'স্পিন-ট্র্যাক' যখন বাংলাদেশের শাঁখের করাত
শুরুতেই একটা প্রশ্ন করা যাক, ‘স্পোর্টিং উইকেট’ মানে আসলে কী?
ক্রিকেটে সাধারণ নিয়মে যে উইকেটে ব্যাটসম্যান আর বোলারদের লড়াইটা জমজমাট হয়, দুই পক্ষের জন্যই কিছু থাকে সেটিকে ‘স্পোর্টিং’ উইকেট বলা যায়। কিন্তু তিন দিনে শেষ হয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম টেস্টের উইকেট নিয়ে কি তা বলা যাবে?
স্কোরকার্ড দেখে আপনি হয়তো বলতে পারেন, চট্টগ্রামের উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য বধ্যভূমি ছিল। তৃতীয় দিনের চা বিরতির আগেই যখন খেলা শেষ হয়ে যায়, দুই দলের দ্বিতীয় ইনিংসে কেউই যখন ১৫০ পেরুতে পারে না, উইকেটটা ‘স্পোর্টিং’ নয় এই অনুসিদ্ধান্তে আপনি আসতেই পারেন। কিন্তু এই উইকেটটা কি ডিমেরিট পয়েন্ট পাওয়ার মতো? আরেকটু এগিয়ে প্রশ্ন করা যায়, স্পিনারদের ‘লেলিয়ে দিয়ে’ এমন উইকেট প্রস্তুত করা কি ‘যুদ্ধজয়ের জন্য কোনো অনৈতিক কূটকৌশল’?
প্রশ্নগুলো উত্তর গত দুই দিনে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও কোচ স্টিভ রোডস অনেকটাই দিয়ে দিয়েছেন। তবে তার আগে চট্টগ্রাম টেস্টের উইকেটটা ‘র্যাঙ্ক টার্নার’ কি না সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
আর যাই হোক, চট্টগ্রামের পিচটা অবশ্যই ব্যাটিং মৃগয়া ছিল না। ম্যাচ শুরুর আগেই সাকিব বলেছিলেন, এই উইকেটে স্পিন ধরবে। মুমিনুল হক বলেছিলেন, এই উইকেটের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। কিন্তু মাঠের খেলা বলছে, উইকেটের জন্য না যতটা, ব্যাটিং-বিপর্যয়ে তার চেয়ে বেশি দায় ব্যাটসম্যানদের দুর্বল টেকনিক আর টেস্ট মানসিকতার অভাব। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যখন সিলেটের নির্বিষ উইকেটেই দুই ইনিংসে দুইশর নিচে অলআউট হয়ে যান, চট্টগ্রামেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? প্রথম ইনিংসে যেমন গ্যাব্রিয়েলের একটি দুইটি বল বাদ দিলে বাকি আউটের জন্য দায় ব্যাটসম্যানদের নিজের কাঁধেই নিতে হবে। মুমিনুল নিজেই বলেছেন, প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পর ওই সময় উইকেটটা বিলিয়ে দিয়ে না এলে ওই ধস হতো না। সেই ধসও কিন্তু স্পিনে নয়, গ্যাব্রিয়েলের পেস জুজুতেই হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় ইনিংসেও বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানকে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। সাকিব, সৌম্য, মিঠুন সেখানে দাঁড়াবেনই, ইমরুল, মুমিনুল, মাহমুদউল্লাহও সেই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। মুশফিক গ্যাব্রিয়েলের দারুণ একটি বলে আউট হয়েছেন। শুধু মিরাজকে করা বিশুর উইকেট নেওয়া বলটিতে বলা যায়, ব্যাটসম্যানের খুব একটা কিছু করার ছিল না। একই কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চতুর্থ ইনিংসে বলের লাইন মিস করেই আউট হয়ে গেছেন হোপ, চেজরা। নতুন বলে এই উইকেটে ব্যাট করা কঠিন হলেও পুরনো বলে কাজটা সহজ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ব্রাথওয়েট ম্যাচ শেষেই বলেছেন। ওয়ারিকান-আমব্রিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এই উইকেটে একটু মানিয়ে নিতে পারলে ব্যাট করা খুব কঠিন কিছু নয়। রাফ থেকে বল কয়েকবার লাফিয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু সেটাও এমন বেশি কিছু নয়।
তাহলে কি চট্টগ্রামের উইকেট ডিমেরিট পয়েন্টের খড়গ থেকে রেহাই পাবে? সেই কথাটা অবশ্য জোর দিয়ে বলা যায় না। এই বছরেই চট্টগ্রামের উইকেট একটি পয়েন্ট পেয়েছিল, তবে সেটা ছিল বোলারদের জন্য কিছুই না থাকার কারণে। আর গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আর এই বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টের জন্য ডিমেরিট পয়েন্ট পেয়েছিল মিরপুর। তবে এই দুবারের উইকেটেই স্পিনারদের জন্য একেবারে মৃগয়া ছিল। আইসিসির আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, প্রথম দিন থেকেই পিচ ভাঙছে বলেই ‘গড়পড়তার চেয়ে নিচে’ রায় পেয়েছে। এই চট্টগ্রামের উইকেট আর যাই হোক, সেরকম ছিল না।
