কেন হেক্সা মিশন এবারও অধরা থেকে গেল ব্রাজিলের?
আরও একবার নকআউট পর্বে দেখা হওয়া প্রথম ইউরোপীয় দলের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল ব্রাজিল। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়ামের পর এবার ব্রাজিলের ঘাতক ক্রোয়েশিয়া। প্রায় প্রতিবার ফেভারিট হিসেবে টুর্নামেন্টে আসা সেলেকাওরা গত পাঁচ বিশ্বকাপে চতুর্থবারের মতো বিদায় নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। একইসঙ্গে আকস্মিক ও রুটিনমাফিক এই পরাজয়ের পিছনে দায় কার?
ছোট উত্তর হচ্ছে, ভাগ্য সহায় হয়নি ব্রাজিলের।
টাইব্রেকারে সবসময়ই ভাগ্যের হাত থাকে। তবে ম্যাচ শ্যুটআউটে যাওয়ার আগেও ব্রাজিল ধরা খেয়েছে দুর্ভাগ্যজনক এক কাউন্টার অ্যাটাকে। ১-০ গোলে এগিয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা ব্রাজিল ব্রুনো পেটকোভিচের ডিফ্লেক্টেড এক শটে পরাস্ত হয়েছে। যেটি ছিল ১২০ মিনিটে গোলমুখে ক্রোয়েশিয়ার নেওয়া একমাত্র শট।
বলা যায় অতিরিক্ত সময়ের শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক চাপ ব্রাজিলের ডিফেন্ডিংকে প্রভাবিত করেছিল, বিশেষ করে ১১৭ মিনিটের সেই ক্রোয়েশিয়ান আক্রমণে। সাধারণত বল হারানোর পর ব্রাজিল হয় উপরের দিকে প্রেস করে, অথবা ডিফেন্সে ড্রপ ব্যাক করে। কিন্তু এবার বল খোয়ানোর পর একই সঙ্গে দুটোই করতে দেখা যায় ব্রাজিলকে। ক্রোয়েশিয়া তাদের বিল্ড-আপ করেছে মধ্যমাঠের গ্যাপ দিয়ে, যেখানে সাধারণত অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে থাকেন কাসেমিরো। কাসেমিরো ও বদলি নামা ফ্রেডের অনুপস্থিতি মধ্যমাঠ থেকে বল সামনে নেওয়াটা একেবারে সহজ করে দেয় ক্রোয়েশিয়ার জন্য। পরে গোলরক্ষক বরাবর নেওয়া পেটকোভিচের শট জালে জড়ায় পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা থিয়াগো সিলভার পায়ে লেগে।
কিন্তু ম্যাচ এই জায়গায় কীভাবে গেল? ব্রাজিল কেন নির্ধারিত সময়ে জয় নিশ্চিত করতে পারেনি?
ইনজুরি সমস্যা
দুইভাবে ব্রাজিলের খেলাকে প্রভাবিত করেছে ইনজুরি সমস্যা। প্রথমত, এর ফলে আক্রমণভাগে ব্রাজিলের প্রেসিং দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তিনদিনের দ্বিতীয়বারের মতো শুরুর একাদশে জায়গা পেলেও নেইমার ঠিক শতভাগ ফিট ছিলেন না। নেইমারের চেয়েও বাজে অবস্থা নিয়ে নেমেছিলেন রিচার্লিসন। উরুর চোট নিয়ে খেলতে নামা ব্রাজিল নাম্বার নাইন এদিন ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণকে প্রেসই করতে পারেননি। যেখানে তার মাধ্যমেই ব্রাজিলের প্রেস শুরু হওয়ার কথা, সেখানে রিচার্লিসনের অক্ষমতা ক্রোয়েশিয়াকে সুযোগ করে দিয়েছে রক্ষণে নিজেদের মধ্যে বল রেখে সময় নষ্ট করার। পাশাপাশি আক্রমণে না গিয়েও খেলার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পেয়েছে লুকা মদ্রিচরা। গ্যাব্রিয়েল জেসুস সুস্থ থাকলে রিচার্লিসনের জায়গায় এই ম্যাচে তাকে শুরু করাতে পারতেন তিতে।
