বিদায় সাঙ্গা রাজা, স্বাগতম আক্ষেপ
চেমসফোর্ডে ম্যাচের ভাগ্যে ড্র ছাড়া কিছু নেই তখন। রোমাঞ্চ শুধু হতে পারে এমন একটা রেকর্ড ঘিরে। যেটার অপেক্ষায় সবাই; সারের ড্রেসিংরুম, এসেক্সের ফিল্ডাররা, চেমসফোর্ডের দর্শকরা। গ্যালারিতে কুমার সাঙ্গাকারার স্ত্রী, দুই সন্তান। নেইল ওয়াগনারকে সরিয়ে পার্ট-টাইমার টম ওয়েস্টলিকে আনলেন রায়ান টেন ডেসকাটে। আহ, অফস্পিন। কতোজনকে ক্যারিয়ারে খেলেছেন সাঙ্গাকারা, শ্রীলঙ্কা তো জন্ম দিয়েছে কতো বিচিত্র রকমের অফস্পিনারের। ওয়েস্টলি বলটা ঝুলিয়ে দিলেন, ‘চেক-ড্রাইভ’টা মিড-অফে খেললেন সাঙ্গাকারা। স্বভাববশতই ডানদিকে ডাইভ দিলেন ওয়েস্টলি, বলটা ডানহাতে আটকে গেল কোনোমতে। উদযাপন করলেন না, যখন সম্বিত ফিরে পেলেন, সাঙ্গা ততক্ষনে মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন। আর ১৬ রান হলেই সাঙ্গাকারা ইতিহাসের চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা ছয় ইনিংসে ছয় সেঞ্চুরি করতেন। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, সিবি ফ্রাই, মাইক প্রক্টরের সঙ্গী হতেন। চেমসফোর্ডে ১৬ রানের আক্ষেপ থাকলো সাঙ্গার।
যেমন চার রানের আক্ষেপ ছিল স্যার ডনের। যেমন ৪২১টা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেও মাত্র সাতটা টেস্ট খেলার আক্ষেপ ছিল প্রক্টরের। যেমন ১৯০২ সালের এফ.এ কাপের ফাইনালের ফিরতি ম্যাচে হারের আক্ষেপ ছিল সাউদাম্পটনের ফুলব্যাক ফ্রাইয়ের।
আক্ষেপ, জীবনের চিরকালীন সঙ্গীই তো সেটা! তাই বলে তো আর জীবন থেমে থাকে না।
****
‘পাগল নাকি! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার পর কাউন্টি ক্রিকেট?’ মাহেলা জয়াবর্ধনের বিস্ময়ের কারণ বিভিন্ন হতে পারে। দুনিয়াজোড়া কতো টি-টোয়েন্টি লিগ, সেসব খেলেই তো ক্রিকেটার ক্যারিয়ারের বাকি সময়টুকু পার করে দিতে পারতেন কুমার সাঙ্গাকারা। কিংবা জয়াবর্ধনের নিজের মতো এসব টি-টোয়েন্টিতে কোচিং করানোর সুযোগেরও তো অভাব নেই। তা না, সাঙ্গাকারা খেলবেন সারের হয়ে। পুরো মৌসুম তাও আবার। ২০১৫ সাল, সাঙ্গা তখন কেবল সারের হয়ে প্রস্তাব পেয়েছেন। বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন সেটাই। জয়াবর্ধনে তখন যদি জানতেন, সারের হয়ে শেষ মৌসুমটা কেমন কাটবে তার প্রিয় বন্ধুর!
প্রথম দুই মৌসুমে প্রথম শ্রেণিতে গড় চল্লিশের মতো। ভাল তো বটেই। কিন্তু ব্যাটসম্যান যখন কুমার সাঙ্গাকারা, তখন কোথায় যেন একটা খচখচানি থেকে যায়। সারেতে এসে কাউন্টি ক্রিকেটকে নতুন করে চিনেছে এর আগে ওয়ারউইকশায়ার ও ডারহামের হয়ে খেলা সাঙ্গাকারা। সারেতে এসে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে একটা অন্যরকমের ভাল লাগার সময় কাটিয়েছেন। শুধু ‘কিং’ সাঙ্গার ব্যাটটাই করছিল না অন্যরকম কিছু। শেষ মৌসুমে এসে করলো সেটা।
নিজের সাবেক কাউন্টি ওয়ারউইকশায়ারের সঙ্গে ৭১ রান দিয়ে শুরু। সাঙ্গা কাউন্টির এ মৌসুমে যেন কোনো ‘ব্রেইন-গেম’-এর ‘চিট-মোড’ বের করে ফেলেছেন। আগে থেকেই জানেন, কিভাবে কী করতে হবে। ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে প্রথম ইনিংসে ৪৬ করার পর পরের ইনিংসে ১৩৬। ও হ্যাঁ, সারে সে ইনিংসে ফলো-অনে পড়েছিল, সাঙ্গাকারার ইনিংস বাঁচিয়ে দিল সে ম্যাচ। অথবা, ল্যাঙ্কাশায়ারকে জয়বঞ্চিত করলো। ওল্ড ট্রাফোর্ডের কাউন্টির ভক্ত হওয়াটা তখন সুবিধার নয়, সাঙ্গার অসাধারণ ইনিংসের প্রশংসা করতে হবে, আবার একইসঙ্গে মনে হবে, শুধু তিনি যদি না থাকতেন! জয়টা তো ছিল চোখের সামনেই!
