• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৯২ : ১ বলে ২২ রান আর দক্ষিণ আফ্রিকার এক জীবনের আক্ষেপ

    ১৯৯২ : ১ বলে ২২ রান আর দক্ষিণ আফ্রিকার এক জীবনের আক্ষেপ    


    হয়তো বৃষ্টি নামলে এখনও সেদিনের কথা মনে পড়ে কেপলার ওয়েসেলসের। 

    সিডনি, ১৯৯২। 'বর্ণবাদের' অভিশাপ কাটিয়ে প্রথম বিশ্বকাপে এসেই সেমিফাইনাল। অঙ্ক আর ক্রিকেটের সম্পর্কটা যেমন মধুর, বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কটা যেন ততোটাই তিক্ত। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এই দুইয়ের সম্পর্কটাই সেদিন গোলমেলে হয়ে গিয়েছিল। 

    সেই বিশ্বকাপ দেখেছিল অনেক নতুন ব্যাপার। রঙিন পোশাক, ফ্লাডলাইট, সাদা বল- তাও আবার দুই দিক থেকে দুইটি, ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন। তবে আলোর নিচে আঁধারের মতো করে লুকিয়ে ছিল বৃষ্টি আইনও। আগে যেখানে ওভারপ্রতি রান-রেটের অনুপাতে কমানো হতো লক্ষ্য, সে বিশ্বকাপে করা হলো নতুন নিয়ম, যেটি তৈরিতে ছিলেন রিচি বেনোও। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বৃষ্টিতে যতো ওভার কাটা পড়বে, পরে ব্যাটিং করা দলের লক্ষ্য ঠিক করা হবে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করা দলের সর্বনিম্ন রানের ততো ওভারগুলো বাদ দিয়ে। রানতাড়ায় চিরায়ত ‘সুবিধা’র কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছিল এ নিয়ম। 

    সেমিফাইনাল শুরুর আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তবে ওভার কাটা যায়নি শুরুতে। টসে জিতে ফিল্ডিং নিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলস। টসে ইয়ান চ্যাপেল তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বৃষ্টি হতে পারে জেনেও কেন রানতাড়ার ঝুঁকিটা নিচ্ছেন। ওয়েসেলস বলেছিলেন, সেটা মাথায় রেখেই হিসাব করে ঝুঁকি নিতে চান তারা। যে কোনো কিছুর জন্য তারা প্রস্তুত। তবে ওয়েসেলসরা আসলে প্রস্তুত থাকতে পারেননি।

    গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের সঙ্গে ক্রিস লুইস, ডেরমট রিভের ক্যামিওতে ২৫২ রান পর্যন্ত গেল ইংল্যান্ড। হিক দুবার আউট হতে পারতেন শুরুতেই, ডেরেক প্রিঙ্গলের বলে সূক্ষ্ণ এলবিডব্লিউর কল থেকে বেঁচেছিলেন, এরপর ক্যাচ দিয়েছিলেন নো-বলে। অবশ্য স্কোরটা বড় হতে পারত ইংল্যান্ডেরও। সেটা হয়নি সে বিশ্বকাপের আরেকটা অদ্ভুত নিয়মের খপ্পড়ে পড়ে। 

    টেলিভিশন ব্রডকাস্টারদের চাপে প্রতি ইনিংস শেষের নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া ছিল, সে সময়ের মাঝে যতো ওভার হয়, ম্যাচ হবে ততো ওভারেরই। দক্ষিণ আফ্রিকানরা বোলিং করলেন বেশ ধীরগতিতে, রিভ-লুইসের ঝড় ওঠার পর তো আরও গতি কমালেন তারা। প্রথম ইনিংস শেষ হওয়ার কথা ছিল স্থানীয় সময় ৬.১০-এ, সে সময়ে মধ্যে হলো ৪৫ ওভার। স্লো-ওভাররেটের কারণে পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে জরিমানা করা হয়েছিল, তবে ম্যাচশেষে যে জরিমানা তারা গুণেছিলেন, সেটার তুলনায় কিছুই ছিল না তা। 