ইনজুরি দ্বিতীয় যেই জায়গায় ব্রাজিলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা হচ্ছে ফুলব্যাক পজিশন। ইনজুরি থেকে ফেরা লেফটব্যাক অ্যালেক্স সান্দ্রোর ম্যাচ শুরু করার মতো ফিটনেস ছিল না, শুধু শেষ ১৫ মিনিট খেলেছেন তিনি। অপর লেফটব্যাক অ্যালেক্স টেলেসের বিশ্বকাপ আগেই শেষ হয়ে গেছে ইনজুরিতে। যে কারণে, দ্বিতীয়বারের মতো এই পজিশনে খেলানো হয় রাইটব্যাক দানিলোকে, যিনি নিজেও শতভাগ ফিট ছিলেন না। সেন্টারব্যাক মিলিতাও যথারীতি পূরণ করেছে রাইটব্যাক পজিশন।
বাস পার্ক করা রক্ষণের বিপক্ষে নিচে থেকে আক্রমণে উঠাটা জরুরী। ব্রাজিলের হয়ে এই কাজটা আংশিকভাবে করেছেন মিলিতাও। মাঠের ডানপাশ দিয়ে বল নিয়ে বেশ কয়েকবার আক্রমণে উঠেছেন তিনি। কিন্তু বাম পাশ থেকে সমান অ্যাটাকিং থ্রেট তৈরি করতে পারেননি দানিলো।
ফরমেশন
গত দেড় বছর ধরে দুই উইঙ্গার নিয়ে খেলছে ব্রাজিল। লিডসের হয়ে দুর্দান্ত খেলা রাফিনহা প্রথম সুযোগেই দখল করেছেন ব্রাজিলের রাইট উইং পজিশন। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে বৈশ্বিক তারকা হয়ে ওঠা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে ভালো খেলেছেন এই বিশ্বকাপেই।
গত কয়েক মাসে গোলমুখে রিচার্লিসনের ফর্ম তাকে এনে দিয়েছে নাম্বার নাইন পজিশনটি। নাম্বার টেন নেইমারের সঙ্গে এই বিশ্বকাপের অ্যাটাকিং প্রতিভাদের বিস্ফোরণ দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেই দেখেছে সবাই।
কিন্তু কঠিন প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে কিছুটা ভুগতে হয়েছে ব্রাজিলকে। ৪-২-৩-১ ফরমেশনে মিডফিল্ডে কিছুটা দুর্বল হয়ে যায় ব্রাজিল। সামনের চারজনের সঙ্গে মিডফিল্ডের যোগাযোগও দুর্বল হয়ে যায়। উইঙ্গার দিয়ে খেলা শুরু করার আগে ব্রাজিলের আক্রমণের মূল অংশ ছিল নেইমার ও লুকাস পাকেতার লিংক-আপ। নেইমার ১০৬ মিনিটের গোলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এই লিংক-আপ।
কিন্তু কাসেমিরোর সঙ্গে মিডফিল্ডের ডাবল পিভটে ম্যাচ শুরু করা পাকেতা এখন আর আগের মতো বল ডিস্ট্রিবিউট করার বা নেইমারের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার সুযোগ পান না। পাকেতাকে দশ (অ্যাটাকিং মিডফিল্ড) এবং নেইমারকে নাম্বার নাইন হিসেবে খেলালে হয়তো প্রতিপক্ষ রক্ষণকে ভাঙার সম্ভাবনা আরও বেশ থাকত ব্রাজিলের।
পাকেতা ও কাসেমিরো মিডফিল্ড আরেকভাবে ভুগেছে ক্রোয়েশিয়ার কাছে। সামনে ব্রাজিল ঠিকমতো প্রেস না করায় মিডফিল্ডে বেশি মানুষ নিয়ে (ব্রাজিলের দুইয়ের বিপরীতে ক্রোয়েশিয়ার তিন) বলের দখল রাখতে সামর্থ্য হয়েছে মদ্রিচরা।
তবে ইনজুরি ও ফরমেশনের দুর্বলতা নিয়েও ক্রোয়েশিয়াকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল ব্রাজিল। রক্ষণে একবার মনোযোগ হারিয়ে ও দুটি পেনাল্টি মিস করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাদ পড়েছে তিতের দল। প্রতি টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রত্যাশা করা ব্রাজিল ভক্তরা এই নিষ্ঠুর বিদায় মেনে নিতে পারছে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এরকম ট্র্যাজেডির পর পূর্বে অনেকবার পথ হারিয়ে ফেলা ব্রাজিল বোর্ডকে লক্ষ্য রাখতে তিতে তার ছয় বছরে জাতীয় দলে যেই স্থিতিশীলতা এনেছেন, সেটি যেন নষ্ট হয়ে না যায়।