লন্ডনে এক রোমাঞ্চের নন্দন
দুই হাতে লকেটটা মুখের কাছে চেপে ধরেছেন মিথালি। কে জানে, কোন সৌভাগ্যের ধারক সেটা! একটু ভাগ্যের ছোঁয়া প্রয়োজন তার। একটু পর পর অবশ্য পাশে বসে থাকা পুনাম রৌতকে সান্ত্বনা দেয়ার দায়িত্বটাও পালন করতে হচ্ছে। দুই হাতে চুলগুলো অনবরত পেছনে নিচ্ছেন রৌত। নিজের আউটটা মানতে পারছেন না। মিথালির সান্ত্বনাতে কাজ হচ্ছে না খুব একটা। ভাগ্যপ্রসূত মিথালির লকেটটাও অবশ্য স্থির করতে পারছে না স্বয়ং অধিনায়ককেই।
****
দীপ্তির ক্ষণিকের অপেক্ষা। তিনি জানতেন, থ্রোটা ঠিকঠাক হয়েছে তার। যেন তিরটা ছুঁড়েছেন, জায়গামতো গিয়ে লাগার অপেক্ষা শুধু। দীপ্তির ছোঁড়া তির বা বলটা স্টাম্প এলোমেলো করে দিল, আরেকবার এলোমেলো হয়ে গেল ইংলিশ ব্যাটিং। ব্রান্টে বাঁধা আশা ফুরিয়ে এলো যেন তাদের। ভারত এগিয়ে গেল আরেকবার।
শ্রাবসোল অপেক্ষা করে আছেন। থ্রোটা যুতসই হয়নি, মাঝপথে মাটিতে একবার আছাড়ও খেয়েছে। সারাহ টেইলরের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ডাইভ দিয়েছেন শিখা পান্ডি। টেইলর ধরলেন, ঝুলে পড়ে ভেঙে দিলেন স্টাম্প। শ্রাবসোল জানলেন ঠিক, কাজ হয়ে গেছে। ভারতের পতন ধরে আরেকটু ওপরে উঠে গেছে ইংল্যান্ড।
****
বলটা ছুঁড়ে মারলেন ঝুলন, বলটা না করে। আম্পায়ার ক্রেইগ ব্রাথওয়েট ডেড বলের সংকেত দিতেই থাকলেন, দিতেই থাকলেন। মিথালির ফিল্ড-সেটিংটা পছন্দ হয়নি ঝুলনের, যেন ঝুলনের রাগ কমা পর্যন্ত ডেড দিয়েই গেলেন ব্রাথওয়েট! ঝুলনের শেষ মিশন। শেষ বিশ্বকাপ। শেষ ফাইনাল। টেইলর তার নির্বিষ বলটায় ফ্লিক করতে গিয়েছিলেন। হয়তো উইকেটকিপারকে ছাড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। ইন-ফিল্ডকে ছাড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। বাউন্ডারি মারতে চেয়েছিলেন। ধরা পড়লেন কিপারের গ্লাভসেই। আম্পায়ার শন জর্জ যতক্ষণ অপেক্ষা করলেন, কোনও নাছোড়বান্দা প্রেমিকও প্রেমিকার হ্যাঁ শুনতে বোধহয় এতক্ষণ অপেক্ষা করেন না! টেইলর রিভিউ নিলেন না। পরের বলে আবার ফুললেংথে গেলেন ঝুলন। এবার একটু কম সময় নিলেন জর্জ। উইলসনও রিভিউ নিলেন না। ১৪৬/৩ থেকে ইংল্যান্ড মুহুর্তেই হয়ে গেল ১৪৬/৫। ধীরলয়ে চলছিল ইংলিশ ব্যাটিং। ধীরলয়ে চলছিল ফাইনাল। টিং-টাং-টিং-টিং-টাং। হঠাৎ করেই ঢি-ঢি-ঢি-ঢিস-ঢুস-ঢাস। ঝুলন হ্যাটট্রিকের সামনে। সেটা হলো না। এক ওভার বাদে আবার আরেকজন ইংলিশ ব্যাটার পা বাড়িয়ে খেলতে গেলেন। পা নামের বর্মটাই যেন আত্মঘাতি তলোয়ার হয়ে গেল তারও। তিনি রিভিউ নিলেন। বিফল রিভিউ। পরের ইনিংসে যোগাযোগ করুন, টেলিভিশন আম্পায়ার যেন ঘোষণা দিলেন সেটাই। ঝুলন গোস্বামি। ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা বোলার। দিনটা যেন করে নেবেন নিজের।
উড়ছেন ঝুলন
****
২০০১ সাল। অ্যানা শ্রাবসোলের বয়স ১০ বছর। বাবার সঙ্গে খেলা দেখতে এসেছেন লর্ডসে। বাবাকে বলেছিলেন, একদিন তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলবেন।
২০১৭ সাল। শ্রাবসোলের বয়স ২৫। ফাইনালের আগের আট ম্যাচে শ্রাবসোলের উইকেট ছয়টা। সেমিফাইনালে তার ব্যাট থেকেই এসেছিল জয়। অনেক চাপকে সরিয়ে চার মেরেছিলেন শাবনিম ইসমাইলকে। ফাইনালে ব্যাট করতে হয়নি। মানধানাকে বোল্ড করে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, দিনটা হতে পারে তার। তখনও অনেক সময় বাকি, লন্ডনের আকাশে অনেক মেঘ উড়বে, অনেক মেঘ কালো হবে। রৌত তার ধীরগতির নিচু হওয়া ভেতরের দিকে ঢোকা বলে ধোঁকা খেলেন। শ্রাবসোল দুই হাত মেলে দৌড় শুরু করলেন আরেকবার। সতীর্থদের আলিঙ্গনে বাধা পড়েন এরপরই। শ্রাবসোল দুই হাত মেলেন, দৌড় শুরু করেন, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করেন, সতীর্থদের আলিঙ্গনে বাধা পড়েন। একবার, দুইবার, তিনবার, ছয়বার। অ্যানা শ্রাবসোল, ইংল্যান্ডের ফাইনালের ‘সোল’, ফাইনালের ‘আত্মা’।
