• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৭৯ : হেডিংলির থ্রিলারে 'হেন্ডরিক-শো'

    ১৯৭৯ : হেডিংলির থ্রিলারে 'হেন্ডরিক-শো'    

    বব উইলিস এদিন করেছিলেন ২৪ রান। ৬৪ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে এই পেসার এর আগে পরে কখনও ৭-এর ওপরে রান করেননি। ৩৬ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে ৬ উইকেট ছিল জিওফ বয়কটের, যার দুটিই নিয়েছিলেন এদিন, ক্যারিয়ারসেরা ১৪ রানে ২ উইকেটের ফিগারসহ। 

    লো-স্কোরিং ম্যাচের বৈশিষ্ট্যই যেন এটা। ব্যাটসম্যানদের বোলিং সেখানে বদলে দেয় দৃশ্যপট, বোলারদের করা রান হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রেক্ষাপট যাই হোক, সেটা হয়ে ওঠে রোমাঞ্চকর। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে হেডিংলিতে গ্রুপপর্বে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচে যা হয়েছিল। সে রোমাঞ্চে উইলিস-বয়কটরা অবশ্য পার্শ্বনায়ক মাত্র। নায়ক ছিলেন একজন- ইংলিশ পেসার মাইক হেন্ডরিক। 

    দুই দলেরই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়েছিল আগেই। তবে লিডসে মেঘাচ্ছন্ন কন্ডিশনের নিচে সবুজাভ কঠিন এক পিচ লড়াইটাকে নিয়ে গিয়েছিল অন্যমাত্রায়। বয়কট পরে সেদিনের উইকেটকে বলেছিলেন, ‘ঢেউটিনের মতো কঠিন’। টসে জিতে ইংল্যান্ডকে তাই নিশ্চিতমনেই ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক আসিফ ইকবাল। ইমরান খান-সিকান্দার বখতের তোপে ৪ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে আসিফের সিদ্ধান্তকে বিরস বদনে স্বাগত জানিয়েছিল যেন ইংল্যান্ড। 

    তখনও লাল বল আর সাদা পোশাক, কতো বল খেললেন এর চেয়ে ব্যাটসম্যানদের বর্ণনা করতে বেশি ব্যবহৃত হয় কত মিনিট ব্যাটিং করলেন সেটা। বয়কট ৮৫ মিনিট ধরে আটকে রাখলেন পাকিস্তানকে, করলেন ১৮ রান। এরপর গ্রাহাম গুচ, ডেভিড গাওয়ার, ইয়ান বোথাম, বব টেইলর ও উইলিসের ছোটখাট ইনিংস মিলে ১৬৬ পর্যন্ত গেল ইংল্যান্ড। ৯ম উইকেটে টেইলর ও উইলিস তুললেন ৪৩ রান। সে জুটিতে যেন একটা বার্তা পেল পাকিস্তান, উইকেট কঠিন হলেও পরে গিয়ে বল যখন পুরোনো হবে, ব্যাটিং করাটা একটু সহজ এখানে। অবশ্য অন্যরকম একটা বার্তা দিলেন অফস্পিনার মজিদ খান, পেস-সহায়ক কন্ডিশনে ২৭ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তিনিই পাকিস্তানের সেরা বোলার। 

     

    মাইক হেন্ডরিক/ক্রিকইনফো

    মজিদ ও আরেক ওপেনার সাদিক মোহাম্মদ পাকিস্তানকে এনে দিলেন বেশ দৃঢ় একটা শুরু। ২৭ রান তুললেন দুজন অবিচ্ছিন্ন থেকে। তবে হেডিংলির আকাশ ফুঁড়ে হেন্ডরিক ঝড়টা নেমে আসা বাকি তখনও। নামল কিছুক্ষণের মধ্যেই। 

    এমনিতে হেন্ডরিক সেই অর্থে সুইং বোলার ছিলেন না, নির্ভর করতেন ঠিক জায়গায় ফেলে সিম করানোর ওপর। বয়কট হেন্ডরিককে বলতেন ‘যান্ত্রিক, গড়পড়তা’ বোলার। অফস্টাম্পের বাইরে পারফেক্ট লেংথে বোলিং করে যাবেন যিনি, খেলার কোনও সুযোগই দিবেন না। অর্ধেক-আক্রমণাত্মক, অর্ধেক-রক্ষণাত্মক ফিল্ডিং নিয়ে সেদিন একই জায়গায় বল ফেলে গিয়েছিলেন হেন্ডরিক। ১২ ওভার ধরে তাকে যেন খেলতে পারছিল না কেউই। বল শুধু ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছিল সবাইকে। 

    হেন্ডরিকের প্রথম শিকার মজিদ। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড প্রান্ত থেকে বল করছিলেন, মজিদ দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দিলেন বোথামের হাতে। দুই বল পর তার লেগকাটারে এলবিডব্লিউর ফাঁদে মুদাসসর নজর। ২৭ রানে ০ উইকেট থেকে পাকিস্তান ২ উইকেটে ২৭ রান। পরের ওভারে সাদিককে বোল্ড করে শুরু করলেন হেন্ডরিক। এরপর হারুন রশিদ প্রথম স্লিপে ধরা পড়লেন মাইক ব্রিয়ারলির হাতে। এর আগেই জহির আব্বাস ও জাভেদ মিঁয়াদাদ ফিরেছেন বোথামের বলে। ২৭ রানে বিনা উইকেট থেকে পাকিস্তান পরিণত হলো ৩৪ রানে ৬ উইকেটে। আট বলের ব্যবধানে ৪ উইকেট নিলেন হেন্ডরিক। মোট ১২ ওভার করলেন সেদিন, গুণলেন ১৫ রান। ক্যারিয়ারে এর চেয়ে ভাল বোলিং ফিগার তার আছে আর একটি। 

