• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৮৭ : গ্যাটিংয়ের রিভার্স-সুইপ বুমেরাং

    ১৯৮৭ : গ্যাটিংয়ের রিভার্স-সুইপ বুমেরাং    

    সময়ের চেয়ে বড় ওষুধ নাকি হয় না। হয়তো কোনো ব্যাপারে আপনি মনকে শত চেষ্টাতেও বুঝাতে পারছেন না, সময় নিলে নাকি সয়ে যায় সেটাও। তবে এরপরও কোনও ক্ষুদ্র একটা ঘটনা থেকে যায়, যা আহত না করলেও খোঁচা দিয়ে যায়। বুকের মধ্যে কোথায় একটু হাহাকার জাগে, ইশ, সেটা যদি না হতো! তাহলে হয়তো পুরো চিত্রটাই হতো অন্যরকম। 

    ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে মাইক গ্যাটিংয়ের রিভার্স সুইপ আর ইংলিশদের অবস্থাটা এরকমই। সে সময় গ্যাটিং সে শটটা না খেললেও হয়তো তিনি শীঘ্রই আউট হয়ে যেতে পারতেন অন্যভাবে, হয়তো ইংল্যান্ড হারতো ঠিকই। তবে সেটা শুধুই বাস্তবতার একটা প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা, ক্ষতটাই যে বড্ড বেপোরোয়া! গ্যাটিংয়ের সেই রিভার্স সুইপ তাই আজও পোড়ায় ইংলিশদের। 

    ডেভিড বুনের শ্লথ গতির ৭৫ আর মাইক ভেলেটার ৩১ বলে ৪৫ রানের ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ২৫৩ রান। ৩১ ওভারে ১৩৫ রান তুলে ফেললো ইংল্যান্ড, ২ উইকেটে। অস্ট্রেলিয়া যেন ইডেনের দর্শকদের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তখন, একটু পর খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হবে। অস্ট্রেলিয়াকে কেউ ব্রেকথ্রু দিতে পারছেন না, প্রধান স্পিনার টিম মে তুলোধুনো হয়ে গেছেন। ৪৪ বলে ৪১ রান করে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন গ্যাটিং। 

    এলেন অ্যালান বোর্ডার নিজে। হ্যাঁ, বোর্ডার বাঁহাতে অর্থোডক্স স্পিন করতে পারতেন। টেস্টে ৪৬ রানে ৭ উইকেটের বোলিং ফিগারটাও কদিন বাদেই করেছিলেন তিনি। তবে ইডেনের সেই পিচে বোর্ডারকে ঠিক তেমন দানব ভাবার কোনও উপায় ছিল না। গ্যাটিং সেটা ভাবলেনও না। 

    প্রথম বলটা রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে করলেন বোর্ডার, সেটা লেগস্টাম্প দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হতে পারতো ওয়াইড। যেন মোটা কোনও মানুষ ঝুঁকে পড়ে জুতার ফিতা বাঁধছেন, এমন করে উপুড় হলেন গ্যাটিং। রিভার্স সুইপ করতে চাইলেন। ঠিক জোরে ব্যাটটা চালালেন না, আলতো করে খেললেন। বলটা ব্যাট ছুঁয়ে তার কাঁধে লেগে থমকে গেল ক্ষণিকের জন্য, উঠলো ওপরে। এমনই বিস্ময়কর অবস্থা, উইকেটের পেছনে গ্রেগ ডায়ারও আরেকটু হলেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন। 



    ক্ষণিকের বিস্ময় কাটিয়ে ডায়ার ছুটলেন। নিলেন ক্যাচ। আর গ্যাটিংয়ের সেই শট ঢুকে গেল ক্রিকেটের ভুলতে চাওয়া ইতিহাসের পাতায়, অন্তত ইংলিশদের কাছে। ম্যাচে যেন প্রাণ ফিরে পেল অস্ট্রেলিয়া। নাভিশ্বাস ছুটছিল তাদের, গ্যাটিংয়ের মতিভ্রম তাদেরকে দিল অক্সিজেন। এরপর তারা রীতিমতো পেয়ে বসলো ইংল্যান্ডকে। গ্যাটিংয়ের একটা আলগা শট লিখে দিল অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্বকাপের চিত্রনাট্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বটা। 

    আসলেই কি মতিভ্রম হয়েছিল গ্যাটিংয়ের? এমন নয়, তিনি রিভার্স সুইপ আগে করেননি। বরং সে টুর্নামেন্টে রিভার্স সুইপ ছিল তার অত্যন্ত কার্যকরী শটগুলির একটি। ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে টেনেছিল গ্রাহাম গুচের সঙ্গে তার ১১৭ রানের জুটি। স্পিনারদের বিপক্ষে খেলতে সেমিফাইনালের আগে শুধুই সুইপের অনুশীলন করেছিলেন গুচ, যেটিতে হয়েছিলেন ম্যাচেও সফল। আর গ্যাটিং করেছিলেন রিভার্স সুইপ। 

    টুর্নামেন্টে ছিলেন দারুণ ধারাবাহিক। রিভার্স সুইপের মতো ঝুঁকিপূর্ণ শট যে তার কাছে ব্যাপার ছিল না, সেটাই বোধহয় বুঝায় তার ৯৫-এর ওপর স্ট্রাইক রেট। তবে সবচেয়ে বড় দিনে সেই শটটাই বুমেরাং হয়ে গেল তার। তখনও তার সেই শট খেলার পেছনে যুক্তি ছিল, লেগসাইডে ৬-৩ ফিল্ডিং সেটিংয়ে বল করতে এসেছিলেন বোর্ডার। তার সেই ট্যাকটিকস যে কাজে আসবে না, হয়তো সেটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন গ্যাটিং, শুরুতেই নড়বড়ে করে দিতে চেয়েছিলেন বোর্ডারকে। 

    হলো উল্টোটা। গ্যাটিংকে হাঁটা দিতে হলো। হ্যাটটা খুলে চোখের ওপরের ঘামটা মুছে তিনি ছাড়লেন মাঠ। আর শীঘ্রই চাপে পড়ে গেল ইংল্যান্ড। অ্যালান লাম্ব ও ফিল ডিফ্রেইটাস চেষ্টা করলেও জেতাতে পারলেন না ইংল্যান্ডকে। শিরোপার খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হলো ইংল্যান্ডকে, যে উলটো হাঁটার শুরুটা হয়েছিল গ্যাটিংয়ের ওই উলটো সুইপ দিয়ে। 

     

     

    এর অনেকদিন পর গ্যাটিং বলেছিলেন, যে শটেই আউট হন না কেন, দিনশেষে সেটা ‘বাজে(আদতে বাজে একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন)’ শটই হয়। তার সেই শটের চেষ্টায় আক্ষেপ নেই কোনও। আক্ষেপ আছে শুধু সেই শটের ফলটা নিয়ে। 

    গ্যাটিংয়ের সেই রিভার্স-সুইপের চেষ্টায় আক্ষেপ না থাকতে পারে। ইংলিশরা সে শটটা নিয়ে এখনও আক্ষেপ করে, হয়তো করে যাবে অনেকদিন। 

    সময় সবচেয়ে বড় ওষুধের কাজ করতে পারে না সবসময়। 


    এরপর যা ঘটেছিল- 
    ৭ রানে সে ফাইনাল হেরেছিল ইংল্যান্ড। পরের বিশ্বকাপে আবারও ফাইনালে গিয়েছিল তারা। শিরোপা হাতছানি দিয়েছিল সেবারও। তবে ওয়াসিম আকরামের দুই বলে সেবারও থমকে যেতে হয়েছিল তাদের।