• টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ২০২১
  • " />

     

    আপনি নিউজিল্যান্ড হতে পারেন, তবে মাঝে মাঝে স্বীকৃতি দরকার আপনারও

    আপনি নিউজিল্যান্ড হতে পারেন, তবে মাঝে মাঝে স্বীকৃতি দরকার আপনারও    

    ওয়াইপাওয়া নিউজিল্যান্ডের সেন্ট্রাল হক বে’র দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। নেপিয়ার থেকে ৪৫ মিনিটের ড্রাইভিং পথ। সে শহরের জনসংখ্যা ২২৫০, ঢাকায় রাস্তায় বের হলেই হয়তো এর চেয়ে বেশি মানুষ দেখেন আপনি। সে অর্থে ক্রিকেটের তেমন চিহ্ন দৃশ্যমান নয় সেখানে। শহরের ভেতর দিয়ে একটাই রাস্তা। সে রাস্তার দক্ষিণ দিক ধরে এগুলে শেষদিকে একটা ওয়্যারহাউস চোখে পড়বে আপনার, যার সামনে ছোট্ট একটা দোকান। সে দোকানটা ক্রিকেট ব্যাটের- লেভার অ্যান্ড উড। ব্যাটের প্রতি আলাদা আকর্ষণ বা প্রায় ফটোগ্রাফিক মেমরি না থাকলে অথবা স্বভাবজাত ক্রিকেটপোকা না হলে আপনি এর নাম হয়তো শোনেননি। ভারত উইমেনের মিথালি রাজ, জেমিমা রদ্রিগজদের হাতে এই স্টিকারওয়ালা ব্যাট ছিল একসময়, এখন সেটি অন্য কোনো ‘বড়’ ব্র্যান্ডের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। 

    লেভার অ্যান্ড উডের ব্যাট একসময় ব্যবহার করেছেন শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, সনাথ জয়াসুরিয়ারা। আপনি হয়তো এক ঝলক তাদের ব্যাটগুলি স্মৃতিশক্তিতে ঝালাই করে নিয়ে কমেন্ট করতে উদ্যত- তাদের ব্যাটে তো এমআরএফ ধরনের স্টিকার থাকতো, লেভার অ্যান্ড উড ছিল কই! এ কোম্পানি এমনই। জেমস লেভার ব্যাট নিজের হাতে বানান (আক্ষরিক অর্থেই তার ব্যাট হাতে তৈরি)- ক্রিকেটারদের চাহিদা অনুযায়ী, এরপর তারা ‘বাণিজ্যিক’ ব্যাপার পূরণে হয়তো স্টিকার লাগান অন্য। লেভার অ্যান্ড উডের ওয়েবসাইটে গেলে তাই আপনি কোনো ক্রিকেটারকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও পাবেন না, তারা কাউকে স্পন্সর করে ব্যবসা প্রসারণের নীতিতে বিশ্বাসী নয়।



    এমনিতে ইংলিশ হলেও একসময় সমারসেটের বিখ্যাত এমঅ্যান্ডএইচে কাজ করা লেভার নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। সেখানেই ওয়াইপাওয়াতে তার ব্যাটের কারখানা। কার কার জন্য ব্যাট তৈরি করেছেন, সেসবের কোনো তালিকাও নেই তার কাছে। শুধু এই কাজটার সঙ্গে যে ভালবাসা জড়ানো তার, সেটি থেকে ব্যাট বানান। সেসব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। 

    এই যে বড় ক্রিকেটাররা আসেন তার কাছে, লেভারের কাছে হয়তো তার কাজের স্বীকৃতি সেটিই। মাঝে মাঝে লেভারদেরও স্বীকৃতির দরকার। যেমন দরকার আপনার। হয়তো একটা কথা, কাঁধে একটা হাতের চাপড়, একটা মুচকি হাসি, ছোট্ট উপহার- যে কোনো ধরনের স্বীকৃতি। যে কাজ করতে আপনি শুধু ভালবাসেন তাই না, যে কাজ আপনি যত্ন নিয়ে করেন, যার পেছনে আপনার শ্রম- সে কাজের একটা স্বীকৃতি দরকার সামনে এগুতে। যেমন হ্যাম্পশায়ার বোউলের ৬ দিনের পর নিউজিল্যান্ডের পাওয়া টেস্ট চ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতিটা দরকার ছিল, অ্যাশেজ বা বড় সিরিজের বাইরে টেস্ট ক্রিকেটের এমন একটা উৎসবমুখর স্বীকৃতি দরকার ছিল। 

    ****

    ব্রেন্ডন ম্যাককালামের শটটা হয়তো অতি-আত্মবিশ্বাসী ছিল। মিচেল স্টার্কের ফুললেংথের বলটা ব্লক না করে ব্যাট চালাতে গিয়ে মিস করলেন। এমসিজিতে সেই যে ব্যাকফুটে গেল নিউজিল্যান্ড, আর সামনে আসতে পারলো না।

    ২০১৫ বিশ্বকাপের সে ফাইনালের বছরখানেক পর দীর্ঘদিন ভোগা ক্যান্সারে মারা গেলেন মার্টিন ক্রো। যার এক জীবনের আক্ষেপ ছিল ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। যেদিন ব্যাটিংয়ের পর হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে মাঠে নামেননি, ‘পার-স্কোর’-এর চেয়ে বেশি করেছিলেন ভেবে ফাইনালের আগে ঝুঁকিটা নেননি। ইনজামাম-উল-হক গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন তার সে ফাইনাল-স্বপ্ন। যাওয়ার আগে ক্রো দেখেছিলেন, তাদের ‘জীবনের সেরা সময়’। 

    এমসিজির ফাইনালের আগে ক্রিকইনফোতে এক লেখায় ক্রো লিখেছিলেন, “যদি নিউজিল্যান্ড জেতে, তাহলে প্রথমবারের মতো অল-ব্ল্যাকের ছায়া থেকে বেরুতে পারবে তারা। তর্কসাপেক্ষে এর চেয়ে বড় অর্জন আর হয় না। হয়তো এর মেয়াদ বেশিদিন থাকবেও না, সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডে অল-ব্ল্যাক হয়তো তাদের বিশ্বকাপের শিরোপা ডিফেন্ড করবে। এবং এর মাধ্যমে হয়তো একই বছরে এই জাতি দুটি বিশ্বকাপ পাবে। যদি....।” অল-ব্ল্যাক ঠিকই ইংল্যান্ডে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেবার। তবে ২০১৯ সালে পরের রাগবি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে হেরেছিল তারা। 


    মেলবোর্ন: ম্যাককালাম ব স্টার্ক/ক্রিকেটডটকমডটএইউ


    ম্যাককালামের সঙ্গে সেই লেখায় আলাদা করে দুজনের কথা বলেছিলেন ক্রো- রস টেইলর ও মার্টিন গাপটিল। এ দুজনকে ক্রো বলতেন, ‘দ্য টু সনস আই নেভার হ্যাড’। টেইলরের সরাসরি মেন্টর ক্রো, তার রেকর্ড ছাড়িয়ে তাই তাকে সম্মান জানাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। সেই টেইলর, গাপটিলরা ২০১৯ সালে আরেকটা বিশ্বকাপ ফাইনালে গেলেন। ইয়ান স্মিথের বলা ‘বেয়ারেস্ট অফ মার্জিনস’ ঢুকে গেল লোকগাঁথায়, চার বছর ধরে এ বিশ্বকাপকে ঘিরে নতুন ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলা ইংল্যান্ড পেল স্বীকৃতি। টেইলর, গাপটিলরা থাকলেন চ্যাম্পিয়নশিপ দেওয়ালের ওপাশেই। 

    সেই ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং কোচ ছিলেন ক্রেইগ ম্যাকমিলান। ২০২১ সালের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তিনি কমেন্ট্রিতে। তবে ম্যাচের ঘন্টাখানেক বাকি থাকতেই তাকে কমেন্ট্রিতে বিদায় জানাচ্ছিলেন দীনেশ কার্তিকরা। কোনো এক ‘ব্যাখ্যা করা জটিল’ ধরনের কারণে ম্যাকমিলান দেশে ফিরবেন, একটু পরই বিমান তার। লর্ডসের আক্ষেপ সাউদাম্পটনে ভোলার দ্বারপ্রান্তে যখন নিউজিল্যান্ড, তখন কাছে থেকেও সেটি সরাসরি দেখতে পারবেন না তিনি। মাইক আথারটন তাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, উদযাপনটা তাহলে বিমানেই হোক তার! 

