মুমিনুলের 'অনেক' প্রমাণের দিন
তামিম ইকবাল? লর্ডসে লাফিয়ে উঠলেন, জার্সির পেছন দিকে ইঙ্গিত করে নাম লেখাতে বললেন অনার্স বোর্ডে। উদযাপনে তামিমের ধারেকাছেও বোধহয় কোনও ব্যাটসম্যান নেই বাংলাদেশে। সাকিব আল হাসান? হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন কাল্পনিক কিছু, নাচের মুদ্রা তৈরি করেন তৎক্ষণাৎ। সাকিব উদযাপনে তামিমের চেয়েও এগিয়ে, ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সাকিবের যে উদযাপনের উপলক্ষ্য আসে বোলিংয়েও। মাহমুদউল্লাহ? চুমু এঁকে ছুঁড়ে দেওয়া ভোলেননি নিশ্চয়ই, অথবা বুকের কাছে হৃদয় আঁকা! মুশফিকুর রহিম? পকেট থেকে কয়েন বের করে কিছু একটার ইঙ্গিত তো দিয়েছিলেন তিনিই। তার অতি-উদযাপন নিয়েও দুই-চার কথা আছে।
কিন্তু মুমিনুল হক? শূন্যে ছোঁড়া হাত, ব্যাট পাকানো এদিক-ওদিক। শান্ত-সৌম্য চেহারাতেও ফুটে ওঠা একটা ক্ষীপ্র ভঙ্গিমা। মুমিনুল চিৎকার করলেন না, ঠিক সেভাবে লাফিয়েও উঠতে পারলেন না হয়তো। তবুও, এই মুমিনুল ঠিক চেনা নয়। এই উদযাপন তো ঠিক মুমিনুলের নয়!
‘এটাই বললাম। মুমিনুলের কিছু প্রমাণের ছিলো এবং সেটা সে করেছে। আমার কাছেও দেখে ভালো লাগছে। আমি জানি কেন সে এটা করেছে’, তামিম ইকবাল বিস্মিত হননি মোটেও এই মুমিনুলকে দেখে। আপনি হয়েছেন? এই উদযাপনটা মুমিনুলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে, এ উদযাপনে ফুটে উঠতে পারে অন্য মুমিনুল, কিন্তু তাতে কি বিস্ময় ফুটে ওঠে? কেন করলেন তিনি এমন, এমন প্রশ্ন জাগে? নাহ্। তামিম হয়তো আপনার চেয়ে বেশি জানেন, বেশি ভেতরের ঘটনা জানেন। তবে আপনিও কিন্তু কম জানেন না। মুমিনুলের আবেগ তাই আপনাকেও ছুঁয়ে যায় হয়তো।
মুমিনুল হক বাদ পড়লেন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট সিরিজ থেকে। কেন? বেশ কয়েকটা কথা বলেছিলেন নির্বাচকরা। একটার সঙ্গে আরেকটা সাংঘর্ষিকও ছিল। সে সময় দলের নীতিনির্ধারণীর অন্যতম বড় ক্ষমতা যার কাছে ছিল, সেই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে প্রায় এড়িয়েই গিয়েছিলেন মুমিনুলের কথা। নাটকীয়ভাবে মুমিনুল দলে ফিরেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলেছিলেন দ্বিতীয় টেস্টে। দুই ইনিংসেই আউট হয়েছিলেন ন্যাথান লায়নের বলে। হাথুরুসিংহে গল টেস্টের পরই বলেছিলেন, মুমিনুলের অফস্পিনে সমস্যা আছে। সে টেস্টের দুই ইনিংসেই তিনি এলবিডাব্লিউ হয়েছিলেন দিলরুয়ান পেরেরার বলে।
আজ সেই পেরেরার বলে চারটি চার মারলেন মুমিনুল। স্কোরিং শটও তার বলেই বেশি। সেসব শটে ছিল আত্মবিশ্বাস, ছিল নিয়ন্ত্রণ, আর সেগুলোর অসাধারণ বাস্তবায়ন। রঙ্গনা হেরাথের বাঁহাতি স্পিন বা লাকশান সান্দাকানের চায়নাম্যান- মুমিনুল সেগুলোও খেললেন অবলীলায়। যে হাথুরুসিংহের সময়ে ‘স্বস্তি’তে ছিলেন না তিনি, সেই তিনিই আজ প্রতিপক্ষের ড্রেসিংরুম থেকে দেখলেন এসব।
‘আমার কাছে মনে হয় মুমিনুলের ইনিংসটা ছিলো মুগ্ধকর। প্রথমেই সে আক্রমণাত্মক ছিলো এবং সেভাবেই পুরো ইনিংস খেলে গেছে। যখন সে একশ করে তখন তার স্ট্রাইকরেট ছিলো ১০৩!’, তামিম আজ সতীর্থের ব্যাটিংয়ে শুধুই মুগ্ধ। কিভাবে ভাষায় প্রকাশ করবেন, সেটাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না নাকি।
মুমিনুলের সবচেয়ে দাপুটে শট ছিল আজ কাভার ড্রাইভ। অফসাইডে ইনফ্রন্ট অব স্কয়ারে মুমিনুল করেছেন ৬৯ রান। এর মাঝে কাভার ড্রাইভেই এসেছে ৫১ রান। তামিমের রেখে আসা রানস্রোতটা রুদ্ধ করেননি, তবে প্রথম সেশনে ৩৯ বলে করলেন ২৬ রান। জমতে থাকা আত্মবিশ্বাস এরপর তাকে গিয়ার বদলানোর সাহস জোগালো, মুমিনুল পরের ৫৬ বলে করলেন ৭৬ রান! করলেন বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি।
তামিম তার ইনিংসে অন্তত তিনবার স্লিপে এদিক-ওদিক হলেই আউট হতেন, ইমরুলের প্রথম হুক শটটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, ছিল নিয়ন্ত্রণের অভাবে দুষ্ট। মুশফিকের ওপর যেন ক্লান্তি ভর করলো, অফস্টাম্পের বাইরের বলে অলস ভঙিমায় খেলতে গিয়ে পেছনে ক্যাচ দিলেন। লিটন লাইন-লেংথের খেই হারিয়ে ফেললেন অফস্টাম্প হারানোর আগে। কিন্তু মুমিনুল সুযোগ দিলেন না শ্রীলঙ্কান বোলারদের, বরং নিলেন যখনই পেলেন।
‘যে জিনিসটা আমাদের জন্য এই উইকেটে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো; আমরা জানতাম এখানে ব্যাটিং করা সহজ হবে, বিশেষ করে প্রথম দিনে ও ওর উইকেটটা নষ্ট করেনি। অনেক সময় দেখা যায় ব্যাটিং উইকেটে বেশি উত্তেজিত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে অনেকে আউট হয়ে যায়। ও সেটা করেনি। ও জানত ওর উইকেটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মুমিনুল অপরাজিত, আশা করি সে আরো অনেক দূর যাবে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তার কিছু প্রমাণ করার ছিলো এবং সে সেটা দারুণভাবে করেছে’, তামিম দুইবার বললেন মুমিনুলের কিছু প্রমাণ করার কথা।
সানদাকানকে দুই চারে সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন মুমিনুল। দিনশেষে অপরাজিত থাকলেন। শুধু 'কিছু' না, প্রমাণ হলো অনেক কিছুই। উদযাপনে ক্ষীপ্র ভাব এনে, মুশফিকের আলিঙ্গনে মিশে গিয়ে মুমিনুল হয়তো সেই প্রমাণেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন!