দুবাইতে ভাষ্যকার, মেলবোর্নে তারা: স্যাম কারানের এক বছর
বিশ্বকাপের ফাইনালে আগেও ছিলেন। তবে ক্রিকেটার হিসেবে নয়, স্যাম কারানের পরিচয় তখন বলতে পারেন ক্রিকেট এক্সপার্ট বা পান্ডিত। স্কাই স্পোর্টসে কথা বলে কাটিয়েছেন ২০২১ বিশ্বকাপের সেই ফাইনালে। ফাইনালে মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে তারা যেখানে কথা বলছিলেন, তাদের পিছনে ক্যামেরা ধরেছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের। বিশ্বজয় করে হাসি-খুশিতে মত্ত অজিদের!
ওই ফাইনালের আগেই ইংল্যান্ডের বিদায় ঘটেছিল, সেমিতে কিউইদের বিপক্ষে কী হয়েছিল তা আপনার অজানা নয়। চার ওভারে ৫৭ রানের সম্বল নিয়েও জিততে পারেনি ইংলিশরা, জর্ডান-ওয়েকস-রশিদের তিন ওভারেই চলে এসেছিল সে রান। বিশ্বকাপ এবং ডেথ বোলিং! ইংলিশদের দুঃস্মৃতি মনে করিয়েই দেয় শুধু। স্টোকস এবং ব্র্যাথওয়েট, কিছু বলার প্রয়োজন আছে? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে সেমিফাইনালে হেরেছিল ইংল্যান্ড, ২০২১ সালের সেই বিশ্বকাপে ডেথ ওভারে ইংল্যান্ডের চেয়ে বাজে কোন দল ছিল না! সে বিশ্বকাপে শেষ চার ওভারে ইংল্যান্ডের বোলাররা ওভারপ্রতি ১১.৩৮ রান করে দিয়েছিলেন।
ডেথ বোলিং নিয়ে ইংল্যান্ডের ভোগান্তি চলে আসছে বহুদিন ধরে। ২০২০ থেকে ২০২১- এই দুই বছরে পূর্ণসদস্য দেশগুলোর মধ্যে ডেথে সবচেয়ে খারাপ করেছে ইংল্যান্ডই। সেসময়ে শেষ চার ওভারে তাদের ইকোনমি রেট ছিল ১০.৩৩। ২০২২ বিশ্বকাপে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের চিন্তার জায়গা যদি একটাও থেকে থাকত, তবে তা ডেথ ওভারের বোলিং নিয়েই!
***
বিশ্বকাপের আগে আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সিরিজ যখন শুরু করল ইংল্যান্ড, তখনও স্যাম কারান একাদশেই অনিশ্চিত। নিশ্চিতভাবেই তিনি দলের অটো-চয়েজ ছিলেন না। বিশ্বকাপের আগে নিজের প্রথম পছন্দের একাদশ দিয়েছিলেন নাসের হুসেইন, সেখানে জায়গাই হয়নি কারানের। আরেক ধারাভাষ্যকার মার্ক বুচারের একাদশেও না।
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম ম্যাচে খেলাটা গেল একেবারে শেষ ওভারে। ২০৯ রানের টার্গেটে নামা অস্ট্রেলিয়ার লাগত ১৬ রান, সাম্প্রতিককালে ফিনিশিংয়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ওয়েড তখন ক্রিজে। চতুরতার সাথে বল করে স্যাম কারান ওয়েডকে আউট করলেন, ম্যাচ জেতালেন ৮ রানে। পরের ম্যাচে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পেলেন দায়িত্ব। ৩ ওভারে ৩৪ রান প্রয়োজন ছিল অস্ট্রেলিয়ার। বিধ্বংসী ওয়েড-ডেভিড জুটির সামনে কারান। ১৮তম ওভারে ২ রান দিয়ে ডেভিডকে আউট করে ম্যাচ থেকে ওখানেই প্রায় ছিটকে দেন অস্ট্রেলিয়াকে। ডেভিডকে আউট করেছিলেন যেভাবে, সেটিই স্যাম কারান সম্পর্কে বলে দিয়েছিল অনেক কিছু। অফসাইড হেভি ফিল্ড রেখে লেগ স্টাম্পে ইয়র্কার করেন, নিখুঁত ইয়র্কার বলতে যা বুঝায় কারানেরটা ছিল ঠিক সেটি। এক ম্যাচে ৩৫ রানে ২ উইকেট, আরেক ম্যাচে ২৫ রানে ২টি। স্যাম কারান একাদশের বাইরে, ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য তা ভাবাটা তখন কঠিনই হয়ে পড়েছিল।
