রাজ্জাক আর আপনার স্মৃতিকাতরতা
কেভিন পিটারসেনকে তখন তাড়া করছিল বাঁহাতি স্পিনের ভূত। চট্টগ্রাম, ২০১০। ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে আব্দুর রাজ্জাককে লেগসাইডে গ্লান্স করতে গেলেন। মিডল-লেগে বল পড়ে টার্ন করে মিডল-অফ ভাঙলো। একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরলেন কেপি, ৯৯ রানে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ওই একবারই আউট হয়েছিলেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক।
রাজ্জাক দৌড় দিলেন, দুই হাতের তর্জনি উঁচিয়ে। মুখে বিস্তৃত হাসি, ক্ষীপ্রতা নেই, শুধুই উল্লাস! খানিক বাদেই বাঁধা পড়লেন মুশফিকদের আলিঙ্গনে, মুশফিক তখন কিপিং-ই করতেন।
আপনি ওই হাসিটা মিস করেননি? তর্জনি তুলে করা ওই উল্লাসটা?
আব্দুর রাজ্জাক এই চার বছরেও হয়তো এমন উল্লাস অসংখ্যবারই করেছেন, সেই হাসিটাও হেসেছেন কতোবার! আপনি শুধু তার উইকেটের খবর শুনেছেন, সেই উল্লাসের সঙ্গী হওয়ার বদলে আপনার বুকে চেপেছে একরাশ হতাশা- রাজ্জাক যে জাতীয় দলেই নেই!
****
রাজ্জাক আজ দলে ফিরলেন। একপ্রান্তে মেহেদি হাসানের সঙ্গে ওপেনিংয়ে ওপ্রান্তে রাজ্জাককেই আনলেন মাহমুদউল্লাহ।
‘জাতীয় দলে খুব বেশি পার্থক্য দেখছি, তা নয়’, চার বছর পর ফিরে রাজ্জাক পার্থক্য দেখছেন না তেমন, ‘এটা এমনই জায়গা, এখানে আসলে সবাই সিরিয়াস। সবাই যার যার কাজ করে নেয়।’
রাজ্জাককে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামে, গিয়ে শুধু সানজামুল হককে টেস্ট ক্যাপ পরিয়ে দেওয়ার কাজটাই করেছিলেন। পরের টেস্টের স্কোয়াডেও থাকলেন, খেললেন প্রিমিয়ার লিগের একটা ম্যাচও। জাতীয় দলে ফিরেও যেন ফেরা হলো না তার।
‘প্রথম বল করতে যাওয়া- আসলে ঘরোয়া পর্যায়ের যে কোনো খেলা, আইপিএল-বিপিএল বা যত প্রিমিয়ার লিগ আছে, সব কিছুর চেয়ে জাতীয় দলকে আমি অনেক ওপরে রাখি। কেন যেন একটা অন্য রকম অনুভূতি থাকে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মধ্যে চাপও থাকে। শুরুতে কিছুটা (চাপ) তো ছিলই, পরে ঠিক হয়ে গেছে।’
চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সেই টেস্ট ছিল রাজ্জাকের ক্যারিয়ারের ৬ষ্ঠ। তখন পর্যন্ত ৩ উইকেট পেয়েছিলেন একবার। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সেরা বোলার লাল বলে তখনও থিতু হতে পারেননি। ইংল্যান্ডের ৫৯৯ রানের বিপরীতে ২৯৬ রানেই প্রথম ইনিংসে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। নিজেদের শক্তিমত্তা অনুযায়ী উইকেট বানিয়ে খেলা- বাংলাদেশের কাছে এই ধারণা তখন এলিয়েনদের জটিল কোনো প্রোগ্রামের অর্থ উদ্ধার করার মতোই।
সেই ইংল্যান্ডের সঙ্গেই বাংলাদেশ প্রথম এই রেসিপি হাতে নিল। তবে সেই টেস্টটার প্রায় বছর ছয়েক পর, রাজ্জাক ততদিন টেস্ট দল কেন, জাতীয় দলেরই বাইরে! এ ধরনের টার্নিং উইকেটে রাজ্জাকের টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা তাই এটাই প্রথম।
‘এ ধরনের উইকেটে এই প্রথম খেললাম। আগে তো নিজেদের শক্তি দেখে-শুনে খেলার সুযোগ ছিলো না। এখন তো আমাদের ক্রিকেট সামনের দিকেই যাবে। সেটারই ফল এটা।’
রাজ্জাক এই উইকেটে করুনারত্নেকে ধোঁকা দিলেন, গুণাথিলাকার বড় শট খেলার প্রবণতা নস্যাৎ করলেন, চান্ডিমাল আর মেন্ডিসকে দেখালেন তার ঘূর্ণির শক্তি। হ্যাটট্রিকের সুযোগও তৈরী করেছিলেন, সব মিলিয়ে প্রথম ইনিংসে নিলেন ৪ উইকেট। রাজ্জাক এর আগে টেস্টে কোনও ইনিংসে ৪ উইকেট পাননি, ৬৩ রানে ৪ উইকেটের এই ফিগারটা শুধু ইনিংসে না, ম্যাচেই রাজ্জাকের সেরা বোলিং!