    **** 

    ভারতের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল যখন নিশ্চিত হলো, রবিচন্দ্রন আশ্বিন বলেছিলেন- তিনি, চেতেশ্বর পুজারাদের মতো যারা শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপের দলে ছিলেন না, তাদের জন্য এ ফাইনালই বিশ্বকাপের মতো হবে। আশ্বিন না বললেও বিজে ওয়াটলিং, নিল ওয়াগন্যারদের জন্যও ব্যাপারটা তাই। এই ফাইনালের আগে ৫৩টি টেস্ট খেলেছেন ওয়াগন্যার, সীমিত ওভারে আন্তর্জাতিক ম্যাচ একটিও না। ওয়াটলিং তার ৫ টি-টোয়েন্টির শেষটি খেলেছিলেন ২০১৪ সালে, ২৮ ওয়ানডের শেষটি ২০১৮ সালে। 



    ফাইনালের শেষদিন ছিল ওয়াটলিংয়ের ক্যারিয়ারের শেষ। নামার সময় অভিনন্দন পেলেন বিরাট কোহলির। ওয়াটলিং তার সময়ের সেরা উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান, অথচ তাকে নিয়ে কথা হয় কই! ছোটখাট অথচ বিশাল লড়াকু মানসিকতার মানুষটা এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। এরপর হয়ে গেছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রতীক। 

    রবীন্দ্র জাদেজাকে রান-আউটের চেষ্টায় কেন উইলিয়ামসনের একটা থ্রো নিতে গেলেন ওয়াটলিং। আঙুল ডিসলোকেট হয়ে গেল। মাঠে চিকিৎসা চলল। বিরতির পর মাঠে নামার আগে দল যখন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, টম ব্লান্ডেল ছিলেন সেখানে, ওয়াটলিংয়ের নামার কথা ছিল না। কিন্তু ব্লান্ডেলকে সরিয়ে দিয়ে সে আঙুল নিয়েও তিনি নামলেন। যদিও একটু পর উঠে গেলেন আবার। 

    ওয়াগন্যার এর আগে এক টেস্টে পায়ের পাতায় চিড় নিয়েই বোলিং করে গিয়েছিলেন। ফাইনালের সিম-সুইং পেরিয়ে যখন সবচেয়ে ব্যাটিং-সহায়ক কন্ডিশন এলো, ওয়াগন্যার ফিরলেন তার শর্ট বল থিওরিতে। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে লাঞ্চের আগে-পরে তার সেটি টানা ৯ম ওভার। করলেন টানা ১৪টি শর্ট বল। এরপর লেংথ বদলে ফেললেন, গেলেন একটু ফুললেংথে। জাদেজা নিজেকে বিরত রাখতে পারলেন না খোঁচা দেওয়া থেকে। আঙুল ডিসলোকেট করে ফেলা, ক্যারিয়ারের শেষদিনে খেলতে নামা ওয়াটলিং সারলেন বাকি কাজটা।  

    ওয়াটলিং-ওয়াগন্যারের জন্য টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ছিল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। নিউজিল্যান্ডের জন্য ছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি পাওয়ার আরেকটি সুযোগ। 

    ****

    টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এ সাইকেলে ইংল্যান্ড খেলেছে ২১টি ম্যাচ, ভারত ১৭টি, অস্ট্রেলিয়া ১৪টি। এ সময়ে নিউজিল্যান্ড খেলেছে ১১টি ম্যাচ, এর ৬টিই দেশের মাটিতে। যে ৫টি বাইরে, তার ৪টিতে হেরেছে তারা, অস্ট্রেলিয়ায় হয়েছিল হোয়াইটওয়াশ। ‘হোম কন্ডিশন’-এর সুবিধা নিয়ে নিউজিল্যান্ড এসেছে ফাইনালে, সে কথা উপেক্ষা করাটা কঠিন ছিল। 

    অনেকদিন ধরেই টেস্ট ক্রিকেটের এমন একটা টুর্নামেন্ট বা লিগের কনটেক্সটের আইডিয়া ঘুরেফিরে এসেছে, তবে আলোর মুখ দেখেনি তা। যখন দেখলো, তখন আঘাত করলো কোভিড-১৯। বদলে গেল পয়েন্ট পদ্ধতি, বদলে গেল ফাইনালের ভেন্যু। ভগ্নাংশের ব্যবধানে নিউজিল্যান্ড এগিয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে টেবিলে।  

    ভারত ফাইনালে এসেছিল স্থগিত হয়ে যাওয়া আইপিএল থেকে। এমনকি ফাইনালের আগে কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচও খেলেনি তারা। আর নিউজিল্যান্ড ইংল্যান্ডে এসে খেলেছে দুটি টেস্ট। সে সিরিজ জিতেছে তারা, তবে ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকজন প্রথমসারির ক্রিকেটার ছিলেন না- সেটি উপেক্ষা করা কঠিন। তবে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ড ‘বাড়তি সুবিধা’ পেয়েছে- বলাই যায়। ফাইনালে এসেও যেন স্বীকৃতিটা সেভাবে মিলছিল না নিউজিল্যান্ডের। 

    তবে কদিন ধরেই ইংল্যান্ডে প্রচন্ড গরম, রেকর্ড তাপমাত্রা পেরিয়ে ফাইনালের আগের দিন থেকে নামা বৃষ্টিতে বদলে গেল সবকিছু। কখনো রোদ কখনও বৃষ্টি নয়, স্রেফ কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি। ফলে আকাশ-বাতাস-মাটি সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত ক্রিকেটে শুধু খেলা না হওয়া নয়, খেলার মাঝেও তার প্রভাব থাকল স্পষ্ট। টসটা জিতল নিউজিল্যান্ড, তবে প্রথম সেশনে কন্ডিশনের সুবিধা কাজে লাগাতে পারলেন কই তাদের পেসাররা। ইংলিশ লেংথ খুঁজে পেতে হয়রান হতে হলো তাদের ডিউক হাতে। রোহিত শর্মা, শুবমান গিল, বিরাট কোহলিদের শীঘ্রই টলাতে পারলেন না তারা। 

    হাজির হলেন কাইল জেমিসন। ২০১৪ অ-১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলেছিলেন জেমিসন। নবম স্থান প্লে-অফের ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। লিটন দাস, মোস্তাফিজুর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেনরা ছিলেন তার প্রতিপক্ষ। নিউজিল্যান্ড ম্যাচ হেরেছিল ৭৭ রানে। লিটনের টেস্টে এখনও সেঞ্চুরি নেই, মোস্তাফিজুর শীঘ্রই এ ফরম্যাটে খেলছেন না, মোসাদ্দেক জাতীয় দলেই জায়গা হারিয়ে খুঁজছেন। 

    আর ক্যারিয়ারের শুরুতেই খ্যাপাটে সব কাজ করে বসছেন জেমিসন। তাদের ক্রিকেট কাঠামো তাকে তৈরি করেছে এভাবেই।

    ****

    ২০১৯ সালের পর থেকে স্লিপ ক্যাচিংয়ে সাফল্যের হারে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নিউজিল্যান্ড। সে স্লিপ ক্যাচিংয়ের অন্যতম স্তম্ভ টিম সাউদি। সেই সাউদি প্রথম ইনিংসে ফেললেন জাদেজার ক্যাচ, পরেরটিতে আরও ভয়ঙ্কর মিস- ঋষভ পান্টের। শেষদিনের প্রথম সেশনে কাইল জেমিসন যে মোমেন্টাম এনে দিয়েছিলেন, সেটি ভেস্তে যেতে ধরলো ওই মিসে। 