যেন পেখম মেলে চলেছেন শ্রাবসোল
****
হেদার নাইট একশবারের মধ্যে নব্বইবারই ধরবেন সে ক্যাচটা। আজ বাকি দশবারের একবার। এক্সট্রা কাভারে বলটা হাতে পুরলেন, নচ্ছার বলটা বেড়িয়ে গেলো। কৃষ্ণামূর্তি নাইটের হাত গলে বেড়িয়ে এলেন। অধিনায়কের হাত গলেই কি বেড়িয়ে গেল কাপটা? যেমন খানিক আগেই বেঁচেছিলেন কৃষ্ণার সঙ্গী পুনাম রৌত। সারাহ টেইলর একশবারের মধ্যে নব্বইবার স্টাম্পিংটা করবেন। আচ্ছা, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে অসাধারণ এক স্টাম্পিং বা পুরো টুর্নামেন্টে উইকেটকিপিংয়ের ট্যালি ধরে বললে টেইলরের সম্ভাবনাটা হয়ে যাবে পঁচানব্বই ভাগ। রৌতেরটা ছিল বাকি পাঁচবারের একবার। নাইট, নাকি টেইলর, কার মুঠো গলে বেরিয়ে গেল কাপটা?
শর্মা আউট। না, আউট না। শর্মা আউট। না, বেঁচে গেছেন। টেলিভিশন আম্পায়ার পল উইলসন একের পর এক অ্যাঙ্গেল থেকে দেখছেন। টেইলর সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, শর্মা পা তুলতেই ফেলে দিয়েছেন বেল। টেইলরের টাইমিংটা ঠিক হলো? নাকি শর্মার? টেইলরের? শর্মার? উইলসন নট-আউট দিলেন। অর্ধেক লর্ডস চিৎকার উঠলো। বাকি অর্ধেক শুনলো সেটা।
দুই গর্বিত অধিনায়ক..
সারাদিন জমাট হয়ে থাকা মেঘ থেকে আবার নামতে শুরু করেছে বৃষ্টি। আরেকবার কর্মব্যস্ত হয়ে পড়লেন লর্ডসের কিউরেটর মাইক হান্ট। ডি-এলে ভারত এগিয়ে চার রানে। শ্রাবসোল আরেকবার গতি বদলালেন বলের। দীপ্তি মারতে গিয়ে উলটো মরলেন। চার রানে এগিয়ে থাকা ভারত যেন চার বছর পিছিয়ে গেল। লর্ডসের অর্ধেক চিৎকার করে উঠলো। বাকি অর্ধেক সে চিৎকারে হারিয়ে গেল।
জেনি গান নিরানব্বই বারই ক্যাচটা ধরবেন। আপনি নিরানব্বই না হলেও আটানব্বই বার। আমি আরেকটু কম, সাতানব্বই। এমনকি ধরবেন লর্ডসের গ্যালারিতে থাকা ইংল্যান্ডের ১০৫ বছর বয়স্ক ক্রিকেটার এইলেন অ্যাশও। কিন্তু গান মিস করলেন আজ। রাজকীয় মিস। যেন ২০০৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে টাইব্রেকার শুট নেয়ার সময় জন টেরির মতো করে পা পিছলে গেল গানের। নাইট না, টেইলর না, মুঠো থেকে কি তবে বিশ্বকাপটা ফেলে দিলেন গানই?
****
মিথালির লকেটটা কাজে দেয়নি। তবুও মিথালি গর্বিত। তার মেয়েরা তো গর্ব করার মতো করেই খেলেছেন। হেদার নাইটকে ক্যাচ মিসের মাশুল গুণতে হয়নি। শ্রাবসোল তাকে বানিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। জেনি গান বিশ্বকাপ জিতেও যেন ক্যাচ মিসের কথাটা ভুলতে পারছিলেন না। এরপর নিশ্চয়ই ভুলেছেন। সারাহ টেইলর সে স্টাম্পিংয়ের হাতছাড়া সুযোগের কথা মনে রেখেছেন? দরকার নেই তো!
লর্ডসের নতুন ওয়ার্নার স্ট্যান্ডের সামনে পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চ। ইংলিশ মেয়েরা সেখানেই মাতলো উল্লাসে। যে উল্লাস লর্ডস ছাড়িয়ে গেল। লন্ডন ছাড়িয়ে গেল। সে উল্লাস বিষাদময় গর্বের রুপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো ভারতে। বিশ্বকাপ ফাইনালটা হলো তো বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোই।
লন্ডনের লর্ডস যে ফাইনালে হয়ে উঠেছিল রোমাঞ্চের নন্দনকানন।