• " />

     

    মাশরাফি চলে যান, থেকে যায় রেশ...

    মাশরাফি চলে যান, থেকে যায় রেশ...    

    নড়াইল থেকে ফিরে... 


     

     

     

    -এই যে, আপনারা দেরি করি ফেলিছেন, একটু আগেই তো এই পথ দিয়ে চলি গেল।

    কিশোরীর উল্লাসে কলকল করতে বলছিলেন সারোলের সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা। খানিক আগেই এই পথ দিয়ে চলে গেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। শীতের পড়ন্ত দুপুরে তখনও তার চোখেমুখে চিকচিক করছিল ‘নিতাকে’ কাছ থেকে দেখার আনন্দ। মোটরবাইক বহরের উড়িয়ে যাওয়া ধুলো তখনও লেপ্টে আছে পিচঢাকা পথে নিকোনো খড়ের গাদায়। আর তার সাথে মিলেমিশে একাকার মাশরাফিকে কাছ থেকে এক নজর দেখতে পাওয়ার আনন্দ।

    নড়াইলের শহরবাসীর জন্য এই অভিজ্ঞতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ‘কৌশিক’ তাদের কাছে অচেনা কেউ নয়। ওই যে বয়েজ স্কুল মাঠ, সেখানেই তো শুরু তার দুরন্তপনা। একটু এগুলেই সামনে মামার বাড়ি, কৌশিক এখনো ঢাকা থেকে এসে যেখানে আস্তানা গাঁড়েন। তবে ঘরের ছেলের ঘরের ফেরাটা এবার ছিল অন্যরকম। এতোদিন ফিরেছিলেন ১১ জনের অধিনায়ক হয়ে, এবার ফিরেছেন নড়াইল-২ আসনের তিন লাখ মানুষের হয়ে টস করতে নামার অভিযানে। তবে লোহাগড়ার পাড়াগাঁয়ের লোকেদের এত কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য তো আর হয়নি। নির্বাচনের সুবাদে তারা কাছ থেকে দেখতে পেরেছেন, সেটাও বা কম কী!

    এলাকায় আসার পরেই মাশরাফি দুইটি কথা বলেছেন বার বার। তার বহরে বাহার বেশি থাকবে না, কলেবরে হবে ছোট। আর প্রতিপক্ষদের কোনোভাবেই শারীরিক বা মানসিক হয়রানি করা যাবে না। কিন্তু বহর যতই ছোট রাখতে চান, সেটা কি আর হয়? মঙ্গলবার যেমন নড়াইল থেকে গোটা পঞ্চাশেক মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারণায়। চার পাঁচটি পথসভার পর সেটা হয়ে গেল প্রায় শদেড়েকের কাছাকাছি। এর মধ্যে আবার আলাদা হয়ে গেল অগ্রবর্তী দল। ফরিদপুর থেকে ম্যাশ-মিডিয়া নামে একদল ভক্ত এসে দায়িত্ব নিল স্বেচ্ছাসেবকদের। পথসভায় মানুষজনের হুড়োহুড়ির মধ্যে শৃঙ্খলাটা রাখার ভার তারা তুলে নিয়েছে নিজ কাঁধে।

    তা মাশরাফির আরও অনেক ‘দায়িত্বই’ এ কদিনে বর্তেছে নড়াইলবাসীর ওপর। সকালে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি, সারাদিনে ১৫টি জায়গায় পথসভা করার কথা। এগুলো নির্ধারিত, তার মধ্যে আবার রাস্তার ওপর বেশ কিছু অনির্ধারিত সভা তো আছে। আর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় জটলা দেখলেই নেমে পড়ছেন। কারও সাথে হাত মেলাচ্ছেন, লিফলেট তুলে দিচ্ছেন। একেকটা জায়গায় কথা বলার সময়ও পাচ্ছেন না বলতে গেলে। তারপরও তো কিছু না বলে থাকা যায় না। সংবাদ সম্মেলনের আর সাক্ষাৎকারের বাঁধা গতের বাইরে গিয়ে এবার বলতে হচ্ছে নতুন কিছু। সেই কথায় একটা জিনিস থাকলই- সময়স্বল্পতার কারণে এবার সবখানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সবাই যেন তাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেন।