ওয়ারউইকশায়ারের সঙ্গে ফিরতি ম্যাচ, সাঙ্গা যেখান থেকে শেষ করেছিলেন ওভালে, এজবাস্টনে শুরু করলেন সেখান থেকেই। এবার সেঞ্চুরিবঞ্চিত করা গেল না তাকে। লর্ডসে পরের ম্যাচে গিয়ে সাঙ্গা হয়ে উঠলেন আরও ভয়ঙ্কর। হোম অফ ক্রিকেটে নিজের শেষ টেস্টে সেঞ্চুরির আক্ষেপটা ঘুচিয়েছিলেন, সেখানে ফিরে এবার করলেন জোড়া সেঞ্চুরি। যেন একটা করে মনে ভরে না, লর্ডসের অপার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছিল যেন সাঙ্গার ব্যাট, হাসছিলই শুধু!
২০১৪ সালে ট্রিপল সেঞ্চুরি প্রথমবার পেয়েছিলেন সাঙ্গাকারা, চট্টগ্রামে। ওহ, সে ম্যাচটা মনে করিয়ে দিলে অনেকের কাছেই মনে হবে, ‘কী দরকার হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর’! তবে সে টেস্টে প্রথম ইনিংসে ট্রিপল করেই ক্ষান্ত হননি, দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরিও করেছিলেন। সেই সাঙ্গা, কাউন্টিতে শুধু সেঞ্চুরি করে যাবেন, ডাবল করবেন না, সেটা হয় নাকি!
এসেক্সের সঙ্গে পরের ম্যাচেই সেটা করে ফেললেন। ঠিকঠিক ২০০। এরপরের ইনিংসেই সেই ১৬ রানের আক্ষেপ। টানা ছয় ইনিংসে সেঞ্চুরি হলো না, কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকে না। সাঙ্গা তো জীবনের প্রতিচ্ছবি, যে জীবন সবাই পেতে চায়, থাক না সেখানে দুই-চারটা আক্ষেপ!
এসেক্সের সঙ্গেই পরের ম্যাচে উডব্রিজ রোডে সাঙ্গা দুই ইনিংস মিলিয়ে করলেন ৩০ রান। থাক, ভুলে যান। মার্ক স্টোনম্যানের ১৯৭ রানের ইনিংসটা কথা অবশ্য মনে রাখতে পারেন। গিয়ে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, হয়তো সাঙ্গাও সেটাই করেছেন।
হেডিংলিতে সাঙ্গাকারা ১৮০ রানে অপরাজিত থাকলেন। গ্যারেথ ব্যাটি সাঙ্গার ডাবল সেঞ্চুরির জন্য অপেক্ষা করলেন না, ঘোষণা করে দিলেন ইনিংস। সাঙ্গা শুধু দলের জন্য খেলেন না, তিনি সারের পরিবারেরই সদস্য! ওই ২০ রানের আক্ষেপ রেখে আসলে লাভ নেই কোনও। এ ইনিংস দিয়েই সাঙ্গা হয়ে গেলেন এ মৌসুমে ১০০০ রান করা প্রথম ব্যাটসম্যান। সাঙ্গার চেয়ে আগে এ মাইলফলক আর কেইবা ছুঁতে পারতেন!
সারে এরপর ওভালে ফিরলো দুই ম্যাচের জন্য। ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে প্রথম ইনিংসে ১৬৪, সেঞ্চুরি নাম্বার সাত। সপ্তম স্বর্গে উঠে গেলেন সাঙ্গা, ক্যারিয়ারের শেষ মৌসুমে এসে। আপনার আমার আক্ষেপ আরেকটু বাড়িয়ে দিতে।
ওভালে নিজের শেষ ম্যাচে সাঙ্গা স্বর্গ ছুঁলেন আরেকবার। বারবার দেখা চলচ্চিত্রের কোনও দৃশ্যের মতো সেই কাভার ড্রাইভ, ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে খেলা সোজা শটগুলোর দেখা মিললো আরেকবার। সারের ওয়েবসাইটে দেয়া লাইভ স্ট্রিমিংয়ের লিঙ্কটা ঠিকঠাক কাজ করছিল না হয়তো, অথবা কাজ ছিল অন্য। সাঙ্গার ইনিংসের ঝলক দেখার জন্য সম্বল তাই ফেসবুকের কোনো ভিডিও ক্লিপ। এরপর সাঙ্গা ওভালকে বিদায় বলেন। তার আগেরদিনই সারের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাঙ্গা জেতেন পাঁচটা পুরষ্কার! এর আগে কাউন্টিতে বিদেশী কোনও ব্যাটসম্যান শেষ এতো অসাধারণ এক মৌসুম কাটিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে। ব্রায়ান লারা সেবারই খেলেছিলেন ৫০১ রানের সেই ইনিংস। সাহস করে এখানে একটা তথ্য দেয়া যায়, সেবার লারার গড় ছিল ৮৯.৮২। আর এ মৌসুমের শেষ ম্যাচের আগে সাঙ্গার গড় ১২৪.৪৫! সাঙ্গা পাঁচটা পুরষ্কার জিতবেন না তো কে জিতবেন!