    অ্যান্ড্রু হাডসনের ৪৬ ও আড্রিয়ান কুইপারের ৩৬ রানের পরও রানতাড়ায় পিছিয়ে পড়ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের ফিরিয়ে আনলেন ক্রিকেটের প্রথম স্পেশালিস্ট ফিল্ডার- জন্টি রোডস। তার ৩৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসের পর ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন লক্ষ্যটাকে নামিয়ে আনলেন দৃষ্টিসীমায়। বাগড়া বাঁধালো বৃষ্টি, যেটার জন্য ওয়েসেলস প্রস্তুত ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। 



    ১৩ বলে প্রয়োজন ২২ রান। আম্পায়াররা আলোচনা করে বন্ধ করলেন খেলা, বৃষ্টির বেগ বেড়েছে ততক্ষণে। ম্যাকমিলান-রিচার্ডসন খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করলেও ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ নিয়েছিলেন আম্পায়ারদের অফার। বৃষ্টি চললো ১২ মিনিট। 

    নাটক শুরু হলো এরপরই। প্রথমে স্কোরবোর্ড দেখালো, ১ ওভার কাটা গেছে, ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন লক্ষ্য ৭ বলে ২২ রান। আদতে তা নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যানেজারের কাছ থেকে এ তথ্যটা পেয়েছিলেন চ্যানেল নাইনের কমেন্টেটররা, তাদের কাছ থেকেই বার্তা গিয়েছিল পিআর টিমের কাছে। ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের সময় দুইটি মেইডেন ছিল, ফলে সেখান থেকে ছয় বল কাটা গেলেও দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন লক্ষ্যে রান কমেনি। হিসাবটা কঠিন হলেও তখনও ম্যাচে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপরই আম্পায়ারের কাছ থেকে তারা জানতে পারেন, আসলে কাটা গেছে দুই ওভার। তাদের তখনও প্রয়োজন ২২ রান, কিন্তু বলের সংখ্যা সাত থেকে নেমে এসেছে ১-এ। 

    এসসিজির স্কোরবোর্ড শীঘ্রই বদলে গেল। ‘সাউথ আফ্রিকা টু উইন, নিড টুয়েন্টি টু রানস, ফ্রম ওয়ান বল’- যেন মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার। অথচ একটু আগেও তারা জেনেছিলেন, যাবজ্জীবন হচ্ছে তাদের, ভাল কিছু করলে বেঁচে গেলেও যেতে পারেন তারা! 

    অবশ্য ভুলের সেখানেই শেষ নয়। শেষ বলে একটা সিঙ্গেল নেওয়ার পর ইংল্যান্ড জিতল ১৯ রানে, হিসাবমতে যা হওয়ার কথা ছিল ২০। তবে ওই দুই মেইডেনের মাঝে একটা লেগ-বাই লুকিয়ে ছিল, হিসাব করতে গিয়ে প্রথমে যা নজরে পড়েনি। খেলা যখন শেষ, তখনও দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের ‘নির্ধারিত’ সময়ের বাকি ছিল ২ মিনিট। তবে তার আগেই ফাইনালের স্বপ্নটার মৃত্যু হয়ে গেছে তাদের বৃষ্টি-আইনে পড়ে। 

    ওয়েসেলস হিসাব করে ঝুঁকি নিতে চেয়েছিলেন। হিসাবের খপ্পড়ে পড়েই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল সেদিন তাদের। 

    এরপর যা ঘটেছিল- 
    দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এ মার্টিন জনসন সেই আইনের কথা লিখেছিলেন এভাবে, “যদি ভিনগ্রহের কেউ সেদিন এসসিজিতে নেমে আসতো, তাহলে এ পৃথিবীতে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী নেই ভেবে আবার ফিরে যেতো।” বৃষ্টি-আইনে ক্রিকেটের বুদ্ধিমত্তা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৯ থেকে, ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড আসার পর থেকে। সে হিসাবটা ১৯৯২-এর হিসাবের মতো ততোটা বোধগম্য না হলেও অন্তত ১ বলে ২২ রানের মতো কিছু এখন দেখে না ক্রিকেট। 

     

     

    ইংল্যান্ড তৃতীয়বার ফাইনালে গেলেও সেবার হেরেছিল পাকিস্তানের কাছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাদের। আর এরপর আরও তিনবার সেমিফাইনাল খেললেও বিশ্বকাপ ফাইনালে যাওয়া হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। কে জানে, তাদেরকেও হয়তো তাড়া করে ফেরে সিডনির সেই বৃষ্টি-ভূত।