তবে চট্টগ্রামের উইকেট যদি সেরকম হতোও, বাংলাদেশের পরিকল্পনা কি বদলানো উচিত? মিরপুরে কি অমন উইকেটই থাকবে? ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সাথে এই স্পিন-ট্র্যাক বানিয়েই সাফল্য বানিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে জয় সেই রেসিপি মেনেই এসেছে। সাকিব যেমন পরশুই বললেন, ‘আমি ১১-১২ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছি, এর মধ্যে ৮ বছরই হয়তো ফ্ল্যাট উইকেটে বল করেছি। এখন আমাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে। আমরা স্পিনিং উইকেটে বোলিং করছি।’ মনে করিয়ে দিলেন, এখন সব দলই ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ইংল্যান্ডের কাছে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ধবলধোলাই বাদ দিলে নিজেদের মাঠে কমবেশি সব দলই সফল। উপমহাদেশের দেশগুলো যেমন নিজেদের মাঠে স্পিন-মৃগয়া বানাবে, বাইরে গিয়ে তেমন পেস-স্বর্গে খেলতে হবে, এ একরকম জানা কথাই। রোডস তো এই ব্যাপারটা দেখছেন ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য হিসেবেই, ‘অ্যান্টিগাতে আমরা একদম অচেনা কন্ডিশনে খেলেছি। ডিউক বল সেখানে সুইং করছে প্রতিনিয়ত, সবুজ আর বাউন্সি উইকেটে খেলেছি। আমার তো মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশনে খেলাটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। ক্রিকেটের মতো অসাধারণ খেলা আলাদা আলাদা ভাবে খেলা হতেই পারে। উপমহাদেশে এসে এরকম ভিন্ন উইকেটে খেলা হচ্ছে বলেই খেলাটা আরও বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছে।’
আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, এরকম স্পিনিং ট্র্যাকে খেলা হচ্ছে বলেই তো বিদেশের মাটিতে গিয়ে খাবি খাচ্ছে ব্যাটসম্যানরা। এই আশঙ্কার জায়গাটা সাকিবও বোঝেন। তবে এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ওপর জোর দিলেন, ‘আমরাও জানি, আমরা বাইরে গেলে সংগ্রাম করি। এর জন্য বাইরে খেলার জন্য খুব ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। সেটা করলে আমরা হয়তো পাঁচ বছর পরে গিয়ে এর সুফল পাব। আর যদি এখনও পরিকল্পনা না করা হয় তাহলে দশ বছর লেগে যেতে পারে।’
কিন্তু এরকম স্পিনিং ট্র্যাক দেখলে দেশ থেকে পেসাররা উঠে আসবেই বা কীভাবে? কোচ রোডস বিশ্বাস করেন, বিদেশের মাটিতে পেসারদের এক দুইটা ভালো পারফরম্যান্স অনেকের জন্য প্রেরণা হতে পারে, ‘পেসারদেরও দিন আসবে। সেটা দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় হতে পারে। ফিজ (মোস্তাফিজুর রহমান) ওর কাটারে ভালো করছে। খালেদ (আহমেদ) রিভার্স সুইংয়ে আশা জাগাচ্ছে। (আবু জায়েদ) রাহীও আছে। নিউজিল্যান্ডেই ওদের প্রমাণ করতে হবে নিজেদের। সেখানে তারা ভালো করলে দেশের মাটিতে আরেকটু বেশি সুযোগ তারা আশা করতেই পারে।’
সেই সুযোগ কবে আসবে, আপাতত সেটাই বড় প্রশ্ন। তার আগ পর্যন্ত উপমহাদেশীয় রীতি মেনে টেস্টে স্পিন-মালাতেই প্রতিপক্ষকে বরণ করে নেবে বাংলাদেশ। ভারত যদি এত বছর পরও সেই ফর্মুলা মেনে চলে, বাংলাদেশের তাতে বিব্রত বোধ করার কোনো কারণ নেই। আবার এটাও ঠিক, ভারতেরই পেসাররা কিন্তু ইংল্যান্ডে, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে সাফল্য পাওয়া শুরু করেছেন। বাংলাদেশের পেসারদের স্বার্থেই সেই সুযোগটা নিতে হবে তাদের। নইলে ঘরের মাঠে এরকম স্পিনিং ট্র্যাক বানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। দিনশেষে যে জয়টাই শেষ কথা!