১৯৭৯ : 'বিগ বার্ড'-এ বিধ্বস্ত ইংল্যান্ড
লর্ডসের নার্সারি এন্ডে এখনকার ‘স্পেসশিপ’ আকারের মিডিয়া সেন্টারটা হয়নি তখনও। ওপাশে গাছগাছালি। তখন তো এত বিশালকায় সাইটস্ক্রিনও ছিল না, যা ছিল, তা ঠিক ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার কোনও বোলারের বিপক্ষে ব্যাটসম্যানদের সুখকর দৃষ্টিসীমার জন্য সুবিধা করে উঠতে পারে না ঠিক। বল যে আসে সাইটস্ক্রিনের ওপর থেকে। দৃষ্টিসীমায় সেটা ক্ষণিকের জন্য তাই মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের ডালপালার সঙ্গে। সঙ্গে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে লন্ডনে। কমে আসছে আলো। ১৯৭৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে অনেকখানি ততক্ষণে ছিটকে গেছে ইংল্যান্ড। যা একটু ঝুলে ছিল, সেটা ছিটকে গিয়ে পড়ল এক ঝটকাতেই। সে ঝটকাটা এলো অতিকায় এক বোলারের হাত থেকে।
বিগবার্ড। জোয়েল গার্নার।
আগের বিশ্বকাপের পর অভিষেক হয়েছিল তার। সে বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল পরিস্কার ফেভারিট, ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর সেই পেস চতুষ্টয়। অ্যান্ডি রবার্টস। মাইকেল হোল্ডিং। কলিন ক্রফট। সঙ্গে জোয়েল গার্নার।
ফাইনালে ব্যাটিংয়ে একবার পথ হারিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভিভ রিচার্ডসের ১৩৮ রানের সঙ্গে কলিস কিংয়ের ৬৬ বলে ৮৬ রানের টর্নেডো, দুজনের দুর্দান্ত জুটিতে শেষ পর্যন্ত পেয়েছিল দারুণ এক সংগ্রহই। জবাবে ইংল্যান্ডের স্কোর একসময় গিয়ে দাঁড়ালো ২ উইকেটে ১৮৩ রান, ১২১ রানের ওপেনিং জুটির পর। স্কোরটা এ পর্যন্ত বললে ঠিক পরিস্থিতিটা বুঝানো যায় না, ততক্ষণে যে প্রয়োজনীয় রানরেট ছুঁয়ে ফেলেছে দুই অঙ্ক।
রানরেটটা নাগালে আনতে শুরু থেকেই ব্যাট চালাচ্ছিলেন গ্রাহাম গুচ। মাইক ব্রিয়ারলি বা জিওফ বয়কট রান-রেটের সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারেননি, গুচরা সেটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ইংল্যান্ডের তখন প্রয়োজন ছিল অতিমানবীয় কিছু। অতিমানবীয় পারফরম্যান্স ঠিকই দেখা গেল ফাইনালে, তবে ৪৮তম ওভারে নিজের দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে সেটা দেখালেন গার্নার। গুচরা মিলিয়ে গেলেন তাতেই।
গার্নার ছুঁড়তে লাগলেন ইয়র্কার। ২৮ বলে ৩২ রান করা গুচের স্টাম্প প্রথমে এলোমেলো হলো। চার বল পর ডেভিড গাওয়ারের রক্ষণ ভাঙলো। মাঝে ডেরেক র্যান্ডল ও ইয়ান বোথামকে ফেরালেন ক্রফট। বোথাম উড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন ক্রফটকে, লং-অনে পরিণত হলেন রিচার্ডসের দারুণ ক্যাচে। এটা সেই সময়, যখন এমন একটা ক্যাচ ধরলে সতীর্থদের আগে আপনি অভিনন্দন পাবেন দর্শকদের, কেউ এসে একটা চাপড় মেরে যাবেন হয়তো পিঠে।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের কাঠামো ভেঙে পড়েছে ততক্ষণে। ঝুলছে শুধু লেজটা। গার্নার এসে সেটা ছেঁটে দিলেন। ওয়েইন লারকিনস, বোল্ড। ক্রিস ওল্ড, বোল্ড। বব টেইলর, কট-বিহাইন্ড। তিনজনের কেউই রানের কলামে কিছু যোগ করতে পারেননি। ১১ বল করলেন গার্নার। ৪ রান দিলেন। নিলেন ৫ উইকেট।
কিছুক্ষণ পরই ক্রফট এসে বোল্ড করলেন মাইক হেন্ডরিককে। এরপরই ছুট লাগালেন মাঠের সবাই, উদ্দেশ্য প্যাভিলিয়ন। মাঠের মধ্যে ততক্ষণে ঢুকে পড়েছেন দর্শকরা। হেন্ডরিক আউট হয়েও একটা স্টাম্প তুলে ছুটছেন, ছুটছেন আম্পায়ার ডিকি বার্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেউ কোনও এক দর্শকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েও গেলেন একবার।
তবে তার আগেই ইংল্যান্ড হুমড়ি খেয়ে পড়েছে গার্নারের তোপে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়েছে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। লন্ডনের আকাশে উড়েছেন ‘বিগবার্ড’।
এরপর যা ঘটেছিল-
গার্নারের ম্যাচ ফিগার সেদিন ছিল ৩৮ রানে ৫ উইকেট। এখনও বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা বোলিং ফিগার সেটি। তার আগের বিশ্বকাপে ফাইনালে গ্যারি গিলমোর নিয়েছিলেন ৫ উইকেট, তবে ছিলেন পরাজিত দলে। গিলমোর-গার্নারের আগে-পরে ফাইনালে আর কেউ পাননি ৫ উইকেট।