    ৫ রানে পান্টের ক্যাচ ফেলেছিলেন সাউদি, এর মাশুল হিসেবে গুণতে হয়েছে আরও ৩৯ রান। এরপর পান্ট আরেকবার ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে ট্রেন্ট বোল্টকে তুলে মারতে গিয়ে আকাশে তুললেন বল, গালি থেকে পেছন ফিরে হেনরি নিকোলস নিলেন দারুণ একটা ক্যাচ। ক্যামেরা গেল সাউদির দিকে। তার চেয়ে স্বস্তি ওই মুহুর্তে অন্য কেউ পাননি। এরপর তিনি এসে ছেঁটে দিলেন ভারতের লেজ। সাউদি যখন ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, তখন স্বপ্নেও ভাবেননি, টেস্টের সেরার মর্যাদা পাবেন তারা। 

    ডেভন কনওয়ে তখন পর্যন্ত ম্যাচের একমাত্র ফিফটি করা ব্যাটসম্যান, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নিউজিল্যান্ডে যাওয়া আরেকজন যিনি। তবে রবিচন্দ্রন আশ্বিনের তোপের মুখে পড়লেন তিনি, ম্যাচে দুইবার যেটির শিকার হয়েছেন টম ল্যাথাম। রস টেইলর প্রথম ১৮ বলে কোনো রানই করতে পারলেন না এরপর। প্রথম ইনিংসে টেইলরের আড়াআড়ি খেলার অভ্যাসের কথা ভেবে ট্যাকটিকস সাজিয়েছিল ভারত। বিশেষ করে মোহাম্মদ শামি তার প্যাড তাক করছিলেন। শেষ পর্যন্ত শামির বলেই ড্রাইভ করতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন তিনি। 


    উইলিয়ামসন-টেইলর, যে জুটি নিউজিল্যান্ডের/আইসিসি


    শামি আবার প্যাডের ওপর করলেন টেইলরের। টেইলর ঘোরালেন সেটি। উল্লাসে মাতলো সাউদাম্পটনে স্বল্পসংখ্যক কিউই সমর্থকরা, তবে ততক্ষণে ভারতীয়দের ম্লান করে দিয়েছেন তারা। উল্লাসে মাতলেন ড্রেসিংরুমের ভেতর-বাহিরে এতক্ষণ পজিশন পরিবর্তন না করা টেইলরের সতীর্থরা। আর টেইলর নিজে শুধু দেখাই যায় না এমন করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ঝাঁকালেন বারকয়েক। ওপাশ থেকে কেন উইলিয়ামসন এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে, যে আলিঙ্গন সম্পন্ন হলো কয়েকধাপে। সে আলিঙ্গন বললো অনেক কিছু। 

    ব্রেন্ডন ম্যাককালামের বোল্ড হওয়া দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেটি শেষ হলো টেইলরের সে শটে। সাইমন ডুল বলে উঠলেন, ‘সামটাইমস, সামটাইমস, দ্য নাইস গাইস ডু ফিনিশ ফার্স্ট’। মাঝে মাঝে নিউজিল্যান্ডও জেতে, যারা এর আগে ফিরে গেছে 'বেয়ার মার্জিন'-এর ব্যবধানে। 

    বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে প্রেজেন্টেশনে কিউইরা নিজেরাই নিলেন নিজেদের মেডেল, উইলিয়ামসনেরটা তুলে দিলেন সহ-অধিনায়ক টম ল্যাথাম। আগে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান পেরিয়ে এখন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি হিসেবে চালু হওয়া গদাটাও উইলিয়ামসন নিলেন নিজেই। কেউ তাদেরকে তুলে দেওয়ার থাকলো না, নিজেদের প্রাপ্যটা যেন নিজেরাই বুঝে নিলেন তারা। এরপর উইলিয়ামসনের যে হাসিটা দেখা গেল, তাতেই বুঝা যায়, কতো কিছু চাপা ছিল এতোদিন তার ভেতর। 

    উইলিয়ামসনরা যখন উদযাপন করছেন, নিউজিল্যান্ডে তখন ভোর। শীঘ্রই সোশ্যাল মিডিয়া সরব হবে তাদের নিয়ে। 

