সঙ্গীতে, শোরগোলে, স্লোগানে উত্তাল পুরো আর্জেন্টিনার মুখে মুখে মেসিদের নাম
ক্রোয়েশিয়াকে প্রথম সেমি-ফাইনালে এরই মধ্যে বিধ্বস্ত করে ফাইনালে চলে গিয়েছে আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের সমান রেকর্ড ৬ষ্ঠ ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা (এর চেয়ে বেশি ৮ বার ফাইনাল খেলেছে কেবল জার্মানি)। ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে ঘিরে যেই স্বপ্ন দেখত প্রতিটি আর্জেন্টাইন, সেই স্বপ্নের কান্ডারি বহু বছর ধরেই এখন লিওনেল মেসি। ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রয়াণের পর এটাই আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শেখানো মেসি এসেছিলেন শেষের ঘোষণা দিয়ে। আর প্রতিটি ম্যাচ যেন খেলে যাচ্ছেন নিজের শেষ ম্যাচের মত। মেসির মহিমায় আর্জেন্টিনা যেমন মহিমান্বিত, তেমনই আনন্দে উদ্বেলিত। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে গতকাল নেমেছিল মানুষের ঢল।
বিশ্বকাপের আগ থেকেই এতটা যত্ন করে স্বপ্ন আর্জেন্টাইনরা শেষ কবে বুনেছেন! আর সেই স্বপ্নে সৌদি আরব যখন শুরুতেই বিশাল এক ধাক্কা দিল, সেখান থেকে আর্জেন্টাইনরাও তো প্রতিটা ম্যাচ তাদের শেষ ম্যাচ হতে পারে ভেবেই খেলা দেখতে বসেছেন। বিশ্বকাপের এই উন্মাদনা, এই উত্তেজনা কারও জন্য হয়ে থাকছে আজীবন মনে রাখার মত, আবার কারও জন্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে শ্বাসরুদ্ধকর, আবার কারও জন্য আবেগপ্রবণ। যেই ডিয়েগোকে নিয়ে তারা স্বপ্ন দেখতেন তার উত্তরাধিকার আরও একবার ঠিকই তাদের নিয়ে গিয়েছে স্বপ্ন পূরণের হাত ছোঁয়া দূরত্বে, আক্ষেপ একটাই - দেখে যেতে পারলেন না ডিয়েগো। তবে ডিয়েগোকে তো কখনই তাদের কাছে মর্তবাসী মনেই হয় নাই। মেসিকে হয়তো ওপর থেকে আশীর্বাদের আলিঙ্গনে বেঁধেছেন ডিয়েগো। রামেইরো মন্তেইরো নামের এক বেকার যুবকও বিষয়টা দেখছেন সেভাবেই। তার জীবনে আনন্দ বলতে অবশিষ্ট আছে বোধহয় এটুকুই। ডিয়েগো ওপর থেকে তাদের সাথেও আনন্দে চিৎকার করছেন বলেই ধারণা তার, “আগের যেকোনো বিশ্বকাপের চেয়ে এবারের বিশ্বকাপ আমাদের জন্য আলাদা। আমাদের ডিয়েগো যে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, সেই সাথে মেসিরও শেষ বিশ্বকাপ এটা।”
মন্তেইরোর মত আবেগপ্রবণ না হলেও আর্জেন্টিনার ক্যাফেগুলো শান্তশিষ্ট এক নিবিড় কুটির থেকে হয়ে উঠেছে ছোট ছোট শোরগোলের গোলক। প্রতিটা ক্যাফেতেই জোরেশোরে বেজে চলেছে লা মস্কা ব্যান্ডের ‘মুচাচোস, আহোরা নস ভল্ভিমস আ ইলিউসনার’ (ওহে জনগণ, সময় এসেছে আবারও আশায় বুক বাঁধার)।
শুধু কী ক্যাফে! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আনন্দ উত্তেজনার কোনও শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে বরং মেসি উন্মাদনার পাশাপাশি হুলিয়ান আলভারেজকে নিয়েও পরিলক্ষিত হয়েছে যথেষ্ট উচ্ছ্বাস। সেই সাথে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে যে এরকম জয় পাবে অনেকেই ভাবেনি। ২০ বছর বয়সী ক্লারা কারদেইরার মতে, “ক্রোয়েশিয়া মাত্রই ব্রাজিলকে বিদায় দিয়ে এসেছিল। আমার তো মনে হয়েছিল অন্য যেকোনো ম্যাচের চেয়ে এই ম্যাচটা আমাদের জন্য কঠিন হবে।”
কঠিন সেই ম্যাচ সহজ করে তোলায় রক্ষণভাগের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখছে না কেউ। আইসক্রিমের দোকানে বসে উল্লাসে মেতে থাকা রদ্রিগো সারসিনো বলছেন সেটাই, “নিকো(ওটামেন্ডি) আর কুতি(রোমেরো) একেবারে দুটো সিংহ!” এমনকি গোলকিপার এমি মার্টিনেজের বাড়ি মার দেল প্লাতার পাশের সমুদ্র সৈকত পুন্তা মোগোতেসে পতাকা আর হারলেকিন টুপি নিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা সেখানকার মানুষ।
এমি যে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন সেটার জন্য আর্জেন্টিনাতে তিনি অনেক দিন ধরেই নায়ক। তবে সেই এমির মত কারণে মেসিও নায়ক বনে যাওয়া হয়তো আর্জেন্টিনাতে এই প্রথম। মেসি মাঠে যেমন ডিয়েগোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনছেন, মাঠের বাইরেও যেন ডিয়েগোকে ফিরিয়ে এনেছেন মেসি। ডাচদের বিপখে ম্যাচের পর মেসি যে ওয়েগহর্স্টের দিকে চেঁচিয়ে ‘কে মিরাস, ওবো? (কী দেখছিস রে, গর্ধভ?)” বলেছিলেন সেটা দিয়ে রীতিমত গেঞ্জি, টুপি বানিয়ে বসে আছেন আর্জেন্টাইনরা। মেসির এই রুপ দেখে বড়ই আনন্দ পাচ্ছেন তারা। মেসির জাদু তো মাঠে দেখা যাচ্ছে তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই, তবে মেসির এই তেজ যেন আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে থাকা মেসিকে নতুন এক রুপে, নতুন এক জায়গায় ঠাই দিয়েছে।