• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৭৫ : শেষ উইকেট চমকে এজবাস্টনের 'প্রথম' থ্রিলার

    ১৯৭৫ : শেষ উইকেট চমকে এজবাস্টনের 'প্রথম' থ্রিলার    

    এজবাস্টন। বার্মিংহামের দক্ষিণভাগের শহরতলীর এই ভেন্যু দেখেছিল ব্রায়ান লারার মহাকাব্যিক ৫০১ রানের অপরাজিত ইনিংস। তবে এ ভেন্যু দেখেছে সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দুই ম্যাচ- ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার টাই সেমিফাইনাল, ২০০৫ সালে অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের ২ রানের জয়। 

    এজবাস্টন দেখেছিল বিশ্বকাপের প্রথম থ্রিলারও।  

    প্রথম বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের ৮ম ম্যাচে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান। টিকে থাকতে হলে এ ম্যাচে জয়ের বিকল্প ছিল না পাকিস্তানের। তবে ম্যাচের আগেই তারা হারিয়ে ফেললো গুরুত্বপূর্ণ দুজন ক্রিকেটারকে- অধিনায়ক আসিফ ইকবাল জরুরী এক অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে ভর্তি, আর পরীক্ষা ছিল বলে ম্যাচ বাদ দিয়ে অক্সফোর্ড গিয়েছিলেন ইমরান খান। পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব পেলেন মজিদ খান, আর অভিষেক হলো জাভেদ মিঁয়াদাদ নামে তরুণ এক ক্রিকেটারের।

    চার পেসারের সমন্বয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব দিলেন অ্যান্ডি রবার্টস। বাকি তিনজন অবশ্য পরে দুনিয়াকাঁপানো পেস চতুষ্টয়ের সদস্য নন। কিথ বয়েস, বার্নার্ড জুলিয়েন, ভানবার্ন হোল্ডার- স্কিলের না হলেও একটা ব্যাপারে কমতি ছিল তাদের- পেস। অবশ্য সব মিলিয়ে আক্রমণটা কম শক্তিশালি ছিল না মোটেও। 

    তাদের বিপক্ষে পাকিস্তানের ৬০ ওভারে ২৬৬ রান ছিল ভাল লড়াইয়ের মতোই এক সংগ্রহ। মজিদ খানের ৬০ রানের ইনিংসকে সহায়তা করলো আরও দুইটি ফিফটি- মুশতাক মোহাম্মদের ৫৪ ও ওয়াসিম রাজার ৫৭ বলে ৫৮ রান। মিঁয়াদাদ করেছিলেন ৩২ বলে ২৪। অবশ্য পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে রাজার উইকেটের পর পাকিস্তান বেশিদূর এগুতে পারেনি আর, যোগ করেছিল ১৭ রান। 

    ২৬৬ রান নিয়ে লড়াই করা যায়, তবে রয় ফ্রেডরিকস, গর্ডন গ্রিনিজ, ক্লাইভ লয়েড, রোহান কানহাই, আলভিন কালিচরণ বা ভিভ রিচার্ডসদের ব্যাটিং লাইন-আপের সামনে এ স্কোর নিয়ে কতোটাই আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়! শীঘ্রই পাকিস্তানকে অবশ্য দারুণ ভরসা দিলেন সরফরাজ নওয়াজ। গ্রিনিজ ও কালিচরন কট-বিহাইন্ড, ফ্রেডরিকস এলবিডব্লিউ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩ উইকেট নেই ৩৬ রানেই। 

    কানহাই-লয়েডে একটু ধাতস্থ হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর নাসের মালিকের বলে বোল্ড কানহাই। রিচার্ডসও শীঘ্রই ফিরলেন, ৯৯ রানে নেই ৫ উইকেট। তবে একদিকে ছিলেন সুস্থির লয়েড, ৪৬ রানের জুটিতে তাকে সঙ্গ দিলেন জুলিয়েন, ১৮ রান করে। ৫৫ রান করে লয়েডকে কট-বিহাইন্ড দেওয়া হলো মিঁয়াদাদের লেগস্পিনে, যে আউটটা মানতে পারছিলেন না ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরা। জয় থেকে তখনও ১১৬ রান দূরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাকি তিন উইকেট। 