এর আগে পাকিস্তান সিরিজে ৬ ম্যাচ খেলে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন ৭.৪৮ ইকোনমিতে। ডেথ ওভারে ৫ ম্যাচে একটি করে ওভার তাকে করিয়েছিল ইংল্যান্ড, তাতে ৩৯ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। সেই অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই এরপর স্যাম কারানকে ডেথ বোলারের কঠিন দায়িত্বে দেখে ইংল্যান্ড। সুযোগটা কারান লুফে নেন দারুণভাবে, সে সিরিজে ডেথে চার ওভার করে ৩৫ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। অমন পারফরম্যান্সে একটা বার্তা দেওয়ার কাজও করলেন বটে, স্যাম কারানকে একাদশের বাইরে রাখতে ভাবতে হবে বহুবার।
***
যে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ দিয়ে স্যাম কারান পাকা করলেন, সেই সিরিজ দিয়ে নতুন ভূমিকায় পদার্পণ। এর আগে তাকে নতুন বলের বোলার হিসেবেই দেখা হত। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ২১ ম্যাচের ১৫টিতেই তিনি প্রথম দুই ওভারে বোলিং করেছেন। প্রথম অথবা দ্বিতীয় ওভারে বল করে সেসব ম্যাচে ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৬ করে। উইকেটও এনে দিয়েছিলেন ৩টি। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্যাম কারান মোট ৮৫ ওভার করেছিলেন, যার মধ্যে মাত্র ১৩টি ছিল শেষ চার ওভারে। মূলত পাওয়ারপ্লে (৩৬%) ও মিডল ওভারেই (৪৮%) তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল এর আগে। ২৭ ম্যাচের মধ্যে ১৬টিতে প্রথম দুই ওভারের মধ্যে বোলিং করতে তাকে আনা হয়েছিল।
সেই কারানের মাঝেই এরপর ‘ডেথ বোলার’ দেখতে চেয়েছিল ইংল্যান্ড, সে সুযোগের সবটুকু যেন শুষেই নেন তিনি। বিশ্বকাপ আসে, কারান ম্যাচের পর ম্যাচ মুগ্ধ করে যান। প্রথম ম্যাচেই পাঁচ উইকেট! ইংল্যান্ডের ডেথ ওভারের যে মহাসমস্যা ছিল, সেটি কোথায় যে উড়ে গেল! রিস টপলির ইনজুরিতে দলে তিনি হয়ে উঠলেন আরও গুরত্বপূর্ণ। পুরো টুর্নামেন্টে শেষ চার ওভারে ৬৪ বল করেছিলেন, তাতে দেন মাত্র ৭০ রান! ৭.৭৭ গড়ে বোলিং করে উইকেট আদায় করে নেন ৯টি। এমনিতেই কি দুর্দান্ত এই বোলিং বিশ্লেষণ! আর ভারত ম্যাচ বাদ দিলে তো অবিশ্বাস্য রুপই নিয়ে নেয়। একমাত্র ভারতের সাথে ম্যাচটাই খারাপ কেটেছিল কারানের, যে ম্যাচে ডেথে ২ ওভার করে দিয়ে ফেলেছিলেন ৩১ রান। ওই ম্যাচেই শুধু পাঁচ বাউন্ডারির মার পড়েছিল তার উপর, আর সব ম্যাচ মিলিয়েই তাকে একটির বেশি বাউন্ডারি মারতে পারেননি কেউ।
