• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    মরক্কোর রূপকথা: কীভাবে হাকিমির মতো ঘরছাড়া পাখিদের এককাট্টা করল তারা?

    মরক্কোর রূপকথা: কীভাবে হাকিমির মতো ঘরছাড়া পাখিদের এককাট্টা করল তারা?    

    বিশ্বকাপ ইতিহাসে মাত্র চতুর্থ আফ্রিকান দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছে মরক্কো। মরক্কোর উন্মত্ত উদযাপনের মাঝেও নিজেদের সংস্কৃতির ঝান্ডা বয়ে চলা খেলোয়াড়গুলো যে তাদের সাফল্যে ভুমিকা রাখা মানুষগুলোকে ভুলছে না সেটা নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর। জয়ের পরে একত্রে মাঠে সিজদাহ দেওয়া বলুন, আর গ্যালারিতে বসে থাকা মায়ের দিকে ছুটে গিয়ে মায়ের চুম্বনে, আলিঙ্গনে নিজেকে বেঁধে ফেলা হাকিমির কথাই বলুন - মরক্কো দলটা প্রতিনিয়তই যেন মন জয় করে চলেছে, খেলা দিয়ে ও মাঠের বাইরে নিজেদের একাত্মতা দিয়ে। আর এই একাত্মতা, একাগ্রচিত্তে লড়ে যাওয়ার মানসিকতার কথা আলাদা করে না বললেই নয়। যেই দলের ২৬ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১৪ জন খেলোয়াড়ের জন্মই মরক্কোর বাইরে সেই দলটা যেন প্রতিনিয়তই প্রমাণ করে চলেছে, মানচিত্রের বুকে আপনার অবস্থান যেখানেই হোক নিজ কৃষ্টি-সংস্কৃতির ডোরেই বাঁধা সকলে দিনশেষে। নিজের শেকড়ের সন্ধানে খুঁজে ফেরা মরক্কোর এই খেলোয়াড়গুলোও তাই তাদের পার্থক্য ভুলে এক হয়ে লড়ছেন এক পতাকা, এক ব্যাজের জন্যই।

    আফ্রিকার আরব এই দেশের পতাকা, খেলোয়াড়দের জন্য তো গলা ফাটাচ্ছে স্টেডিয়ামের একাংশও। যেই কাতারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ অভিবাসী, তারাও বোধহয় নিজের শেকড়ের সন্ধানে প্রতিনিয়ত লড়ে চলা এই দলটার মাঝে নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। আফ্রিকার শেষ দেশ, সেই সাথে বিশ্বকাপে টিকে থাকা শেষ আরব রাষ্ট্র - মরক্কোর জন্য কাতারের বুকে সমর্থনের অভাব হচ্ছে না।

    সেই সমর্থনের সুযোগটা অবশ্য মিলত না যদি মরক্কো তার অভিবাসী প্রতিভাগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা না করত। ৩৭০ লাখ মানুষের দেশটার ফুটবল সাফল্যের সাথে যে তার ৪ লাখ অভিবাসীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত পশ্চিম ইউরোপের দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই অভিবাসীরা যে ফুটবলীয় সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। সেই সাথে মরক্কোর ডামাডোলের মাঝে বেড়ে ওঠা ফুটবলারদের চেয়ে যে খাবারের মান, আবহাওয়ার দরুন ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কানরা শক্তপোক্ত হয়ে বেড়ে উঠছে সেটা সম্ভবত প্রথম মাথায় এসেছিল ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোচ ইউগোস্লাভ ব্লাগোয়ে ভিদিনিচের মাথায়। একটা ফ্রেঞ্চ পত্রিকায় তখন ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা মুস্তাফা হাজির কথা জানতে পেরেই তাকে দলে ভেড়ান তিনি। পথটা সেখান থেকেই দেখিয়েছিলেন তিনি।