    অবশ্য গল্পটা সেখানেই শেষ হয়ে গেলে তো আর সেটা থ্রিলার হয় না। হেন্ডরিক ঝড়ের পর নতুন করে ঘর তুললো পাকিস্তান। 

    আসিফ খেললেন অধিনায়কের মতো করেই। ম্যাচে একমাত্র ফিফটি করলেন, ওয়াসিম রাজাকে নিয়ে ৬ষ্ঠ উইকেটে তুললেন ৫২, এরপর ইমরানের সঙ্গে যোগ করলেন আরও ২৯ রান। পাকিস্তানের সঙ্গে জয়ের পার্থক্য এখন ৫০। হুট করেই স্লিপে এলেন অধিনায়ক ব্রিয়ারলি, বল দিলেন উইলিসকে। আসিফ ক্যাচ দিলেন ব্রিয়ারলির হাতেই। 

    হতাশ হয়ে ফিরলেন আসিফ, অবশ্য তাকে আশা জোগাচ্ছিলেন ইমরান। তিনি জানতেন, অলরাউন্ডার ইমরানের সামর্থ্য আছে তখনও ম্যাচ বের করে আনার। মাথায় ঘুরছিল উইলিস-টেইলরের সেই জুটি। ৯ম উইকেটে ওয়াসিম বারিকে সঙ্গে নিয়ে অধিনায়কের আশাই পূরণ করছিলেন ইমরান। দুজনের জুটিতে উঠলো ৩০ রান, জয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব নেমে এলো ২১ রানে। 

    ব্রিয়ারলি জানতেন, কিছু ওভার তাকে করাতে হবে একমাত্র স্পিনার ফিল এডমন্ডসকে দিয়ে। তবে স্পিনারের ওপর চড়াও হবেন ইমরান, যেটা নেওয়ার সামর্থ্য নেই তখন ইংল্যান্ডের। এডমন্ডস ছাড়া ব্রিয়ারলির হাতে অপশন দুজন নিরীহগতির মিডিয়াম পেসার। একজন পার্টটাইমার- গ্রাহাম গুচ। আরেকজন বোলার হিসেবে মোটামুটি অজানা- বয়কট। ব্রিয়ারলি বেছে নিলেন বয়কটকে। সেটাই পরিণত হলো মাস্টারস্ট্রোকে। বয়কট বোলিং করতে এলেন মাথায় ক্যাপ চড়িয়েই। 

     

     

    যেদিন উইলিস ব্যাটিংয়ে অবদান রাখবেন, সেদিন বয়কট গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু এনে দেবেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! অবশ্য ভাগ্যটা ভাল ছিল তার, বেশিরভাগ বলই তিনি করেছিলেন বারি ও বখতকে। বারি তাকে কাট করতে গেলেন, ইনসাইড-এজড হলেন। স্টাম্পের ওপর দারুণ ক্যাচ নিলেন টেইলর। 

     

    ইমরান অবশ্য তাতে দমলেন না। সঙ্গী শেষ ব্যাটসম্যান বখত, যিনি খেলে ফেললেন ১৮ বল। জয় থেকে পাকিস্তান তখন ১৪ রানে দূরে। তবে সামনে বয়কটের মতো নিরীহদর্শন বোলার হলে কেইবা নিজেকে সামলাতে পারেন অনেক্ষণ! বখত পারলেন না। বয়কটের হাফভলিটা মাঠের বাইরে পাঠাতে চাইলেন তিনি। প্রায় সফল হয়েছিলেন। 

    সেটা হতে দিলেন না একজন। মিড-অফে বাউন্ডারির একটু ভেতরে ছিলেন হেন্ডরিক। তিনি লাফ দিলেন। আঙুলের ডগা আর পায়ের পাতা তখন প্রায় সরলরেখায়। মাথার ওপর থেকে ছোঁ মেরে বলটা ধরে নামিয়ে আনলেন। ইমরান অন্যপ্রান্তে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলেন, কোনো কথাবার্তা ছাড়াই। আসিফের মতে, অমন শটে আউট হয়ে বখত রীতিমতো অপরাধ করেছিলেন। 

    অবশ্য সেদিকে খেয়াল করতে বয়েই গেছে ইংল্যান্ডের। তারা তখন উল্লাসে মত্ত, ছুটছেন দিগ্বিদিক। যে ম্যাচের আদতে কোনও প্রভাব নেই টুর্নামেন্টের লাইন-আপে, সেটাই বনে গেল থ্রিলারে। সে থ্রিলার জিতলে ইংল্যান্ড তো উদযাপন করবেই।

    এরপর যা ঘটেছিল- 
    প্রথম সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে ৯ রানে আটকে দিয়ে প্রথমবার ফাইনালে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে পাকিস্তান হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ফাইনালে ভিভ রিচার্ডস ও জোয়েল গার্নারের কাছে পিষ্ট হয়েছিল ইংল্যান্ড।