কুমার সাঙ্গাকারাকে সে অনুষ্ঠানেই দেয়া হয় সারের আজীবন সদস্যপদ। এর আগে এমসিসির আজীবন সদস্যপদ পেয়েছিলেন, তখন তার মনে হয়েছিল, জীবনের প্রাপ্তিগুলোর ক্ষুদ্র তালিকায় যেটা থাকবে। সারের দেয়া এই সম্মাননা নাকি ছাড়িয়ে যাবে সেটাও! সারে যে তাকে শুধু কাউন্টি ক্রিকেট নয়, যে খেলাটা এতো ভালবাসেন, সেটারই এক নতুন স্বাদ দিয়েছে!
ওলি পোপ সারের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার হয়েছেন এবার। লর্ডসের এক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সাঙ্গার সঙ্গে আধা ঘন্টার মতো ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। আজীবন মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তার তাতেই। সাঙ্গার সঙ্গে প্রথম ব্যাটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেউ ভোলেন নাকি! অবশ্য সাঙ্গা আবার ভিন্ন কথা বলেন। তার কাছ থেকে নাকি শেখার তেমন কিছু নেই, তিনিই বরং সারের তরুণদের কাছে শিখেছেন! সারে নাকি তাকে মিস করবে না, সারের উঠতি ক্রিকেটাররা সেটা হতে দেবেন না। ক্রিকেটকে উপভোগ করা, ক্রিকেটের নতুন এক দিক নাকি উন্মোচিত হয়েছে তার কাছে। ক্রিকেট ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্র তিনি, ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের নিয়মিত অনুশীলন তার ধর্ম। সেই সাঙ্গা এমন কথা অবশ্য বলতেই পারেন, তার সে কথাকে ‘বিনয়’ হিসেবে ভেবে এতো ‘সিরিয়াসলি’ নেয়ার বোধহয় কিছু নেই!
****
ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচটা সরাসরি দেখার সুযোগ নেই ওল্ড ট্রাফোর্ডের বাইরে থেকে। কুমার সাঙ্গাকারা সেখানেই জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচটা খেলতে নেমেছেন। ভরসা তাই লাইভ স্কোর, সে স্কোরকার্ড পড়ছে, সাঙ্গা শেষের শুরুর ইনিংসে আউট হয়ে গেছেন ১৪ রান করে। রব জোনসের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন সাকিব মাহমুদের বলে। ৪২৯টি ইনিংস খেলে ফেললেন প্রথম শ্রেণিতে, রইল বাকি এক। সে ইনিংসটাও সরাসরি দেখা যাবে না। কুমার সাঙ্গাকারা প্রথম শ্রেণিতে এমন রাজসিক আর কোনও মৌসুম কাটাবেন না, লাল বা গোলাপি বলে দেখা যাবে না সেই কাভার ড্রাইভ। তার দেখে-মনে-হয়-কতো-সহজ ধরনের ব্যাটিং দেখা যাবে না আর! এ মৌসুমে সারের হয়ে রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপের ফাইনাল খেলেও ট্রফিটা জিততে পারেননি সাঙ্গা। শেষ ম্যাচটা সারে খেলতে নেমেছে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের দুই নম্বরে থেকে, তবে এসেক্স আগেই হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়ন। সাঙ্গার আক্ষেপ থাকতে পারে সেই ১৬ রান না করতে পেরেও।
তবে বিশ্বাস করুন, সাঙ্গাকে প্রথম শ্রেণি থেকে চলে যেতে দেখে আপনার আমার যে আক্ষেপ হচ্ছে, তার তুলনায় সেটা কিছুই না। অন্তত একটি দিক দিয়ে আমরা সাঙ্গাকারার চেয়ে এগিয়ে। আমাদের আক্ষেপটা বেশি।
জীবনও থেমে থাকে না, সাঙ্গাকারা না থাকলেও জীবন চলে। শুধু থেকে যায় জীবনের চিরকালিন অনুষঙ্গ; আক্ষেপ।