অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনা, ঘরোয়া ফুটবলে বিনিয়োগ: মরক্কোর বিশ্বকাপে-চমক কোনো কাকতাল নয়...
প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে গিয়ে ইতিহাস গড়েছে মরক্কো। তাদের এই সাফল্য অবশ্য মোটেই কাকতাল নয়। দেশটির ফুটবল ফেডারেশন, কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাউই থেকে আছে অনেকের অবদান।
২০০৭ সালে মরক্কোর তৎকালীন রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ ফুটবলের উন্নয়নের জন্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হয়েছিল মরক্কোর একাডেমির উন্নয়নে। আন্তর্জাতিক মানের একটা একাডেমি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই মরক্কোতে খেলা আবুদুল্লা ওনোহি, নায়েয় আগুয়ের্দ ও পর্তুগালের বিপক্ষে গোল করা ইউসেফ এন নেসরি উঠে এসেছেন এমন একাডেমি থেকেই। এই একাডেমিতে আছে আটটি ফিফার সমপর্যায়ের মাঠ, চারটি ফাইভ স্টার হোটেল, একটি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক মানে ইনডোর স্টেডিয়াম, একটি মেডিক্যাল সেন্টার।
এই একাডেমির সাথে সমঝোতা আছে ফ্রেঞ্চ ক্লাব লিঁওর,যারা এখান থেকে দলে নিয়েছে একাডেমির বেশ কিছু খেলোয়াড়কে। মরক্কোর ক্লাব অয়াইদাদ কাসাব্লাংকার আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পেছনে তাই সরাসরি অবদান আছে এই একাডেমির। এমনকি মেয়েদের ফুটবলেও আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস জিতেছে মরক্কোই এক ক্লাব এএস ফার। তাই এ তো গেল নিজের দেশের কথা। বাইরে থেকে খেলোয়াড় নিয়ে আসার কাজটা শুরু হয়েছে আরও আগে।
৩৭০ লাখ মানুষের দেশটার ফুটবল সাফল্যের সাথে তার ৪ লাখ অভিবাসীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত পশ্চিম ইউরোপের দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই অভিবাসীরা যে ফুটবলীয় সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। সেই সাথে মরক্কোর ডামাডোলের মাঝে বেড়ে ওঠা ফুটবলারদের চেয়ে যে খাবারের মান, আবহাওয়ার দরুন ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কানরা শক্তপোক্ত হয়ে বেড়ে উঠছে সেটা সম্ভবত প্রথম মাথায় এসেছিল ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোচ ইউগোস্লাভ ব্লাগোয়ে ভিদিনিচের মাথায়। একটা ফ্রেঞ্চ পত্রিকায় তখন ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা মুস্তাফা হাজির কথা জানতে পেরেই তাকে দলে ভেড়ান তিনি। পথটা সেখান থেকেই দেখিয়েছিলেন তিনি।
সেই পথে হেঁটে ২০১৪ সালে এই ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কানদের দলে ভেড়াতে মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন এক পরিকল্পনা হাতে নেয় যেটার মূলমন্ত্র ছিল - “দেশের প্রতিভা দেশের মাটিতেই ফিরিয়ে আনো”। এমনকি নেদারল্যান্ডসে জন্ম নেওয়া ফুটবলার মোহামেদ ইহাতারেনকে ফিরিয়ে আনতে তার বাবার শেষকৃত্যের দায়িত্বও নিয়েছিল মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন। তার বাবাকে মরক্কোর মাটিতে দাফনের সব তোড়জোড় সেবার করে দিয়েছিল ফেডারেশন।
তবে শুধু মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশনের চেষ্টা নয়, মরক্কোর খেলোয়াড়দের দেশের হয়ে খেলতে ফিরে আসার সিদ্ধান্তের পেছনে হয়ত আছে আরও অনেক কারণ। যেখানে অন্য আফ্রিকান দেশগুলো সাধারণত তাদের জন্মস্থলের হয়ে খেলার সুযোগ না পেলে ঠাই পেতে নেয় নিজের দেশের দলে, সেখানে মরক্কো তো উলটো ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে মুল দলে সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়কেই! ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডস দলে ডাক পেয়েছিলেন হাকিম জিয়েশ, সেই ডাকে সাড়াও দিয়েছিলেন। তবে নেদারল্যান্ডসে জন্ম নিয়েও অনবরত ডাচদের কাছ থেকে ‘মারোক্কানেন’ ডাক শোনা, ডাচদের মাঝেই বেড়ে উঠেও একজন ডাচ না হতে পারার আক্ষেপটা তাকে বোধহয় পোড়াত বেশ। সেই সাথে মরক্কোর নিরন্তর প্রচেষ্টা থেকেই জিয়েশ হয়ত বুঝেছিলেন, তাকে আপন করে নেবার জন্য দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার দেশ।
সেই দেশের টানে তিনি ঠিকই ফিরলন। কিন্তু সাবেক কোচ হালিহোদজিচের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে অবসরেই চলে গেলেন। ভাগ্যিস বিশ্বকাপের আগেই দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ওয়ালিদ রেগরাগুই তাকে দলে ফিরিয়েছিলেন! ফান্সে বেড়ে ওঠা রেগরাগুই যে প্রবাসে বেড়ে ওঠা এই খেলোয়াড়দের মানসিক টানাপড়েনের বিষয়টা নিজেও ভালই বোঝেন। সেই থেকে তো বিশ্বকাপেও জিয়েশ তাই প্রতিদান দিয়েই চলেছেন।
প্রতিদানটা শুধু জিয়েশ নয়, ফ্রাঙ্কফুর্টের এক কোণে কষ্টে বেড়ে ওঠা আবদেলহামিদ সাবিরি দিয়েছেন, দিয়েছেন মাদ্রিদের এক দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আশরাফ হাকিমিরাও।এই দলের জিয়েশ, আমরাবাতসহ চার জনের জন্ম নেদারল্যান্ডসে, হাকিমি, মিনিরের স্পেনে, সাইস, বুফালের ফ্রান্সে, চেদিরার ইতালিতে আর চারজনের বেলজিয়ামে।
এই ঘরছাড়া পাখিদের জন্যই বিশ্বকাপে সম্ভব হয়েছে মরক্কোর রূপকথা।