গড়-গঠন দেখে তাকে মারতেই মন চায়, কারানকে নিয়ে বলেছিলেন শান মাসুদ। কিন্ত সেটি কতটা কঠিন, তাও ব্যাখা করেছিলেন শান মাসুদ, ‘সে আন্দাজ করা যায় এমন লেংথে বল করে না। ভালো ইয়র্কার করতে পারে, তার ভালো বাউন্সার আছে। সেই সাথে তার কাটার আছে এবং তার লেংথ বলগুলোও বেশ জোরের উপর আসে। তুমি যখন তার গড়ন দেখবে, মন চাইবে তার উপর চড়াও হতে, কিন্ত সে সেরকমই জাত বোলার এবং এই টুর্নামেন্টে সে তার পারফরম্যান্সে সবার থেকে আলাদা হয়েই ছিল।’
অস্ত্রাগার ভ্যারিয়েশনে ভরপুর স্যাম কারানের। কিন্ত সেসবের কোনটি কখন কাজে লাগাতে হবে, সফলতার ক্ষেত্রে তা জরুরি। কারান যা এই বিশ্বকাপে দুর্দান্তভাবে করে ব্যাটারদের ধন্দেই রেখেছেন। অস্ট্রেলিয়ার একেক মাঠের একেক রকম আকৃতি, বাউন্ডারি সাইজের কথা মাথায় রেখে বোলিং করে গেছেন চতুরতার সাথে। স্মার্ট স্যাম কারান।
***
সেমি-ফাইনালে মার্ক উড ইনজুরিতে বাদ পড়ায় দলে আসেন ইংল্যান্ডের চোখে আরেক ডেথ স্পেশালিষ্ট ক্রিস জর্ডান। ফাইনালেও থাকেন তিনি, জর্ডানের অন্তর্ভুক্তিতে পাওয়ারপ্লেতে কারানকে আরেক ওভার বেশি করান বাটলার। বাটলার আগের ম্যাচগুলোতে পাওয়ারপ্লেতে তাকে এক ওভারেই আনছিলেন, সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে তাকে আনলেন দুটি ওভারে। ফাইনালে সেই দুই ওভারে মাত্র পাঁচ রান দিয়ে ফিরিয়ে দেন প্রতিপক্ষের অন্যতম সেরা ব্যাটার রিজওয়ানকে। ডেথে এসে নিজের আসল কাজে আরও আগুন, দুই ওভারে ৭ রান দিয়ে ২ উইকেট। ফাইনালে চারটা ওভারই বাউন্ডারি ছাড়া করে হলেন প্লেয়ার অব দ্যা ফাইনাল।
মেলবোর্নের ফাইনালে ক্যামেরায় ধরলো বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা স্যাম কারানকে। মাঠের পাশে কোন এক এক্সপার্ট দাঁড়িয়ে হয়তো কথা বলছিলেন তাকে নিয়েই। হয়তো, কোন এক- এসব তো কেটে দেয়াই উচিত। যে পারফরম্যান্স করে প্লেয়ার অব দ্যা টুর্নামেন্ট হয়েছেন, তাতে তাকে নিয়ে তো কথা হবেই, তা একজন কেন, অসংখ্যজন করবে!
ইংল্যান্ড দলের ব্যাটিং লাইনআপে যেমন অনেক গভীরতা, সেই সাথে বোলিং আক্রমণের গভীরতাও কম নয়! সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যে সুযোগ আসবে সেটাই লুফে নেওয়া চাই। যেমনটা কারান করেছিলেন। বলতে গেলে অচেনা এক ভূমিকায় রাজত্ব করেছেন। দলের অনিশ্চিত একজন থেকে হয়েছেন ইংল্যান্ডের মহাসমস্যার সমাধান।
গেল বিশ্বকাপে ক্রিকেটার হয়ে তারও থাকার কথা ছিল, কিন্ত এক ইনজুরির আগমনে ছিটকে পড়তে হয় তাকে। তখন তার অন্য পরিচয়ে হয়তো তিনি নিজেও ইংল্যান্ডের ডেথ বোলিংয়ের সমস্যার কথা বলেছিলেন, কিংবা শুনেছিলেন অন্যদের কাছ থেকে, সেই সমস্যা দূর করে দেওয়ার নায়ক হবেন তিনি, তখন কী তা ভাবতে পেরেছিলেন স্যাম কারান?