• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনা যেভাবে মিলেমিশে একাকার...

    বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনা যেভাবে মিলেমিশে একাকার...    

    ১)

    অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের রেশ তখনও কাটেনি আর্জেন্টাইনদের। রাজধানী বুয়েনোস আইরেসের রাজপথে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আনন্দে নেমে এসেছেন তারা। চারপাশ আকাশি-সাদা জার্সি আর পতাকায় ছেয়ে আছে। এর মাঝে আলাদা করে নজর কেড়েছে লাল-সবুজের পতাকা। ল্যাটিন আমেরিকার দেশে বাংলাদেশের পতাকা! দুই দেশের মধ্যবর্তী দুরত্বও তো ১৭ হাজার কিলোমিটার! অবাক হতেই হয়। আকাশি-সাদার সাথে লাল-সবুজ যে মিলেমিশে একাকার। 

    ২)

    রোজারিওর রাস্তায় হাঁটছেন লিয়েন্দ্রো গালিচ্চিও। এক আর্জেন্টাইন যুবক। মোবাইলের রিয়ার ক্যামেরাটাও চালু করা তার। সেই ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা মিলল বাংলাদেশের বিশাল এক পতাকার। ফুটপাথের এক দোকানী জার্সির সাথে রেখেছেন বাংলাদেশের পতাকাও। দোকানির সাথে চলল তার আলাপচারিতা। স্প্যানিশ ঢং-এর  ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘হোপ অল আর ওয়াচিং বাংলাদেশ’। এরপর বয়স্ক সেই দোকানি ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ বলেছেন। বলেছেন ‘ভালোবাসি’।

    ৩)

    রাজধানী ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় অবস্থিত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। সেখানকার সেন্ট্রাল অডিটরিয়ামে ঘটা করে সেদিন দেখা হচ্ছিল আর্জেন্টিনা-মেক্সিকোর ম্যাচ। লিওনেল মেসির দারুণ এক গোলের পর ফুঁসে উঠে পুরো ক্যাম্পাস। উল্লাস-চিৎকারে কান পাতা দায়। মেসিদের অর্জনে বাংলাদেশি ভক্তদের গর্জন। সেই ভিডিও রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে; ফিফা, ইএসপিএন, ব্লেচার রিপোর্টের মতো নামীদামি সব প্রতিষ্ঠানের টুইটার হ্যান্ডলে। 

    টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলের মাঠে বড় পর্দায় আয়োজন করে চলছে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখা। এই হালকা শীতের রাতে প্রিয় দলের খেলা দেখতে দলবলে হাজির হয়ে যান সেখানে। আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচই তারা দেখেছেন সারিতে বসে। সেই ছবিগুলোও ‘ভাইরাল’। বার্ডস আই ভিউ থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই বাংলাদেশ নাকি আর্জেন্টিনার কোনো জায়গা। রাতের অন্ধকার চিরে, বড় এলইডি স্ক্রিনের আলোতে যতদূর চোখ যায় কেবলই আলবিসেলেস্তেদের আকাশি-সাদা জার্সি। উইজডেন’, ‘দ্য অ্যাথলেটিক’-এ ছাপা হয়েছে এই উন্মাদনার খবর। বাদ নেই আর্জেন্টিনার টিভি চ্যানেলগুলোও।

    এই উন্মাদনার কথা জানতে পেরেছেন মেসিদের কোচ লিওনেল স্কালোনি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আলাদা করে কথা বলেছেন বাংলাদেশ নিয়ে। সেই কথাগুলো ছুঁয়ে গেছে বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন ভক্ত-সমর্থকদের। 

    ৪)

    প্রথম দুই অনুচ্ছেদে যেসব উন্মাদনার কথা পড়েছেন, সেসবের সূতিকাগার হচ্ছে ঠিক আগের অংশের শব্দগুলো। আর্জেন্টাইনরা বাংলাদেশিদের এই অকুণ্ঠ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে নিয়েছে অনন্য এক উদ্যোগ। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সমর্থন করতে আস্ত এক ফেসবুক গ্রুপ খুলে বসেছেন তারা। নাম ‘fans Argentinos de la seleccion de cricket de Bangladesh'

    সেই গ্রুপে আর্জেন্টাইনরা মেতেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের বন্দনায়। তারা এখন পৃথিবীর অন্য গোলার্ধ, ভিন্ন আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সাকিব আল হাসান-মেহেদী হাসান মিরাজদের চেনেন। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের দুই ওয়ানডে জয়টাও উদযাপন করেছেন তারা। আর্জেন্টিনার টিভি চ্যানেলেও সেই খবর চলছে আড়ম্বরে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, পর্যটন, শিল্প এমনকি বিখ্যাত লেখকদের নিয়েও তাদের আগ্রহের কমতি নেই। মজার ব্যাপার, আর্জেন্টিনার এক কুকিং শো’তে রান্না করা হচ্ছে বাংলাদেশি বিরিয়ানিও।  

    ৫)

    স্বভাবতই আর্জেন্টাইনরা বাংলা লিখতে বা বলতে জানেন না। তাই বলে থেমে নেই তারা। গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে দেদারসে বাংলা লিখছেন। এমনকি বাংলা বলছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন বাংলাতেই। এই পাগলামির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বাংলাদেশ আর আর্জেন্টিনাকে এক করেছে ফুটবল। অথচ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, জীবনযাপন, জাতিগত আচরণে কত পার্থক্য দুই দেশের। তবুও সেসব বাধা হলো কই? 

    দুই দেশের ১৭ হাজার কিলোমিটারের দুরত্বও যেন ঘুচে গেছে এক লহমায়। বাংলাদেশীরা রাত জেগে খেলা দেখছেন, উল্লাসে মাতছেন, গলা ফাটাচ্ছেন মেসিদের জন্য। লুসাইল, স্টেডিয়াম ৯৭৪ ফিরে আসছে যেন এই বাংলার বুকে। তাদের পরাজয়ে বিমর্ষ হচ্ছেন। জবাবে রোজারিওর এক আর্জেন্টাইন যুবক ঘোষণা দিয়ে হাতে আঁকাচ্ছেন বাংলাদেশের পতাকার উল্কি। 

    এভাবেই তো মিলেমিশে একাকার বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনা।