১৯৮৩ : কপিল যেদিন ভারতের ভবিষ্যত গড়েছিলেন
লন্ডন থেকে এক ঘন্টারও কম সময় লাগে ট্রেনে করে যেতে। চিজেলহার্স্ট, পিটস উড, হাই ব্রুম পেরিয়ে ছোট্ট এক শহর- টানব্রিজ ওয়েলস। কেন্টের কান্ট্রিসাইডে মিশে গেছে যা। স্টেশন থেকে কবলস্টোন স্ট্রিট ধরে মাইলখানেকের হাঁটা পথে এগুলে ওয়ারউইক পার্কের রেসিডেনসিয়াল অ্যাভিনিউ। নেভিল গ্রাউন্ড সেখানেই।
নেভিল গ্রাউন্ডের মতো জায়গার ক্ষেত্রেই হয়তো বলা হয়- ছবির মতো সুন্দর। যেন সিনেমার কোনও সেট। চারপাশে রডোডেনড্রনের জঙ্গল, মধ্যখানে মাঠ। সাজানো-গোছানো সব তাঁবু, সঙ্গে পরিপাটি করে বসানো কাঠের স্ট্যান্ড। কেন্ট এখনও খেলে সেখানে। তবে নেভিল গ্রাউন্ডের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ম্যাচ ওই একটিই। যে ম্যাচ দেখেছিল ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস। হয়তো যে ইনিংসের কারণেই ওয়াঙ্খেড়ে বা চিদাম্বরম আজ মেতে ওঠে এভাবে। নেভিল গ্রাউন্ডের সে ইনিংস শুধু ভারতকে সে বিশ্বকাপ জয়ের পথে ঠেলে দেয়নি, ঠিক করে দিয়েছিল ভারতের ক্রিকেটেরই ভবিষ্যতের গতিপথ।
কপিলদেব রামলাল নিখঞ্জ- ২৪ বছর বয়সী ভারতের তরুণ অধিনায়ক সেদিন হয়ে উঠেছিলেন যেন দার্শনিক। তবে শুধু তত্ত্বকথা বলেই খালাস হননি তিনি, যা করেছিলেন সব হাতে-কলমে। সেদিন তিনি লিখেছিলেন ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’-এর রোমাঞ্চকর এক চিত্রনাট্য, নেভিল গ্রাউন্ডের সেটে যা মঞ্চায়িতও করেছিলেন তিনি।
ভারতের ম্যাচটা ছিল প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে আসা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, যারা কয়েকদিন আগেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। আগের দুই বিশ্বকাপে ভারত জিতেছিল শুধু পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে। নেভিল গ্রাউন্ডের সৌন্দর্যের কথা ভেবেই কিনা, এক দর্শক সঙ্গে নিয়েছিলেন ভিডিও ক্যামেরা। তবে তার ক্যামেরায় যা বন্দি হলো, তা অমূল্য।
টানব্রিজ ওয়েলসের নেভিল গ্রাউন্ডে ভারত নিজেদের আবিষ্কার করলো অদ্ভুত এক অবস্থায়, ৯ রানে নেই ৪ উইকেট। এলেন কপিল। বিশ্বকাপের মাস চারেক আগে সুনীল গাভাস্কারকে সরিয়ে অধিনায়ক করা হয়েছিল তাকে।
শীঘ্রই ভারতের দুর্দশা বাড়ল, ১৭ রানে নেই ৫ উইকেট। কারান-রসনরা চেপে বসেছেন ভারতীয়দের ওপর।
উইকেট ছিল জীবন্ত। জিম্বাবুয়ের বোলিং আক্রমণ ছিল লম্বা। সিম দিয়ে যেমন এধার-ওধার করছিলেন তারা, বাতাসে মিলছিল সুইং। নেভিল গ্রাউন্ডের সৌন্দর্য ভারতের কাছে তখন বিরস ঠেকছে, পারলে গিয়ে রডোডেনড্রনের ওই জঙ্গলেই হারিয়ে যান তারা। কপিল হারিয়ে যেতে দিলেন না। শুধু বিশ্বকাপ ইতিহাসের নয়, ওয়ানডে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা এক ইনিংস খেললেন এরপর।
ভারত যখন ডুবছে, চিন্তা বাড়ছে আয়োজকদের। একতরফা এক লড়াই হতে যাচ্ছে, ম্যাচটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে লাঞ্চের আগেই! মাঠে ছিলেন বিবিসির ডেভ এলম্যান-ব্রাউন, অফিস থেকে ফোন আসলো তার কাছে। মাঠ ছেড়ে আরেক জায়গায় গিয়ে একটা সাক্ষাতকার করার কথা বলা হলো তাকে। ব্রাউন কিছু একটা বুঝেছিলেন, অফিসকে জানালেন, “ম্যাচ শেষ হয়নি এখনও”।
তবে তিনি কিসের সাক্ষী হতে যাচ্ছেন, সেটা হয়তো নিজেও জানতেন না তখন।
কপিল যেন সেদিন মিশনে নেমেছিলেন। শীঘ্রই অল-আউট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, তবে সেসব ছুঁয়ে গেল না তাকে। তার চোখ তখন বাকি থাকা ওভার পঞ্চাশেকের দিকে। ৫ উইকেট যাওয়ার পর নামলেন রজার বিনি। কর্নাটক কেন শুধু, ভারতের হয়েও ওপেনিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল তার। ততক্ষণে রোদ ঝলমল করছে, তপ্ত সূর্যের নিচে উইকেটটা হারাচ্ছে ময়েশ্চার। তবে কপিলের সোজাসাপটা কথা, ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
নেভিল গ্রাউন্ডে সেদিন খেলা হয়েছিল মাঠের একপাশের উইকেটে। একদিকের বাউন্ডারি ছিল তাই বিশাল, যেদিকে অনায়াসেই নেওয়া যাবে তিন রান। আরেকদিক বড্ড ছোট, দুই নেওয়াই কষ্ট। কপিল লক্ষ্য করলেন ছোট বাউন্ডারির দিকে। কপিল শুরু করলেন রান বের করা। তবে বড় শট নেই তেমন, নেই আলগা ঝুঁকি। গোটা ইনিংসে একটা মিসটাইমিংয়ের মতো হয়েছিল তার, তবে ততোক্ষণে তিনি পেরিয়ে গেছেন ১৪০। যদি ‘পারফেক্ট’ কোনো ব্যাটিং ইনিংসের উদাহরণ টানতে চান, কপিল আপনার কাজটা সেদিন সহজ করে দিয়েছিলেন।
বিনির সঙ্গে কপিলের জুটি ৬০ রানের, ট্রাইকোসের বলে এলবিডব্লিউ হওয়ার আগে বিনি করলেন ২২। রবি শাস্ত্রি ফিরলেন ১ রানে। এলেন মদন লাল, তার সঙ্গে কপিলের জুটি ৬২ রানের। ২২ রানে ফিরলেন মদন। ভারত ১৪০, বাকি ২ উইকেট। জিম্বাবুয়ে তখনও আরেকটি অঘটন ঘটানোর দোড়গোড়ায়।
এলেন সৈয়দ মুজতবা হুসেইন কিরমানি। ভারতের উইকেটকিপার, বয়সে কপিলের বছর দশেকের বড়। তবে কিরমানি অধিনায়কের ‘সাপোর্টিং-রোল’-এর ভূমিকায় নেমেছেন। কপিল যদি অমিতাভ বচ্চন হন সেদিন, তবে কিরমানি হয়েছিলেন সেদিন ধর্মেন্দ্র।
৪৯তম ওভারে কপিল পৌঁছুলেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিতে, খেললেন ৭২ বল। ভারতের হয়ে সেটি ছিল কারও প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। তবে তখনও কপিল যেন নিজের খোলস থেকেই বের হননি। সেঞ্চুরির পর ব্যাটটা বদলালেন। তখন নতুন এক ধরনের ব্যাট বেরিয়েছে, যার হাতলটা বেশ লম্বা, কাঁধটা অনেক নিচে নামা। কিছুটা বেসবলের ব্যাটের মতো। কপিল সে অস্ত্র নিয়ে চালালেন আরেক ধ্বংসযজ্ঞ। এতক্ষণ দেখিয়েছিলেন ট্রেইলার, এবার শুরু হলো অ্যাকশন। এরপরের ১১ ওভারে কপিল একাই করলেন ৭৫।
৬০ ওভার শেষের কপিলের ইনিংস পড়ছিল এমন- ১৮১ মিনিট। ১৩৮ বল। ১৬ চার। ৬ ছয়। ১৭৫ রান, অপরাজিত। ভারত ৮ উইকেটে ২৬৬। কিরমানির সঙ্গে কপিলের জুটি ১২৬ রানের, কিরমানি করেছিলেন ৫৬ বলে ২৪। দুজনের সেই জুটি ৯ম উইকেটে ওয়ানডের রেকর্ড হয়ে ছিল আরও ২৭ বছর, ২০১০ সাল পর্যন্ত। কপিল একাই করেছিলেন ভারতের ৬৫.৭৮ শতাংশ রান, মোট সংগ্রহে ব্যক্তিগত অবদানের রেকর্ডে এর ওপরে আছে শুধু ভিভ রিচার্ডসের ৬৯.৪৮ শতাংশ। এমন ইনিংসের পর একগ্লাস পানি নিয়ে কপিলের কাছে নেমে এলেন গাভাস্কারও, তখন কপিলের অধিনায়কত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি।
জিম্বাবুয়ে অবশ্য তখনও হাল ছেড়ে দেয়নি। তবে বেশ কয়েকজন শুরু করেও ইনিংসটা ঠিক বড় করতে পারলেন না। যা লড়াই এলো সাতে নামা কেভিন কারানের কাছ থেকে। তার ৭৩ রানের ইনিংসের পরও জিম্বাবুয়ে ৩ ওভার বাকি থাকতে থামলো ভারতের চেয়ে ৩১ রান দূরে।
কপিল যখন নেমেছিলেন, অর্ধেক ব্যাটসম্যানের বিনিময়েও ভারতের রান তখন ৩১ হয়নি!
নেভিল গ্রাউন্ডের সেটে কপিলের এই ওয়ান-ম্যান শো অবশ্য টেলিভিশনে দেখানো হয়নি। তবে সেই ভিডিওক্যামেরাওয়ালা দর্শক কপিলের ইনিংসটা বন্দী করে রেখেছিলেন। পরে সেটাকে বেশ ভাল মূল্যে কিনেছিলেন কপিল।
তবে তার আগে এক অমূল্য ইনিংসের বিনিময়ে ভারতের ক্রিকেটের ভবিষ্যতটাই হয়তো কিনেছিলেন কপিল দেব।
এরপর যা ঘটেছিল-
ভারত ফাইনালে স্তব্ধ করে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে যা অন্যতম বড় অঘটন হিসেবে জায়গা পায় এখনও। আর চার বছর পর ভারতের মাটিতে এসেও জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা দর্শকের কাছে শুনেছিলেন, “কপিলকে মনে পড়ে?”
কপিলের সে ইনিংস মনে না রাখার কোনও কারণ অবশ্য জিম্বাবুইয়ানদেরও ছিল না।