    সেই পথে হেঁটে ২০১৪ সালে এই ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কানদের দলে ভেড়াতে মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন এক পরিকল্পনা হাতে নেয় যেটার মূলমন্ত্র ছিল - “দেশের প্রতিভা দেশের মাটিতেই ফিরিয়ে আনো”। এমনকি নেদারল্যান্ডসে জন্ম নেওয়া ফুটবলার মোহামেদ ইহাতারেনকে ফিরিয়ে আনতে তার বাবার শেষকৃত্যের দায়িত্বও নিয়েছিল মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন। তার বাবাকে মরক্কোর মাটিতে দাফনের সব তোড়জোড় সেবার করে দিয়েছিল ফেডারেশন।

    তবে শুধু মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশনের চেষ্টা নয়, মরক্কোর খেলোয়াড়দের দেশের হয়ে খেলতে ফিরে আসার সিদ্ধান্তের পেছনে হয়ত আছে আরও অনেক কারণ। যেখানে অন্য আফ্রিকান দেশগুলো সাধারণত তাদের জন্মস্থলের হয়ে খেলার সুযোগ না পেলে ঠাই পেতে নেয় নিজের দেশের দলে, সেখানে মরক্কো তো উলটো ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে মুল দলে সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়কেই! ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডস দলে ডাক পেয়েছিলেন হাকিম জিয়েশ, সেই ডাকে সাড়াও দিয়েছিলেন। তবে নেদারল্যান্ডসে জন্ম নিয়েও অনবরত ডাচদের কাছ থেকে ‘মারোক্কানেন’ ডাক শোনা, ডাচদের মাঝেই বেড়ে উঠেও একজন ডাচ না হতে পারার আক্ষেপটা তাকে বোধহয় পোড়াত বেশ। সেই সাথে মরক্কোর নিরন্তর প্রচেষ্টা থেকেই জিয়েশ হয়ত বুঝেছিলেন, তাকে আপন করে নেবার জন্য দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার দেশ।

    সেই দেশের টানে তিনি ঠিকই ফিরলন। কিন্তু সাবেক কোচ হালিহোদজিচের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে অবসরেই চলে গেলেন। ভাগ্যিস বিশ্বকাপের আগেই দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ওয়ালিদ রেগরাগুই তাকে দলে ফিরিয়েছিলেন! ফান্সে বেড়ে ওঠা রেগরাগুই যে প্রবাসে বেড়ে ওঠা এই খেলোয়াড়দের মানসিক টানাপড়েনের বিষয়টা নিজেও ভালই বোঝেন। সেই থেকে তো বিশ্বকাপেও জিয়েশ তাই প্রতিদান দিয়েই চলেছেন।

    প্রতিদানটা শুধু জিয়েশ নয়, ফ্রাঙ্কফুর্টের এক কোণে কষ্টে বেড়ে ওঠা আবদেলহামিদ সাবিরি দিয়েছেন, দিয়েছেন মাদ্রিদের এক দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আশরাফ হাকিমিরাও। আর তাদের হয়ে গলা ফাটিয়ে চলেছেন প্রবাসে থেকেও মরক্কোর বুকে মন পড়ে থাকা মরক্কানরা। বেলজিয়ামকে হারানোর পর তাই বেলজিয়ামের রাস্তায় নেমে আসতেও পিছপা হননি তারা, বেলজিয়ানদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে উন্মত্ত উদযাপন করতে গিয়ে এমনকি বিবাদেও জড়িয়েছেন তারা। মরক্কোর এই দলটা যে তাই শুধু ফুটবলীয় রূপকথার উপাখ্যান লিখে চলেছেন তাই নয়, মানচিত্রের ব্যবচ্ছেদে ছড়িয়ে পড়া মরক্কানদের, সর্বোপরি আরবদের নিয়ে এসেছেন এক কাতারে। সীমানার কাঁটাতার হয়ত তাদের আজ ঠেলে দিয়েছে হাজার হাজার মাইল দূরে, তবে জিয়েশ, হাকিমিরা তাদের আবারও বেঁধেছেন একই সুতোর গাঁথায়।