    উইকেটকিপার ডেরিক মারেকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এরপর বাকি বয়েস, হোল্ডার ও রবার্টস। মারের ব্যাটিং কার্যকরীই ছিল, ব্যাটিং খারাপ করতেন না বাকি তিনজনও। তবে বয়েস ফিরলেন দ্রুতই। মারে দমলেন না, হোল্ডারও থাকলেন সতর্ক। দুজনের জুটি যখন জমছে, পাকিস্তান অধিনায়ক মজিদ আনলেন তার স্ট্রাইক বোলার সরফরাজকে। তিনি হতাশ করলেন না, নিলেন হোল্ডারের উইকেট। 

    এরপর বাকি ১৪ ওভার। জয় থেকে তখনও ৬৪ রান দূরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাকি শুধু এক উইকেট। ওয়ানডেতে তখন পর্যন্ত শেষ উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি ছিল ২৮ রানের। উইকেট পাওয়ার আশায় সরফরাজকে দিয়ে বোলিং করিয়ে গেলেন মজিদ, সেটা আর পেলো না পাকিস্তান। ১২ ওভারে ৪৪ রানে ৪ উইকেট নিয়ে থামতে হলো সরফরাজকে। 

    মারে-রবার্টসের ওপর তখন ভর করেছে শক্তিশালি কিছু, শেষ উইকেটে তারা ব্যাটিং করছেন সেটা যেন ভুলেই গেলেন। রানরেটও থাকলো চার-পাঁচের মধ্যে, ম্যাচ নেমে এলো শেষ দুই ওভারে। পাঁচ রান প্রয়োজন, মজিদ বোলিং দিলেন মিডিয়াম পেসার পারভেজ মিরকে। 

    মির ৫৯তম ওভার করলেন মেইডেন। মজিদকে এরপর বেছে নিতে হতো লেগস্পিনার মুশতাক ও পার্টটাইমার রাজার একজনকে। মজিদ জুয়া খেললেন। রাজা নিজের লেগস্পিন ছেড়ে শুরু করলেন মিডিয়াম পেস। 

    প্রথম বলে লেগবাই, রান-আউটের চেষ্টায় পাকিস্তান গুণলো একটি ওভারথ্রো। পরের বলে মিডউইকেট থেকে দুই রান, ম্যাচ টাই। চতুর্থ বলটা লেগসাইডে খেলে সহজ সিঙ্গেল নিলেন রবার্টস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ করলো অসম্ভবকে সম্ভব। ম্যাচটা পাকিস্তানেরই ছিল, সেটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল পরবর্তীতে টানা দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। মারে-রবার্টস গড়লেন শেষ উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। 

     

     

    তবে ম্যাচসেরা মারে হলেন না, সে পুরস্কার গেল সরফরাজের কাছে। কথিত আছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৯ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মাঠ ছেড়েছিলেন ম্যাচসেরা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা টম গ্র্যাভেনি। সরফরাজের দারুণ বোলিং দেখে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে পুরস্কার দিলেন তাকেই। 

     

    সরফরাজ ম্যাচসেরার পুরস্কার পেলেন, তবে তার চেয়ে বড় পুরস্কারটা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এনে দিয়েছিলেন মারে-রবার্টসরা। 

     

    এরপর যা ঘটেছিল- 

    গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তান জিতেছিল শ্রীলঙ্কার কাছে, তবে বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ ‘বি’ থেকে উঠেছিল সেমিফাইনালে, পরে ফাইনালও খেলেছিল এ দুই দল। অভিষেকেই থ্রিলারে অংশ থাকা মিঁয়াদাদ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন আরও ১৭ বছর পর।