১৯৭৫ : শম্বুক সানির অদ্ভুতুড়ে ইনিংস
প্রথম বিশ্বকাপ। প্রথম ম্যাচ। কিন্তু সে ম্যাচেই ইতিহাসের অন্যতম ‘বিতর্কিত’ ইনিংস খেলে ওয়ানডে ক্রিকেটকে যেন বুড়ো আঙুল দেখালেন সুনীল গাভাস্কার। শম্বুকগতি কথাটাকেও এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন গাভাস্কার, এক পর্যায়ে ভারতকে একটু দ্রুতগতির ব্যাটিংয়ের অনুরোধ করতে গ্যালারি থেকে ছুটে এসেছিলেন দর্শক!
দুই বছর আগেই ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেলেছিল মেয়েরা, ছেলেদের প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের প্রথম ভাগটা ছিল দারুণ আশাজাগানিয়া। কন্ডিশন ছিল দারুণ, লন্ডনের আকাশে ঝকঝকে রোদ। অথচ কয়েকদিন আগেই ডার্বিশায়ারে একটা কাউন্টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছিল অতিরিক্ত তুষারপাতে।
৭ জুন, ১৯৭৫ সালে লর্ডসে ৬০ ওভারের ম্যাচে ৫.৫৬ হারে ৩৩৪ রান তুলেছিল ইংল্যান্ড, যা ছিল ওয়ানডের নতুন সর্বোচ্চ স্কোর। ডেনিস অ্যামিস করেছিলেন ১৪৭ বলে ১৩৭, ওয়ানডের সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল সেটি। ছয়ে নামা ক্রিস ওল্ড করেছিলেন ৩০ বলে ৫১ রান।
দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলেছিল আটটি দল, রাউন্ড রবিন লিগের পর ছিল নক-আউট। পরের পর্বে যেতে তাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রতিটি ম্যাচই, সঙ্গে দুই দলের পয়েন্ট সমান হলে দেখা হতো রান-রেট। ম্যাচ হারলেও বেশি ও দ্রুতগতির রান প্রয়োজন ছিল ভারতের, সেমিফাইনালের পথটা সহজ করতে।
আক্রমণ করছেন গাভাস্কার, যা ছিল সে ইনিংসে দুর্লভ!
তবে সেসব ভুলে গাভাস্কার শুরু করলেন অন্যরকম ধীরগতির ব্যাটিং। প্রথমে মনে হচ্ছিল, হয়তো নতুন বলটা দেখেশুনে খেলছেন। বল পুরোনো হয়ে গেল, গাভাস্কারের ব্যাটিংয়ের ধরন বদলালো না। যেন অন্য কিছু পেয়ে বসেছে তখন তাকে, হয়ে পড়েছেন নির্লিপ্ত। আশেপাশের কিছুই ছুঁয়ে যাচ্ছে না তাকে। অবশ্য তার ব্যাটিং ছুঁয়ে যাচ্ছিল মাঠের সবাইকেই, প্রথমে অবাক হওয়ার পর ধীরে ধীরে সবার মধ্যে বাড়ছিল বিরক্তি ও হতাশা।
এদিকে গাভাস্কার ব্যাটিং করছেন, ওদিকে গ্যালারিতে ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে পুলিশকে। দর্শকরা যে ছুটে ছুটে আসতে চাইছেন মাঠে, তাদের অনুরোধ- ব্যাটিংয়ে গতিটা যাতে বাড়ায় ভারত! পুলিশ অবশ্য সফল হয়নি সবসময়, ক্রিজে ভারতীয় ব্যাটসম্যানের দিকে দুই হাত তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন এক দর্শক- এমন ছবিও দেখা যায়।
গাভাস্কার শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ১৭৪ বলে ৩৬ রানে, স্ট্রাইক রেট ছিল ২০.৬৮। ভারত থেমেছিল ৬০ ওভারে ৩ উইকেটে ১৩২ রান তুলে, রানরেট ছিল ২.২! প্রথম ম্যাচ ভারত হেরেছিল ২০২ রানে। গাভাস্কারের এমন ব্যাটিংয়ের পেছনে আদতে কী ছিল, সেটা সরাসরি বলার উপায় নেই। সে ম্যাচে ৪৬ বলে ২২ রান করা আনশুমান গ্যায়কয়াড় বলেছিলেন, তারাও নিশ্চিত ছিলেন না আদতে গাভাস্কার কী করতে চাচ্ছেন সেটা নিয়ে। জুনিয়র ক্রিকেটার বলে সেটা বলারও সাহস করে উঠতে পারেননি। অবশ্য কারও মতে, লর্ডসে নিজেদের ঠিক আগের ম্যাচেই ৪২ রান অল-আউট হয়ে যাওয়ার স্মৃতির কারণে অতি-সতর্ক ছিলেন গাভাস্কার, সঙ্গে অন্য ব্যাটসম্যানরা।
তবে গুঞ্জন আছে, গাভাস্কারের এই ব্যাটিং ছিল ভারতীয় ম্যানেজমেন্টের প্রতি একটা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। অধিনায়ক হিসেবে শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনকে বেছে নেওয়া পছন্দ ছিল না তার, পছন্দ ছিল না ইংলিশ কন্ডিশনে ভারতের বেশি স্পিনার খেলানোর কৌশলও। অবশ্য নিজের এ ইনিংস নিয়ে অনেকদিন পর গাভাস্কার বলেছিলেন, এটা ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে ইনিংস, আর সে সময় ফর্মহীনতায় ভুগছিলেন তিনি। অবশ্য এ ইনিংসের ব্যাখ্যা তিনিও করতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। দেশে ফিরে আরেকদফা সমালোচনায় পড়েছিলেন গাভাস্কার।
আর পরে বলেছিলেন, ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই কট-বিহাইন্ড হয়েছিলেন, তবে ইংল্যান্ড আবেদনই করেনি সেটার।
সেটা হলে আর যাই হোক, বিশ্বকাপ বা ওয়ানডে ক্রিকেট দেখতো না এমন অদ্ভুত ইনিংস!
এরপর যা হয়েছিল-
সে ইনিংসের পরও বাদ পড়েননি গাভাস্কার। পরের দুই ইনিংসে বেশ ভাল গতিতেই করেছিলেন ৬৫ ও ১২ রান। ভারত জিতেছিল শুধু পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে, ইংল্যান্ডের পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও হেরে বাদ পড়েছিল গ্রুপপর্বেই। সে বিশ্বকাপের পর আরও তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন গাভাস্কার, ১৯৮৩ সালে ভারতের হয়ে জিতেছিলেন প্রথম বিশ্বকাপ।