    প্রতিটি পথসভার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল আধ ঘণ্টা। কিন্তু নির্ধারিত আর অনির্ধারিত মিলে সময় লেগে যাচ্ছে আরও বেশি। বিশ্রামের জন্য তালবাড়িয়া বাজারে থামার কথা ছিল, কিন্তু সে সুযোগ হলো কই? সারাদিন সেভাবে তেমন কিছু মুখে তোলার ফুরসতই হলো না। লঞ্চে ডিম আর রুটি মুখে গুঁজে দিয়ে সারতে হলো লাঞ্চ, সারাদিনের খাওয়া বলতে ওটুকুই। উপায়ও নেই, দিনের মধ্যেই যে সবগুলো জায়গায় যাওয়া লাগবে!

    কিন্তু মানুষের ভিড় ঠেলে চলাটাই তো মুশকিল। কোলা গ্রামে তো রীতিমতো মেলাই বসে গেল। মাশরাফি আসার কথা সন্ধ্যার আগে, একটু পর পর মাইকে সশব্দে দেওয়া হচ্ছে ঘোষণা। এর মধ্যে স্কুলের মাঠ রীতিমতো লোকা লোকারণ্য, তাতে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম নয় খুব একটা। এর মধ্যে একজন হাওয়া-মিঠাই ওয়ালা বসে গেলেন তার সওদা নিয়ে, এক পাশে শুরু হয়ে গেল পাপর ভাজা। চানাচুর-ঝালমুড়িওয়ালা তো আছেই। মোটামুটি একটা উৎসব-উৎসব ভাব। মাশরাফির তখনো দেখা নেই, আরও কোনো জায়গায় হয়তো আটকে গেছেন। মানুষজন একটু বিক্ষিপ্ত, কিন্তু ঘন্টাখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পরও সমাগম কমেনি একটুও। এরপর প্রায় নিশুতিতে এলেন মাশরাফি, সাঙ্গ হলো অপেক্ষা।

    তবে শেষ হয়েও আসলে শেষ হয় না। মাশরাফি কথা শেষ করেন বটে, কিন্তু বের হতেই প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। সাধারণ মানুষ তো বটেই, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই সেলফি তোলার জন্য শুরু করেন হুড়োহুড়ি। মাশরাফি যতই তাদের বোঝান, তাদের নিরস্ত করবে কে? এর মধ্যে বড়দিয়া বাজারে আবার হয়ে যায় অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা। সেখানে নদীর অন্য পাড়ে যেতে হবে সভায়, পার ধরে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে অগুণিত মানুষ। এক পাশে বাইক রেখে লঞ্চে করে মাশরাফিকে যেতে হয় অন্য পারে। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া কত কঠিন!

    এসব অভিজ্ঞতা মাশরাফির আগে হয়নি। ক্রিকেট মাঠের জার্সি-ট্রাউজার ছেড়ে এবার পুরোদস্তুর পাঞ্জাবি-জিন্স পরনে, হাতে লিফলেট। দেশের জয় হার নয়, চাইতে হচ্ছে ভোট। রাত নামতেও নিস্তার নেই তার, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত নানা বৈঠকে। এর সঙ্গে সঙ্গেই আবার দেখা করতে হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে। এবার পাঞ্জাবি ছেড়ে শার্ট-প্যান্ট পরার সুযোগ হয়েছে, তবে কমেনি ব্যস্ততা। তার মধ্যেই আবার পরিচিতদের কুশল জেনে নিচ্ছেন। ঢাকা থেকে আসা শুভানুধ্যায়ীদের কাছে জানতে চাইছেন, আহারাদি বা থাকার ব্যবস্থা কী হলো। দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাঁধও যে চওড়া হচ্ছে, সেই প্রমাণও দিয়ে যাচ্ছেন। 

    এখনও অবশ্য অনেক কিছুর প্রমাণ করার বাকি। মাশরাফি সবসময়ই বলে এসেছেন, রাজনীতির মাঠে তিনি এখনও একদমই নতুন, তাঁর এখনো অনেক কিছু শিখতে হবে।  নড়াইলে সেই শেখার প্রথম পাঠটা একদম মন্দ হচ্ছে না বৈকি!