‘না, তা নয়। আমি আসলে জবাব হিসেবে দেখছি না’, এতোদিন ধরে এতো উপেক্ষার জবাবে পারফরম্যান্স দিয়ে দিতে চান না তিনি।
‘যখন যেখানে খেলার সুযোগ পেয়েছি, চেষ্টা করেছি ভালো করার। ভালো হলে খুশি হই। খারাপ হলে যে খুব মন খারাপ হয় সেটা না। আমি চেষ্টা করি সমস্যা খুঁজে বের করার। পারফরম্যান্সকে আসলে জবাব হিসেবে বলা ঠিক হবে না।’
তবে পারফরম্যান্সই বলছে, সেই রাজ্জাকের সঙ্গে এই রাজ্জাকের পার্থক্যটা সুস্পষ্ট। তবে এই ৩৬ ছুঁই ছুঁই বয়সে জাতীয় দলে ফেরা, তাও আবার টেস্টে- এটাকে রাজ্জাক দেখছেন ইতিবাচক ভাবেই, ‘অবশ্যই আমি এটা মনে করি। এখনকার সময়ে ক্রিকেটের যে অবস্থা, ফিটনেস, খাদ্যাভ্যাস- তারপরও আমাকে দলে নেয়া হয়েছে, এর জন্য বোর্ডকে ধন্যবাদ। এটাতেই প্রমাণ হয় কারও সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে না কখনও। সুযোগ থাকে আরকি।’
রাজ্জাক সেই সুযোগটা কাজে লাগালেন কি দারুণভাবেই!
****
গুণাথিলাকার হুট করে বড় শটের প্রবণতা আর মুশফিকের মিড-অফের দারুণ ক্যাচ চান্ডিমালকে ডেকে আনলো ক্রিজে। মিডল-লেগে পড়ে বল টার্ন করে মিডল-স্টাম্প ভাঙলো। শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক ক্রিজে টিকলেন শুধুই ১ বল। রাজ্জাক দৌড় দিলেন- দুই হাতের তর্জনি না- শুধু বাঁহাতের তর্জনি উঁচিয়ে। মুখে হাসি, ক্ষীপ্রতা নেই, শুধুই উল্লাস! সেই হাসিটা বিস্তৃত, তবে সেই ২০১০ সালের মতো নয়। আরেকটু পরিমিত। খানিক বাদেই বাঁধা পড়লেন লিটন-মেহেদি-মাহমুদউল্লাহদের আলিঙ্গনে, এরপর আসলেন মুশফিকরা।
রাজ্জাক আজ আপনাকে সেই দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন, যখন রাজ্জাকের উল্লাসের সঙ্গী হতেন আপনি নিয়মিতই। রাজ্জাক আজ আপনাকে স্মৃতিকাতর করে তুলেছেন।
আব্দুর রাজ্জাকের সেই হাসি হয়তো আপনার মুখেও ফুটেছে।