ফেলেছেন কোহলি। ৫ম ও ৬ষ্ঠ বলে সেই গতি ব্যবহার করে পুরো ব্যাটে-বলের মধুর সংযোগে মারলেন টানা দুই ছয়; যার মদ্ধে পঞ্চম বলের ছয়টাতে যেভাবে গুড লেংথের বল বেরিয়ে এসে সোজা ব্যাটে খেললেন তাতেই যেন রউফের বোঝা হয়ে গিয়েছিল ম্যাচের পরিনতি। ৩৭ বলে ৪০ রানে থাকা হার্দিক শেষ ওভারের প্রথম বলে ফিরলেও নাটকীয় শেষ ওভারের পর ৫৩ বলে ৮২* রানে থেকে কোহলি ঠিকই মাঠ ছাড়লেন ম্যাচ জিতিয়ে।