১৯৮৩ : নয় সেকেন্ডে বদলে যাওয়া ইতিহাস
স্রেফ নয় সেকেন্ডের এক ব্যাপার।
এক নিরীহদর্শন মিডিয়াম পেসার শুরু করলেন তার রান-আপ। ক্রিকেট-ব্যাটিংয়ের অবিসংবাদিত এক রাজার ব্যাট ঘুরে সেটা জমা পড়লো প্রায় ২০ গজ পেছন ফিরে দৌড়ানো এক দারুণ অলরাউন্ডারের হাতে। পুরো ব্যাপারটা ঘটলো নয় সেকেন্ডে। আর তাতেই যেন বদলে গেল একটা বিশ্বকাপ ফাইনালের গতিপথ, একটা ক্রিকেট জাতির ক্রিকেটপ্রেমের সংজ্ঞা। হয়তো বদলে গেল ওয়ানডে ক্রিকেটই!
তার আগের দুই বিশ্বকাপ থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ রীতিমতো ‘অপরাজেয়’। ১৯৮৩ বিশ্বকাপেও আগের দুইবারের ‘অপরাজিত’ চ্যাম্পিয়ন হেরেছিল শুধু ভারতের কাছেই। তবে সে ম্যাচটাকে আদতে কেউ তেমন গুরুত্ব দেননি। যেমন ভারতকে খুব বেশি ‘একপেশে’ ছাড়া কেউ গুরুত্ব দেননি সেদিন। লর্ডসের ফাইনালে অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, ম্যালকম মার্শাল, ল্যারি গোমেজদের তোপে ১৮৩ রানেই ভারত গুটিয়ে যাওয়ার পর তাই একটা হতাশা কাজ করছিল অনেকের মনে- ভিভ রিচার্ডস ঠিক সেঞ্চুরির মতো রানটা পেলেন না!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ঙ্কর ‘পেস চতুষ্টয়’ এসে গেছে, ব্যাটিংটাও দুর্নিবার। তাদের সামনে দাঁড়াবে কে!
বালভিন্দর সান্ধুর বল ছেড়ে দিয়ে স্টাম্প হারালেন গর্ডন গ্রিনিজ। তাতে কিছু যায় আসে না। একটা খারাপ দিন যেতেই পারে। এলেন রিচার্ডস। বরাবরের মতোই ভাবলেশহীন। পোক্ত একটা এসএস হাতে চাপিয়ে ছড়ি চালাতে লাগলেন ভারতীয়দের নিরীহ মিডিয়াম পেসের ওপর। ড্রাইভ করছেন। পুল করছেন। ফ্লিক করছেন। বাউন্ডারি হচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় শুধু সময়ের ব্যাপার।
৫০ রানে স্টুয়ার্ট বিনির হাতে মদন লালের বলে ক্যাচ দিলেন ডেসমন্ড হেইনস। ততক্ষণে রিচার্ডস তার খেল শুরু করেছেন। ৪১ মিনিটের মতো সময় রিচার্ডস ক্রিজে আছেন তখন। ২৭ বল খেলেছেন। করেছেন ৩৩ রান। এর মধ্যে ৫ রান এসেছে বাউন্ডারি ছাড়া অন্য উপায়ে। রিচার্ডসও যেন চাইছিলেন, ম্যাচটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে।
অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটলো ঠিক এর পরপরই।
মদন লাল রান-আপ শুরু করলেন। লাফাতে লাফাতে আসলেন, ক্রিজে ঢুকে হাতটা বেশ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ছুঁড়লেন বলটা, একটু শর্ট অফ আ লেংথে। পুল করতে গিয়ে মিসটাইমিং হয়ে গেল একটু রিচার্ডসের। তবে মোমেন্টামটা পেলেন ঠিকই। সে বল ছুটল আকাশে নিক্ষেপ করা গোলার মতো করে, লক্ষ্যটা অভেদ্য না হলেও এধার-ওধার করে খুঁজে নেবে ঠিকই সেটা।
ডিপ ফাইন লেগ থেকে ছোটা শুরু করলেন যশপাল শর্মা। আর শর্ট মিড-উইকেট থেকে পেছন ফিরে সীমানার দিকে ছুটলেন আরেকজন- ভারত অধিনায়ক। ২৪ বছর বয়সী কপিল দেব কদিন আগেই ‘একাই একশ’-র নতুন রূপ দেখিয়েছেন জিম্বাবুয়েকে। তবে এ ক্যাচটা নিতে তাকে যেন দিতে হত একশ ভাগেরও বেশি কিছু। অবশ্য তার আত্মবিশ্বাসটা ছিল তুঙ্গে। হয়তো যশপালই কাছাকাছি থাকতেন বলটার, তবে কপিল অনেক আগেই থেকেই তাকে সঙ্কেত দেওয়া শুরু করেছেন- ক্যাচটা তার।
শেষ মুহুর্তে লম্বা হাতজোড়া মেলে ধরলেন কপিল। কাঁধের ওপর থেকে বলটা হাতে নিলেন বেশ ভাবলেশহীনভাবে। হিসাব করে করে যেন পা ফেলেছেন, বলটা যখন হাতে এলো তখনও সামনের পা একটু শূণ্যে। ক্যাচটা সম্পন্ন হলেই সে ভারটা রাখবেন মাটির ওপর।
এরপর কয়েক পা দৌড়ালেন কপিল, মোমেন্টামটা ধরে রাখার জন্য। মুখে বিস্তৃত হাসি। এপাশে এক হাত ওপরে তুলে ঝাঁকাচ্ছেন মদন, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটা হয়তো পেয়ে গেছেন তিনি। আর কপিল নিয়েছেন বিশ্বকাপকে অন্যতম বড় এক অঘটনের দিকে ঠেলে দেওয়া এক ক্যাচ। এক দর্শক এসে ঘাড়ে চাপলেন কপিলের। সীমানাঘেঁষে বসে থাকা ক্যারিবীয় সমর্থকরা যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। কেউ মুখে হাত চেপে লুকাচ্ছেন বিস্ময়। উদ্বাহু ভারতীয়রা।
২৮ বল। ৪২ মিনিট। ৩৩ রান। ৭ বাউন্ডারি। কট কপিল দেব। বোল্ড মদন লাল। থমকে গেলেন রিচার্ডস। থমকে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। থমকে গেল যেন সঙ্গে সময়টাও।
স্রেফ নয় সেকেন্ডের ব্যবধানে যেন বদলে গেল সব। ধসে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাম্রাজ্য। লেখা হলো এক এশিয়ান রূপকথা।
এরপর যা ঘটেছিল-
৫৭ রানে ২ উইকেট ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের, মুহুর্তেই তারা বনে গেল ৭৬ রানে ৬ উইকেটে। ১৯ রানের ব্যবধানে ৪ উইকেট হারানোর ক্ষতটা আর পূরণ করা হয়নি তাদের। রিচার্ডস সেদিন সেঞ্চুরির জন্য আক্ষেপ করেননি, আক্ষেপ করেছিলেন শুধু সেই ফিল্ডারের নামটা কপিল দেব ছিল বলে।