মুমিনুল হক: দুর্ভাগ্য নাকি অন্য কিছু?
‘এই টেস্টে তার বাদ যাওয়াটা দুর্ভাগ্যের, এটা আপনি বলতে পারেন না। পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে দুইজন খেলোয়াড় তার ওপরে আছে। আমি যেটা বিশ্বাস করি ব্যক্তিগতভাবে, একজন ক্রিকেটারকে তার পারফরম্যান্সের জন্য দাম দেয়া উচিৎ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে।’ মুমিনুল হক ‘দুর্ভাগা’ নন, প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিনের কথা অনুযায়ী।
****
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম টেস্টের স্কোয়াডে মুমিনুল জায়গা পাননি ওই পারফরম্যান্সের কারণেই, ‘মুমিনুলের সামগ্রিক যে ফর্ম, আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে, শেষ জানুয়ারি থেকে শ্রীলঙ্কা সিরিজ পর্যন্ত, ৬ ইনিংসে একটা ফিফটি।’
মুমিনুলের ফিফটিটা এসেছিল ওয়েলিংটনে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ইনিংসে। ১৬ রানেই প্রথম উইকেট হারিয়ে চাপে পড়েছিল বাংলাদেশ, তামিম ইকবালের সঙ্গে ৪৪, মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৮৫, সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ১৫ রানের জুটি ছিল মুমিনুলের। এরপরই সাকিব-মুশফিকের মহাকাব্যিক জুটি। সে জুটিও বাংলাদেশকে হার থেকে বাঁচাতে পারেনি সেবার, সে ফিফটিটাও মুমিনুলের জন্য যথেষ্ট হলো না এবার। শ্রীলঙ্কা সফরে দ্বিতীয় টেস্ট বাদ পড়েছিলেন, এবার চলে গেলেন স্কোয়াডেরই বাইরে।
‘ওভাবে চিন্তা করিনি। অনুশীলন করছি। কাজ যেসব করা দরকার করছি। খেলব কি খেলব না সেটা টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। আমার হাতে নেই। আমার হাতে যা আছে, চেষ্টা করছি’, চট্টগ্রামে প্রস্তুতি ম্যাচে ৭৩ রান করার পর দলের ফেরার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মুমিনুল বলেছিলেন এমন। তবে হাতে থাকা সেই পারফরম্যান্স যথেষ্ট হলো না তার জন্য।
পারফরম্যান্স বিচারে মুমিনুলের ওপরে দুইজন। সৌম্যর পারফরম্যান্স তাকে দলের বাইরে রাখতে দেয়নি, ইমরুলের জন্য আবার ‘ঢাল’ হয়ে এসেছে তার দেশের মাটির পারফরম্যান্স, ‘ইমরুল দেশের মাটিতে ভাল, মাঝে চোটের কারণে খেলতে পারেনি, পারফরম্যান্স বিচারে সে আছে।’
দেশের মাটিতে সর্বশেষ বাংলাদেশ খেলেছিল ইংল্যান্ডের সঙ্গে। সে সিরিজে ইমরুলের ফিফটি ছিল একটি, মুমিনুলেরও তাই, ঢাকা টেস্টে। প্রথম ইনিংসে দলীয় ১ রানেই ইমরুল আউট হয়ে যাওয়ার পর তামিমের সঙ্গে মুমিনুল গড়েছিলেন ১৭০ রানের জুটি। দ্বিতীয় ইনিংসে মুমিনুল আউট হয়েছিলেন ১ রান করে, ইমরুল জুটি গড়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ ও সাকিবের সঙ্গে।
‘এরপর আরও কিছু টেস্ট খেলেছি আমরা (যেসবের পারফরম্যান্সের কারণে মুমিনুল বাদ পড়েছেন), মুমিনুলের ইনিংস তো এক বছর আগে। তবে সব বিবেচনায় আনা হয়েছে’, ইমরুলের জন্য যেটা ঢাল, সে ‘ঢাল’ আছে মুমিনুলেরও। শুধু সুরটা বদলে গেল প্রধান নির্বাচকেরই!
****
‘আমি কারও নাম বলতে চাই না, এখানে আসলে দল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি না। আমাদের আসলে ধারাবাহিকতা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমাদের সেজন্য এই দুইটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। শেষ সিরিজে গল টেস্টে হারার পর আমরা ভালো খেলেছি। এরপর যদিও কয়েকজন খুব ভালো করেছে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও ভালো করেছে, কিন্তু ওদের দুর্ভাগ্যবশত অপেক্ষা করতে হবে। আমি ওদেরকে দোষ দিচ্ছি না।’
এবার বক্তা কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে হাথুরুসিংহে। মুমিনুল যে ‘প্রক্রিয়া’তে বাদ গেলেন, সেটা চালু হয়ে গেছে, চালু থাকবে বলেই জানালেন তিনি।
গল টেস্টে বাদ পড়ারও অনেক আগে বলা হয়েছিল, মুমিনুল শর্ট বল খেলতে পারেন না, এরপর ধরা পড়লো, ‘মুমিনুল অফস্পিন খেলতে পারেন না’। এতো ‘পারেন না’র ভীড়ে তাই মুমিনুলও যেন হারিয়ে গেলেন। তবে এসব টেকনিকজনিত সমস্যাতে ‘দায়’টা খেলোয়াড়দের বেশি বলেই মত হাথুরুসিংহের, ‘আমাদের দায়িত্ব আছে, কিন্তু আমাদের চেয়ে এটা খেলোয়াড়ের বেশি। তারা এটা নিয়ে পরিশ্রম করছে। কেউ দল থেকে বাদ গেলে চেষ্টা করছে ফিরে আসার। কেউ যদি দলে থেকেই পারফর্ম করে, তাহলে বাইরে থেকে কাউকে আনার জন্য তাকে বাদ দেওয়াটা কঠিন।’
‘এর মানে এই নয় ওর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগেও যেটা হয়নি, আমি থাকতে এটা হবেও না। ভালো না খেললে তো দলে নিয়ে আসতে পারব না। কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর আমার প্রাধান্য নেই।’
****
‘মুমিনুলের ব্যাপারটা যদি সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে বলতে বলেন, আমরা সবসময়ই তাকে মানসিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আমি, হাবিবুল বাশার, সবসময়ই আলোচনা করি। ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা করি সামনে পেলেই। ওকে যখন শ্রীলঙ্কা থেকে আনা হলো, ইমার্জিং কাপে খেলানো হয়েছিল। “ব্যাক-আপে” চিন্তা করছি। দলের একটা পরিকল্পনা আছে, প্রধান কোচ নির্বাচক প্যানেলের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং, পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই সৌম্য-ইমরুলকে এগিয়ে রেখেছেন। অতিরিক্ত আরেকজন ওপেনার, তিন নাম্বারে আরেকজন ব্যাটসম্যান নেয়া কষ্টকর হয়ে যায়। সামনে কী করি, সেটা দেখতে পাবেন’, মিনহাজুল এবার অপেক্ষা করতে বললেন।
‘সামনে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাতে নিতে পারি, সেরকম পরিকল্পনা আছে আমাদের। এটা নয় যে, তার ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে গেল। এটা নয়, যাকে নিচ্ছি না, তাকে একেবারে চোখে আড়াল করে দিচ্ছি। যাকে যখন দরকার হবে, দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, তাকে তখন আনা হবে।’
আপাতত দলের স্বার্থে দরকার পড়ছে না মুমিনুলের।
****
‘ধারাবাহিকভাবে একটা ছেলে যদি ৪-৫টা ইনিংসে রান না করে, সে আত্মবিশ্বাস পায় না। আমিও ব্যাটসম্যান ছিলাম, হাবিবুল বাশারও ব্যাটসম্যান ছিল, আমরা এসব জানি। দেশের মাটিতে চাপ থাকে অনেক বেশি, বাইরে একটু কম থাকে। অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা দলের বিপক্ষে যাদের থেকে আমরা সেরা পারফরম্যান্স চাচ্ছি, টিম ম্যানেজমেন্ট চেয়েছে, সেভাবেই স্কোয়াড সাজানো হয়েছে। এজন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুমিনুল বাদ পড়েছে।’
মিনহাজুলের মতে, এই টেস্টে মুমিনুলের বাদ পড়ার জন্য তাকে ‘দুর্ভাগা’ বলা যাবে না। আবার তারই মতে, এই টেস্টে সবকিছু মিলিয়ে ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ মুমিনুল বাদ পড়েছেন।
কে আসলে দুর্ভাগা?
কার আসলে দুর্ভাগ্য?
দুর্ভাগ্যজনক আসলে কোনটা?