রোনালদোর চোখের জলে বিদায়: নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয় একদিন...
শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে মাটিতে বসে পড়লেন। দুই হাতে মুখ ঢাকলেন। এরপর আর অপেক্ষা করলেন না। সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলেন টানেল দিয়ে, অশ্রুসিক্ত চোখ মোছার চেষ্টা করছিলেন বার বার। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কাঁদছেন, দৃশ্যটা শেলসম হয়ে বিঁধেছে অনেক দর্শকের হৃদয়ে। রোনালদোকে কাঁদতে এই প্রথম দেখা যায়নি। ইউরো জয়ের পর কেঁদেছেন আনন্দের কান্না, আবার আগে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর চোখের জলে মাঠ ছেড়েছেন। সেই ২০০৪ ইউরোতে যখন মাত্র শুরু করেছেন ক্যারিয়ার, তখনই কেঁদেছিলেন তীরে এসে তরী ডোবায়। তবে কালকের কান্নাটা ছিল অন্যরকম। অলৌকিক কিছু না হলে বিশ্বকাপের মঞ্চে এটাই তার শেষ কান্না।
রোনালদো এমন একজন, যার পুরো জীবনটাই আসলে হতে পারত আপনার আমার মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষের মতো। টানাটানির সংসারে বাবা মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকেন, ভাই ড্রাগ অ্যাডিক্ট- এমন একটা পরিবারের ছেলের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাটাই তো অপরাধ। রোনালদো শুধু সেটা করেনইনি, বলে কয়েই করেছেন। লিফটে চড়ে ওপরে ওঠেননি, প্রতিটা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে একটু একটু করে উঠেছেন ওই চূড়ায়। যখনই তার সামর্থ্য নিয়ে সংশয় জেগেছে, যখনই তাঁর ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে- সবচেয়ে বড় আসরকে সেই জবাব দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন। রোনালদো প্রমাণ করেছেন, পরিশ্রম আর সাধনা থাকলে মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই। আজকালকার মোটিভেশনাল স্পিকাররা যখন মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে খরচ করছেন আবেগঘন বক্তব্য, তখন রোনালদোর চেয়ে বড় ‘মোটিভেশন’ সম্ভবত আপনার দরকার নেই। আপনি জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন, জীবনানন্দের ওই কবিতার মতো ‘আপনি অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চান না’- রোনালদো আপনাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে হারার আগে হাল ছাড়া যাবে না। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়তে হবে। রোনালদো যেমন বলেছেন, ‘আমি নিজেকে সবসময় নিজেকে জয়ী ভেবে এসেছি। এবং যতদিন বাঁচব ততদিন এটাই মনে করব। আমি মনে করি, সেরা হওয়াটাই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য। হেরে গেলে আমি কারও সঙ্গে কথা বলি না, মায়ের সঙ্গেও নয়। আমি আসলে এরকমই।’ কথাগুলো হয়তো আপনার কাছে ঔদ্ধত্য মনে হতে পারে, আত্মকেন্দ্রিকতাসর্বস্ব মনে হতে পারে। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা- নিজের ওপর যদি নিজের বিশ্বাস না থাকে তাহলে তো কিছু পাওয়া যায় না। সেটা হয়তো কেউ মুখে বলে, আর কেউ বলে না।
রোনালদো আসলে এমনই। মনে যা এসেছে, মুখে তা অকপটে বলেছেন সবসময়। আগেও বলেছেন, ‘কোনো ভনিতা আমি পছন্দ করি না। আমি যেটা বিশ্বাস করি, সেটা সরাসরি বলতে পছন্দ করি। তাতে কে কী মনে করল সেটা নিয়ে আসলে আমার কিছু আসে যায় না।’ এই স্পষ্টভাষিতার জন্য ‘শত্রুও’ কম হয়নি তাঁর, সাবেক ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার পর্যন্ত খোঁচা দিয়েছিলেন রোনালদোকে। গোল করেই সেটার জবাব দিয়েছেন।
তবে এই স্পষ্টবাদিতার জন্য কিছু কথা একসময় সত্যি সত্যিই অহংকারের মতো শুনিয়েছে। আট বছর আগে যেমন বলেছিলেন, ‘মানুষ আমাকে হিংসে করে, কারণ আমি ধনী এবং দেখতে সুন্দর’। ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছেন, তবে ‘মুখে এক মনে আরেক’ লোকজনের মতো কথাটা অস্বীকার করেননি। বরং একটা সময় সেটা নিয়ে অনুতাপ হয়েছে, প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন ওই কথাটা বলা তাঁর তখন উচিত হয়নি। স্বীকার করেছেন, ‘কেউই নিখুঁত নই, আমিও নই। আর সবার মতোই আমিও রক্তমাংসের মানুষ, ভুল আমারও হয়। ওই সময় কথাগুলো বলা আমার উচিত হয়নি। আমি ভুল করেছি।’ গত কয়েক মাসে এমন নানা অনাকাঙ্খিত কারণে বার বার আলোচনায় এসেছেন। আগে মাঠেই এসবের জবাব দিয়েছেন। বিশ্বকাপের মঞ্চ হতে পারত জবাব দেওয়ার সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। প্রথম ম্যাচেই গোল করে সেরকম আভাসও দিচ্ছিলেন। কিন্তু পরে ধীরে ধিরে হয়ে পড়লেন কক্ষচ্যুত। দুই ম্যাচে একাদশেই থাকলেন না, কোয়ার্টার ফাইনালে অবশ্য বদলি নেমে চেষ্টা করেছিলেন কিছু করার। পারেননি। যেন বার্তা দিয়েছেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।
তবে দিন শেষে রোনালদো একজন মানুষ। ‘রক্ত-মাংসের মানুষ’ কথাটাই আসলে সত্যিকারের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। যে ব্যর্থতায় হোক আর সাফল্যে হোক, চোখের জল লুকানোর কোনো চেষ্টা করে না। বরং স্বীকার করে, ‘কান্নার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। ছোটবেলায় হেরে গিয়ে অনেক কেঁদেছি, এখনও আমি হেরে গেলে বা জিতলেও কাঁদি- । এমন কথা জানান দেয়, রোনালদোর মধ্যে একটা সংবেদনশীল মনও আছে। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বাবার কথা মনে পড়ায় কিছুদিন আগেও ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। যে জন্য দুই যুগ আছে মাদেইরাতে ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করা তরুণীর কথা ভোলেননি এই বয়সে এসেও, যারা ক্ষুধার্ত রোনালদোকে প্রতিদিন চুরি করে বার্গার খাওয়াতেন। ভোলেননি মাদেইরার নিজের মানুষদের কথা, ভোলেননি তিনি কোত্থেকে উঠে এসেছেন। নিজের ছেলে যে এত আদরে আর প্রাচুর্যে বড় হচ্ছে, সেটি নিয়ে নিজের আক্ষেপের কথা বলেছেন। চেয়েছেন, সন্তানেরা জগতের রূঢ় বাস্তবতা চিনতে শিখুক। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একটি হয়েও তাই মাঠে অনাহূত আগন্তুকদের নিরাপত্তারক্ষীদের উপেক্ষা করে টেনে নিয়েছেন বুকে, তাদের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন।
তবে একই সঙ্গে রোনালদো বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, চেষ্টা আর নিবেদনের ওপর কিছু নেই। সতীর্থেরা যখন অনুশীলন শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন, রোনালদো বাড়তি সময় পরিশ্রম করেছেন। ফুটবল মৌসুমে তাঁর জীবন একেবারে ঘন্টার কাঁটায় বাঁধা, সেখানে কোনো নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই। নিজের শরীরকে মনে করেন তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ, সেটা ফিট রাখার জন্য তার পরিশ্রমের তাই কোনো কমতি রাখেন না। .৩৫ পেরুনোর পরেও যখন ফুটবলাররা ব্যস্ত অবসর কাটানোয়, রোনালদো দেখিয়ে দিচ্ছেন চাইলে মানুষ কী না পারে? ক্যারিয়ারে কম বিতর্ক আসেনি, তাঁর মতো আলোচিত-সমালোচিত কেউ থাকলে সেটা সম্ভবত শুধু ম্যারাডোনাই। মাঠে মাঠের বাইরে যা-ই হোক, যত ঝাপটাই যাক, রোনালদো পাখির পালকের মতো মাঠের খেলায় কোনো দাগ লাগতে দেননি, প্রতিদিন নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন নতুন উচ্চতায়।
কিন্তু এই বিশ্বকাপ বলল, সবকিছুরই আছে শেষ। রোনালদো নিজে এখনো বলেননি কিছু। দেশের হয়ে আর কতদিন খেলবেন, সেই উত্তরটাও নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। তবে লোকটা রোনালদো বলেই তার এপিটাফ লিখে রাখা যায় না। যতদিন শেষ বলবেন না, ততদিন তো লড়াই চলবেই!
(এই লেখাটির অংশবিশেষ প্যাভিলিয়ন সম্পাদক অম্লান মোসতাকিম হোসেনের বই 'নায়কদের নেপথ্যের' অংশবিশেষ। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া যাবে এখানে বা এখানে)