    ****

    লর্ডসের ফাইনালের পর বাচ্চাদের ক্রিকেট ছাড়া অন্য যে কোনো পেশা বেছে নিতে বলা জিমি নিশাম বললেন, এ এমন এক ফল, যা ৫ বছর আগেও কল্পনা করা যেতো না। এরপর নিশাম তার হিউমারের ছাপ রাখলেন, চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফির সমস্যা নিয়ে- আদতে ফোকর না থাকা এ ট্রফিকে চাইলেই উদযাপনের অংশ হিসেবে পানপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না! 

    ম্যাকমিলান টুইট করলেন, ‘আমরাই প্রথম টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে থাকব’। ম্যাকমিলান বোধহয় তখন আকাশে উড়ছেন। 

    গ্রান্ট এলিয়ট ২০১৫ বিশ্বকাপে ইডেন পার্কে হয়ে উঠেছিলেন সেমিফাইনালের অতিমানব, নিউজিল্যান্ড ফাইনালে যাওয়ার কারণে মিস করেছিলেন বোনের বিয়ে। তবে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বিশ্বকাপ জিতলে মধুচন্দ্রিমার খরচটা দেবেন তিনি। এলিয়টের সে খরচ দেওয়ার সুযোগটা আসেনি। তার টুইটার আইডিতে এখনও প্রোফাইল পিকচারে ডেল স্টেইনকে মারা সেই ছয়ের পর নিজের ছবিটা।

    “নম্রতা, কঠোর পরিশ্রম, নিবেদন- দলের প্রতি, সমর্থকদের প্রতি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তো সব দিক দিয়েই!”, এলিয়ট যখন এ টুইট করছেন, তখন তিনি পিএসএলের কমেন্ট্রিতে। 

    ম্যাককালাম শুধু ভালবাসা জানানো ছাড়া আর কিছু পাননি এখনও প্রকাশ করার মতো, “টু কেন অ্যান্ড অল অফ দ্য বয়েস ইন দ্য স্কোয়াড। উই লাভ ইউ।” 

    যে অল-ব্ল্যাকসকে ছাপিয়ে যাওয়ার কথা লিখেছিলেন ক্রো ২০১৫ সালে, সেই তারা বললো, “২০১৫ আর ২০১৯ তো শুধু গা-গরমের ব্যাপার ছিল। অভিনন্দন, ব্ল্যাকক্যাপস, ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার জন্য। তোমাদের স্বপ্নের সীমানা ছিল না, তোমরা আমাদের গর্বিত করেছ।” 

    টুইটে নিউজিল্যান্ডকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শচীন টেন্ডুলকার, ভিভ রিচার্ডসরা। শেন ওয়ার্ন অভিনন্দন জানালেন, সঙ্গে তার নিজের কাউন্টি হ্যাম্পশায়ারের গ্রাউন্ডস্টাফদের কথা ভুললেন না, এমন কন্ডিশনে এমন একটা পিচ বানানোর জন্য। তাদেরও স্বীকৃতি দিলেন তিনি। 

    টেইলর-উইলিয়ামসন-সাউদি-জেমিসন-ওয়াটলিংরা হ্যাম্পশায়ার বোউলের আঁধারে মাউরি হাক্কা করতে যখন ব্যস্ত, ঠিক অমন সময়েই লেভার অ্যান্ড উডের ফেসবুক পেইজ থেকে এলো অভিনন্দনটা, “দিন শুরু করার কী অসাধারণ একটা উপলক্ষ্য। অভিনন্দন নিউজিল্যান্ড।” 

    সাধারণত ভোর থেকেই ব্যাট তৈরির কাজে লেগে পড়েন লেভার। এ দিনটা তার শুরু হবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি পাওয়া নিউজিল্যান্ডকে অভিনন্দন জানিয়ে। 

    আপনি নিউজিল্যান্ডের ‘নাইস গাই’ হতে পারেন, তবে মাঝে মাঝে আপনারও স্বীকৃতি দরকার।