১৯৭৫ : 'কালি'পুটে পিষ্ট 'লিলি'ভার
ফিক্সচার ঠিক হওয়ার পর থেকেই এ ম্যাচ নিয়ে ছিল বাড়তি উত্তেজনা। জম্পেশ অস্ট্রেলিয়ার, রোমাঞ্চকর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাচের দিন পরিপূর্ণ ওভাল। তবে সেখানে দাপট ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের, সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ানরা। কেনিংটন যেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ নিচ্ছিল কেনসিংটনে।
তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হলো একপেশেই, ১৪ ওভার বাকি থাকতেই জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু আলাদা হয়ে থাকলো একটা ইনিংস। আরেকটা একপেশে লড়াই। ‘গালিভার’ ডেনিস লিলি যেদিন পিষ্ট হলেন ‘লিলিপুট’ আলভিন কালিচরনের ব্যাটিংয়ে।
মেঘাচ্ছন্ন কন্ডিশনে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিংয়ে পাঠালেন ক্লাইভ লয়েড, ভরসা রাখলেন তার পেসারদের ওপর। তারা হতাশ করলেন না তাকে। প্রথম ওভারে ম্যাককোস্কার ফিরলেন জুলিয়েনের বলে, বয়েসের তোপে ছয় বলের ব্যবধানে নেই চ্যাপেল ভাতৃদ্বয়। ওয়াল্টার্সকে দারুণ ফিল্ডিংয়ে রান-আউট করলেন গ্রিনিজ। অস্ট্রেলিয়া ৬১, উইকেট নেই ৫টি।
অস্ট্রলিয়া আরেকবার ভর করল রস এডওয়ার্ডস আর রড মার্শের ওপর। ৬ষ্ঠ উইকেটে দুজন তুললেন ৯৯ রান, তবে সে জুটির শেষটা হলো এডওয়ার্ডসের বাজে একটা শটে। পার্ট-টাইমার ভিভ রিচার্ডসকে পরপর দুইটি চার মারার পর আলগা শটে বোল্ড হলেন এডওয়ার্ডস, ৫৮ রান করে। এরপর ধীরে ধীরে সঙ্গীহীন হয়ে পড়লেন মার্শ। তিনি ঠিকই ৫২ রানে অপরাজিত থাকলেন, তবে ওপাশে অস্ট্রেলিয়া ১৯২ রানেই গুটিয়ে গেল ৬ ওভার বাকি থাকতেই।
এ সম্বল নিয়ে লড়াইয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল দ্রুত ব্রেকথ্রু। গ্রিনিজের উইকেট ওয়াকার পেলেন ২৯ রানে। তবে এরপর যা হলো, সেটার জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন না অস্ট্রেলিয়ানরা। ক্রিজে এলেন আলভিন কালিচরন। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা, নিরীহদর্শন। শার্টের বোতাম অর্ধেক খোলা। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের মাথায় হেলমেট দূরে কথা, ক্যাপও নেই। এই ছোটখাট ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিয়ার আগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আলাদা করে শিকার হয়েছিলেন স্লেজিংয়ের। সেটা যদি মনে রাখেন কালিচরন, তবে অস্ট্রেলিয়ানরা সেসব স্লেজিংয়ের জন্য পরে আক্ষেপই করেছে।
সামনে ডেনিস লিলি, উচ্চতায় প্রায় ৬ ফুট। দীর্ঘ গোঁফ। শার্টের বোতাম খোলা লিলিরও, তবে সেটা ব্যাটসম্যানদের বুকে আরেকটু বেশি কাঁপন ধরায়। আর আছে পেস। বাউন্স। তখন বাউন্সারের কোনও সীমা ছিল না, বোলাররা দিতে পারতেন ইচ্ছামত। তবে সেদিন লিলির ইচ্ছার কোনও দাম থাকলো না, শর্ট বলে কোনও একটা চিট মোড যেন বের করে ফেলেছিলেন কালিচরন।
শুরু থেকেই চড়াও হলেন তিনি। লিলি শর্ট করেন। কালিচরন পুল করেন, হুক করেন। থাইপ্যাডের ওপর থেকে ফ্লিক করেন। লিলি যতো শর্টে যান, সে বলটা বাউন্ডারি থেকে ততো দূরে গিয়ে পড়ে যেন। যদি লিলি অফস্টাম্পে করেন, তখন কালিচরন ব্যাকফুটে গিয়ে মারেন কাভার দিয়ে।
মাঝে লিলির ১০ বলে কালিচরন খেললেন এভাবে- চার, চার, চার, চার, চার, এক, চার, ছয়, শূন্য, চার- ৩৫ রান। লিলি সেদিন ১০ ওভারে দিয়েছিলেন ৬৬, ওভারপ্রতি ৬.৬ হারে। ৬৩ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে এই অস্ট্রেলিয়ান ‘দানব’ আর কোনোবার এতো মার খাননি!
শেষ পর্যন্ত লিলিকে পুল করতে গিয়েই মিসটাইমিংয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন কালিচরন, ৮৪ বলে ১৪ চার ও ১ ছয়ে ৭৮ রান করে। উইকেটটা হয়তো একটু সান্ত্বনা জোগাতে পেরেছিল লিলিকে।
অথবা তার আগেই কালিচরন লিলিকে করে দিয়েছিলেন অনুভূতিশূন্য!
এরপর যা ঘটেছিল-
কালিচরনের পর দ্রুত ফিরেছিলেন ফ্রেডরিকসও। জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল ৩৪ রান, রিচার্ডস ও কানহাই ছুটি কাটানোর মুডে পেরিয়ে গিয়েছিলেন সেটা। সাত দিন পর আবার মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল, প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে।